ধারাবাহিক থ্রিলার (নিয়তি) ৫ম পর্ব জয়ার মা সব শুনেও কেন জানি খুব সাহসী আচরণ শুরু করলেন। জয়াকে দ্রুত ডাক্তারের চেকআপের মাঝে রাখলেন। নিজের সমস্ত লিংক ব্যবহার করে হাসানের খোঁজ করার জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করলেন। এদিকে জয়া সিদ্ধান্ত নিল হাসানের মায়ের সাথে দেখা করবে, সম্ভব হলে তাকে সবকিছু খুলে বলবে। হাসানের মায়ের কাছে যাওয়ার আগে কী ভেবে যেন সে হাসানের বাসায় যায় আবার। কেন যেন বাসায় ঢোকার আগে খুব ভয় লাগছিল, অথচ এই বাসাটা তার নিজের হাতে গোছানো। আলমারির তাকে তার কাপড়, এমনকি বেসিনের ওপর তার ব্যবহৃত টুথব্রাশ— সবই যেন নীরব সাক্ষী দিচ্ছে তার আর হাসানের সুখময় দাম্পত্যের। রিনিকে হাসান বিয়ে করেছে, এটা জয়া একেবারেই মানতে পারছে না। জয়ার ধারণা, হাসানকে গভীর কোনো ষড়যন্ত্রে ফেলা হয়েছে, সেটা কী জয়াকে খুঁজে বের করতেই হবে! কিন্তু কীভাবে করবে, কোনো ধারণা করতে পারে না সে। অনেকদিন আগের পড়া প্রিয় এক থ্রিলারের কথা মনে পড়ল— "যখন তুমি কানা গলিতে আটকে যাবে, থামো! ভাবো ঠিক কীভাবে কীভাবে তুমি কানা গলিতে এলে। অবশ্যই কোনো পথ ফেলে এসেই কানা গলিতে আটকে গেছ। যদি একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে বের করতে পারো কানাগলিতে ঢোকার পথটা কোথায় ছিল, তাহলে অবশ্যই তুমি সঠিক পথে যাওয়ার বা এখান থেকে বের হওয়ার পথ পাবে।" জয়া ভাবলো, একটা দিন সে এই বাসায় কাটাবে, নিজেকে কিছুক্ষণ সময় দেওয়া দরকার। হাসানের ফ্ল্যাটের একটা এক্সট্রা চাবি সবসময় থাকে বাড়িওয়ালার কাছে। জয়া আজ বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে শুনলো পুলিশ নাকি এক্সট্রা চাবিটা নিয়ে গেছে। কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকালো জয়া। ভাবলো, ডিআইজি আঙ্কেলের কাছ থেকে জানতে হবে ব্যাপারটা। সে ছাদে উঠে, কী ভেবে যেন ছাদের দরজাটা বন্ধ করে দিল। আজকের দিনটা সে শুধুই একা কাটাবে, দুপুরে ফুড পান্ডায় কিছু অর্ডার করে নেবে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো জয়া। কী সুন্দর ছিমছাম তাদের ঘর! চোখের কোণে মুক্তো বিন্দুর মতো টলটল করছে জল তার। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার কপালের কয়েকটি অব্যবহৃত টিপ এখনো আয়নায় আটকে আছে। আহা! কত সুখস্মৃতি তার এই আয়নার সামনে! হাসানের একটা অভ্যাস ছিল, জয়া আয়নার সামনে দাঁড়ালেই, পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরবে। হাসানের কথা ইদানীং ভাবলেই অসহ্য কষ্ট হয় জয়ার। কোথায় কেমন আছে কে জানে! খেতে ভীষণ ভালোবাসতো তার হাসান, আর কত হাসিখুশি মানুষটা। ছোটবেলা থেকে সে হাসানকে ছাড়া কিছুই ভাবেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা কাগজ-কলম নিয়ে বসলো জয়া বিছানায়। পুরো জিনিসটা প্রথম থেকে ভাবা শুরু করলো সে— ‘হাসান আর সে ছোটবেলার বন্ধু। হাসানের স্কুল জীবনের প্রেম ছিল কান্তার সাথে। কান্তার সাথে ব্রেকআপের পর হাসানের সাথে তার সম্পর্ক, যেটা প্রেম থেকে দাম্পত্যে গড়ায় গত ২ বছর আগে। হাসানের কোনো গোপন বিষয়ই ছিল না যা জয়া জানত না। এমন কি হাসান কখনোই তাকে মিথ্যা বলেনি। হাসানের বন্ধুরা অনেকেই তাকে ভাবী ডাকে। হাসান সবসময়ই তাকে সবার কাছে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছে, এমনকি পরীক্ষার পর হাসানের মায়ের কাছেও ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার কথা। হাসানের মা কয়েক মাস আগে খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল, ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তিও ছিল, কিন্তু হাসান একবারও তাদের বাসায় মাকে আনার কথা বলেনি। তার মানে সে চায়নি মা এই বাসায় আসুক। যদি সে চাইতো, অবশ্যই মাকে এই বাসায় নিয়ে আসতে পারতো। সেই সময়টা হাসানের অনেক টাকার দরকার ছিল। জয়া বাবার কাছে হাসানের জন্য কিছু টাকা ধারও চেয়েছে, বাবা কঠিন গলায় না করে দিয়েছিলেন। হাসান অনেক কষ্টে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে সামান্য টাকা জোগাড় করেছিল, বাকি টাকা তার মামা দিয়েছে বলে শুনেছে। হাসানের নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন আগেও জয়া সারাদিন ওর কাছে ছিল। পরীক্ষার পড়ার সময়টাতে ওর আরও দুই দিনের রান্না করে দিয়েছিল জয়া। ফ্রিজ খুললে এখনো হয়তো সেই তরকারির অবশিষ্ট পাওয়া যাবে। ফ্রিজের খাবার নষ্ট হয়ে মনে হয় পচে গলে যাচ্ছে, ভেবে বিছানা থেকে নেমে ফ্রিজ খুললো জয়া। ফ্রিজের ভেতর বরফ জমে আছে। কোনো খাবারের বক্স চোখে পড়ল না। তাহলে কি হাসান সব খাবার খেয়ে শেষ করেছিল! ফ্রিজের ভেতরের দিকে একটা প্যাকেটে কিছু দেখা যাচ্ছে, সসেজ টাইপের। জয়া ভাবলো পচে যাচ্ছে ফেলে দেবে। প্যাকেটটা টান দিতে ভয়ে জমে গেল জয়া! মানুষের হাতের আঙ্গুল! প্যাকেটের ওপরে মার্কার দিয়ে কিছু একটা লেখা: QXMRN-2058। জয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, মাথাও ঘুরাচ্ছে, কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে। মে মাসের সাত তারিখে হাসান নিখোঁজ হয়। তার আগে ৫ তারিখে সে শেষ এই ফ্রিজ খুলেছে। ৪টা আলাদা বক্সে ৩ দিনের খাবার রেখেছিল। প্রতি বক্সে সকালের নাস্তা বাদে প্রতি বেলার খাবার রাখা ছিল। সে হিসাবে মাত্র দুই বক্স খাবার শেষ হওয়ার কথা, আরও দুই বক্স তরকারি থাকার কথা। ৫ তারিখের রাতের খাবার বাইরে বের করে রেখে সে গিয়েছিল বাসায়। তার মানে হাসানের নিখোঁজ হওয়ার পরেও কেউ একজন এই বাড়িতে এসেছে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে। এমন কেউ যার কাছে বাসার চাবি আছে। এবং সে তাকে এবং হাসানকে বিপদে ফেলার জন্য কোনো ভয়ংকর পরিকল্পনা (পরিকলপনা) করেছে। অথবা? না, সেই সম্ভাবনা ভুলেও মাথায় আনতে চায় না জয়া। তার হাসান অবশ্যই কোনো অপরাধের (ক্রাইমের) সাথে যুক্ত হতে পারে না। জয়ার প্রচণ্ড তৃষ্ণা পাচ্ছে, সে ব্যাগের ভেতর থেকে বোতল বের করতে গেল। বোতলের সাথে জড়িয়ে এলো একজোড়া নূপুর। নূপুর জোড়া দেখে কান্না পেলো জয়ার, ওর গত জন্মদিনে দেওয়া হাসানের উপহার। রুপার নূপুরের গায়ে কিছু অক্ষর, এলোমেলো অক্ষর। হাসান বলেছিল, এখানে একটা কোড আছে, জয়াকে ডিকোড করতে হবে। যদি পারে, তবে জয়াকে একটা গোপন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে। জয়া তখন পারেনি। হাসানকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল, হাসান শুধু হেসেছিল। বলেছিল— জয়া অবশ্যই পারবে। যেদিন পারবে, সেদিন সে জানবে হাসানকে বুঝে নিবে জয়া। অক্ষরগুলো ছিল: YBIFBSBLKJB3। জয়া হাসানের এইসব ছেলেমানুষির সাথে ছোটবেলা থেকেই তাই আর মাথা ঘামায়নি। হাসান খুব ভালোবাসতো ধাঁধা (রিডল), কোডিং। একবার তো ড্যান ব্রাউনের 'ভিঞ্চি কোড' পড়ে ক্রিপ্টেক্স আর অন্যান্য সব কোডিং, ডিকোডিং নিয়ে রাত-দিন পড়ে থাকত। বন্ধুদের জন্মদিনে নানারকম ধাঁধা দিয়ে মজা দিত। একবার ওদের এক বন্ধু আবিদের জন্মদিনে আবিদকে একটা ধাঁধা দিয়েছিল— তিনটা বক্স দিয়েছিল সে আবিদকে, যার মধ্যে যেকোনো একটা বক্সে আবিদের গিফটটা আছে। হাসানের ধাঁধাটা সলভ করলে আবিদ গিফটটা পাবে, নয়তো আবিদ সবাইকে ট্রিট দেবে। তিনটা বক্স তিনটা আলাদা রঙের গিফট র্যাপে মোড়া ছিল— একটা ছিল লাল র্যাপে মোড়া, একটা ছিল নীল র্যাপে মোড়া আরেকটা ছিল হলুদ র্যাপে মোড়া। হাসান আবিদকে তিনটা ক্লু দিয়েছিল, যেখান থেকে সঠিক উত্তরটা খুঁজে বের করতে হবে। প্রথম ক্লু ছিল— 'গিফটটা লাল বক্সে আছে'। দ্বিতীয় ক্লু হচ্ছে— 'নীল র্যাপের বক্সে গিফটটা নেই'। তৃতীয় ক্লুটা লেখা ছিল হলুদ বক্সে— 'গিফটটা আছে লাল বক্সে'। হাসান বলেছিল এই তিনটা ক্লু-এর মধ্যে যেকোনো একটা সত্য, বাকিগুলো মিথ্যা। আবিদকে সত্যটা খুঁজে বের করে গিফটটা নিতে হবে। আবিদ আর হাসানের এই ক্লু নিয়ে সে কী খুনসুটি! মনে পড়েই নিজের অজান্তেই হেসে উঠলো জয়া। কিছুক্ষণ আগের ফ্রিজের মাঝে পাওয়া ফ্রোজেন আঙ্গুলের কথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেল সে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কেমন যেন চোখ বুজে আসলো জয়ার। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখছিল জয়া, এক অতলান্তিক কূপে (কুয়ায়) পড়ে যাচ্ছে জয়া। কী ঘুটঘুটে অন্ধকার! আর কেমন শেওলা ধরা গন্ধ! ঘুমের মাঝেই যেন গন্ধ পাচ্ছিল। এর মাঝেই টের পেল তার সাথে বাঁধা তার সন্তান চিৎকার করছে আর ক্রমাগত লাথি দিচ্ছে তাকে। অসহ্য পরিস্থিতি। এর মাঝে সে হঠাৎ দেখতে পেল কেউ একজন চিৎকার করে নাম ধরে ডাকছে— 'জয়া, জয়া, জয়া'। কণ্ঠটা পরিচিত, সে মনে করতে পারলো না। জয়ার ঘুম ভাঙলো মোবাইল ফোনের ভাইব্রেশনে। ফোন বাজছে তার। আর ফোনের রিংটোনে মায়ের গলায় তার নাম সেভ করা, সেটাই ঘুমের ঘোরে শুনছিল সে। কোনো একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। জয়া ক্লান্ত গলায় ফোনটা রিসিভ করে রীতিমতো ভিড়মি খেলো। আপনা-আপনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো— কী! সত্যি!
http://dlvr.it/TNv7QP