ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১৪ ও ১৫
চতুর্দশ
পর্ব
দিল্লির
এক বেসরকারি ক্লিনিক। জয়া তার সন্তানকে নিয়ে অপেক্ষায়। ভেতরে একটি কেবিনে মৃত্যুর
সাথে লড়াই করে ফিরে আসা হাসান শুয়ে আছে। জয়া এক মুহূর্তে দ্বিধায় পড়েছিল—সে কি সত্যি সত্যি প্রতিশোধ নিতে দিল্লি এসেছে, নাকি তার ভালোবাসাকে
বাঁচাতে? হাসানকে এমন ভয়ঙ্কর অবস্থায় দেখে প্রতিশোধের আগুন যেন সামান্য স্তিমিত
হয়ে এসেছে। এই দুইয়ের মাঝে জয়া সেন বা নন্দিতা ব্যানার্জী হিসেবে তার আর কোনো
অস্তিত্ব নেই। সে এখন শুধুমাত্র একজন মা এবং তার সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের
রক্ষাকর্ত্রী।
হাসান এখন স্থিতিশীল, কিন্তু তার ডান চোখে ব্যান্ডেজ, আর বাম চোখটাও ফ্যাকাশে। জয়া ঢুকতেই হাসান ফিসফিস করে বলল, “জয়া, তুমি ভুল পথে যাচ্ছো… এই খেলা অনেক বড়।” তার কণ্ঠে অনুশোচনা নেই, আছে এক শীতল সতর্কতা।
ডিবি
সদর দপ্তর: T.R. এবং ডিজিটাল মুখোশ
ঘড়িতে
১টা ৪২। ডিবি সদর দপ্তরের আলো নিভে গেছে, কেবল সাদাবের রুমটা জ্বলছে। টেবিলে তিনটি
জিনিস — জয়ার রুমে পাওয়া পেনড্রাইভ, এক কাপ ঠান্ডা কফি,
আর পুরনো ফাইল যার ওপরে লেখা “Pulok Sen (Deceased)”। বাইরে হালকা ঝড়, জানালার কাঁচে বৃষ্টির ছাপ নেই, কিন্তু বাতাসে
বারুদের মতো গন্ধ।
সাদাব
কম্পিউটার অন করলেন। প্রতিটি ফাইলে ধূর্ত দৃষ্টি। প্রতিটা ঘটনা একের পর এক মাথায়
ঘুরছে, আর চোখ যাচ্ছে বারবার ফাইলের প্রতিটি পাতায়। মন বলছে কোথাও একটা কিছু
যোগসূত্র মিস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কী, বা কে? এই তৃতীয় ছায়া কে? কেনই বা পূলক
সেনকে অনুসরণ করে হাসানের বাসায় হাজির হয়েছিল? নাকি এমন কেউ, যে ঠিক চোখের সামনেই
আছে কিন্তু সাদাবের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে? কে হতে পারে?
পূলক
সেনের মতো দেশবরেণ্য মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে কারই বা এত আগ্রহ থাকতে পারে? নাকি
আসলে আগ্রহ ছিল হাসানের ব্যাপারে? নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের এক দুর্বল চরিত্রের হাসানকে
কেন, কী কারণে কেউ অনুসরণ করবে? ভাবতে ভাবতে ফাইলগুলো প্রায় মুখস্থ করে ফেলছিলেন
সাদাব। হঠাৎ ফাইলের শেষ পাতার এক লাইনে চোখ আটকালো— “7 May 18:20:54 — Signature Scan, Green Umbrella Insurance.”
দুটি
সিগনেচার—একটি পূলক সেনের, আরেকটি ম্যানেজারের। কিন্তু
অথরাইজেশনে একটা নাম — “Authorized by: T. R.” “T. R.” নামটা কোথায় যেন শুনেছে মনে হচ্ছিল সাদাবের।
নাকি রহমান!
গ্রীন
আমব্রেলার ওয়েবসাইট খুললেন সাদাব, খুঁটিয়ে খুঁজল, গুগলেও সার্চ দিল। তারপর এক
চিলতে হাসি ফুটে উঠল ইংরেজি এক জাতীয় দৈনিকের খবরের হেডলাইনে। মুচকি হেসে নিচু
গলায় বললেন— “তাহলে খেলা শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।”
Green
Umbrella-এর ভিতরের গল্প
জয়ার
ল্যাপটপটা আবার চালু করলেন সাদাব। একটা ফোল্ডার, নাম Insurance। ভেতরে
প্রিমিয়ামের কিছু ছবি, আর একটা নোটপ্যাডে হাতে লেখা— “বাবা (Pulok) বলেছিলেন, এই কোম্পানি আসলে অর্থ
সাদা করার ফ্যাক্টরি। বাইরে বীমা, ভিতরে লেনদেন। শুধু কী তাই? নাকি আরও অনেক কিছু?” সাদাব হাসলেন। “জয়া মাথা খাটিয়েছে বেশ। সে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা
করেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।”
সাদাব
আবার মন দিলেন T. R. সূত্রে। T. R. কেবল গ্রীন আমব্রেলা নয়, 'আশার আলো' নামক
ক্লিনিকেরও মালিক। এটা কি তবে অনুসন্ধানে জেনে গিয়েছিলেন পূলক সেন? নাকি পূলক
নিজেও জড়িত ছিলেন? সাদাব চুপচাপ নিজের মাথার ভেতর ছবি আঁকলেন— T.R. কি আসলেই একজন মানুষ নাকি একাধিক?
তিনি
জানেন, “স্ক্যান সিগনেচার মানে শুধু কাগজের সই নয় — এটা এক প্রকার ডিজিটাল কী। একটা ইলেকট্রনিক মাস্ক, যেটা যেকোনো
ডিলকে বৈধ করে দেয়। কিন্তু কেউ জানেনা আসল মানুষটা কে।” সাদাব চুপ করে বসে রইলেন। তার ঠোঁটে একফোঁটা হাসি ফুটে উঠল। “তাহলে এই মিস্টার T.R. কেবল ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদ নন, প্রযুক্তিরও
মাস্টার। নিজের সিগনেচারকে মেশিন বানিয়ে দিয়েছে।”
T.R.
এর সার্ভার লগ থেকে পাওয়া এনক্রিপ্টেড ডেটা স্ট্রিং সাদাব তার আইটি বিভাগের কাছে
দ্রুত ডিক্রিপশনের জন্য পাঠালেন:
T.R.
| 4BC3.K792 | Final.Key_X.10.43: | 'F.L. + K.L.'
পূলক
সেনের শেষ বিকেল
নিজের
ক্ষমতা ব্যবহার করে ডিবির আইটি ডিপার্টমেন্টের এক প্রভাবশালী সহকর্মীকে দিয়ে পূলক
সেনের মেইল খুলিয়ে নিলেন সাদাব। টাইমলাইন থেকে পাওয়া একখণ্ড ই-মেইল পড়লেন তিনি।
মেইলটি পাঠানো হয়েছিল ৭ মে সকালে ৬:২৪-এ। Subject: “Re: Signature discrepancy” “Sir, T.R’s
signature file shows modification. Please confirm if it’s manual or scanned.”
এটাই
ছিল পূলক সেনের শেষ ই-মেইল। ঠিক ২৫ মিনিট পর হাসানের ফ্ল্যাটে ঢুকে ঘটে তার
মৃত্যু।
সাদাব
মনে মনে বললেন, “পূলক মৃত্যু ডাকেনি, সে ডেকে ফেলেছিল ছায়াকে।”
সাদাব
নিজের শ্বাস থামিয়ে বললেন, “এই তো... এখানেই সব শুরু।” ফাইলের উপরে টাইমস্ট্যাম্প — ৬ May, 18:20:54 এবং মন্তব্য—“Payment released against accidental death claim.”
তিনি
মাথা নিচু করে বললেন, “কিন্তু ৭ মে সকালেই পূলক মারা যায়… অথচ টাকা ছাড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে মৃত্যুর ১৪ ঘণ্টা আগে!”
তিনি
আবার স্ক্রিনে জুম করলেন। ‘PS-LIFE/5CR’ — কোডের মধ্যে PS মানে Pulok Sen। পলিসিটা তাঁর নিজের নামে খোলা
জীবনবীমা। তদন্ত করতে গিয়ে তিনি খুঁজে পান, তার নিজের পলিসি থেকেই অজানা কিছু টাকা
উঠছে “premium adjustment” নামে। সেটার পেছনে খোঁজ নিতেই ৬ মে বিকেলে অফিসে যান, সেখান থেকে
হাসানের বাসায়—আর ফেরেননি। সাদাব এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ রাখলেন। “অর্থাৎ, পূলকের নিজের জীবনবীমার টাকাই ওর মৃত্যুর প্রমাণ ঢাকতে
ব্যবহার করা হয়েছে।” তিনি ভাবলেন, “আসলেই
কি হাসানের অনিচ্ছাতেই পূলক সেন মারা গেলেন? নাকি তাকে মরতেই হত সেদিন? হাসান
কেবলমাত্র একটা ঘুঁটি হয়ে নিয়তির হাতে ধরা দিয়েছিল, আর ডেকে এনেছিল নিজের জন্য এক
চরম সর্বনাশ।”
সাদাব
ধীরে মাথা তুললেন। “তাহলে ৬টা ২০ মিনিটে Mirror Port থেকে তার
সিগনেচার আপলোড করা হয়, ৭টা ১০–এ পূলক কোম্পানি ছাড়ে, আর পরদিন ৮টা ৪৮–এ সে মৃত।” তিনি নিঃশব্দে ফিসফিস করে বললেন, “এটা শুধু খুন না, এটা সময়ের নিখুঁত ব্যবহার।”
দিল্লি
— জয়ার প্রখরতা ও কৌশলগত ফ্ল্যাশ ড্রাইভ
ভোরের
বৃষ্টি থেমেছে। জয়া হাসপাতালের জানালায় হেলান দিয়ে ফোনে সাদাবকে ভয়েস নোট
পাঠাচ্ছে। তার চোখে জেদ, কণ্ঠে শান্ত আগুন—
“Green Umbrella-এর সার্ভার লগ আমি পুরানো বন্ধুর
হেল্প নিয়ে হ্যাক করেছি। Mirror Port নামে একটা এক্সটার্নাল ডিভাইস ওরা ব্যবহার
করেছিল, ঠিক যেদিন বাবা মারা যায়। ওই ডিভাইস দিয়েই পূলকের কণ্ঠ কপি করা হয়। যে
ভয়েস কল এসেছিল, সেটা ছিল AI overlay—Mirror Voice। আমি এখন T.R. এর সবচেয়ে সুরক্ষিত
জায়গায় আছি—তাদের কিডনি পাচার রুটে।”
জয়া
এরপর হাসানের বাসা থেকে গোপনে নিয়ে আসা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র পরীক্ষা করলো। হাসানের
লেখা অসংলগ্ন কথার নোটটি তার হাতে ছিল। নোটের এক কোণে হাসান পেন্সিল দিয়ে ইংরেজিতে
লিখেছে: "The final key is held by the one who sees the pattern, not the
love."
এরপর
সে ভাঁজ করা মানিব্যাগে একটি অত্যন্ত সাধারণ দেখতে কিন্তু শক্তিশালী এনক্রিপ্টেড
ফ্ল্যাশ ড্রাইভ খুঁজে পেল। ড্রাইভটি এমনভাবে রাখা, যাতে সহজেই চোখ এড়িয়ে যায়।
জয়া ড্রাইভটি তার ল্যাপটপে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু সেটি একটি শক্তিশালী
ফিজিক্যাল পাসওয়ার্ড চাইল।
জয়ার
হাত কাঁপতে লাগল। হাসান তার জীবনের এই শেষ মুহূর্তে ভালোবাসা বা আবেগের কথা
লেখেনি, লিখেছে 'প্যাটার্ন' এবং 'লজিক'-এর কথা। জয়া নিশ্চিত হলো, এই ফ্ল্যাশ
ড্রাইভটিই হলো T.R.-এর বিরুদ্ধে হাসানের শেষ অস্ত্র, যা কেবল একজন ডেটা
অ্যানালিস্টের দ্বারাই খোলা সম্ভব। তবে এই ডেটা অ্যানালিস্টকে হতে হবে খুব গোপন।
রিনি
— তার অন্তর্দ্বন্দ্ব
ঢাকার
ভাড়া করা বাড়িতে চোখ বুজে শুয়ে আছে রিনি। মাথায় তীব্র ব্যথা। কিছুই ভালো লাগছে না।
জামিনে
থাকার কারণে পুলিশের অনুমতি ছাড়া তার চলাফেরাও সীমিত। হাসানের কথা ভেবে চাপা
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সে বুঝতে পারেনি, হাসান তাকে কখনও চায়নি। বুঝতে পারলে কখনোই
জোর করত না। রিনি জানে, তার বাবা যখন বুঝতে পারলেন রিনি হাসানকে চায়, তখন হাসানকে
তার বাবা এনে দিতেই পারতেন। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে বাবার কাছে আবদার করেছিল রিনি
হাসানের জন্য। রিনির ভীষণ রাগি বাবা সেদিন চুপ করে শুনেছিলেন, কোনো উত্তর দেননি।
মাত্র এক মাসের মাথায় খুব অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে রিনির বিয়ে হয়ে যায় হাসানের
সঙ্গে। বিয়ের দিন হাসানের সঙ্গে রিনির একটা বাক্য বিনিময়ও হয়নি। পরীক্ষার দোহাই
দিয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিল হাসান। রিনির মনে হচ্ছে, সব নষ্টের গোড়া সে নিজেই। হাসানকে
পাওয়ার মোহে সে কখনো হাসানের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করেনি।
ভাবনায়
ছেদ পড়ল। ফোন করেছেন তার বাবা। রিনির মন আরও খারাপ হয়ে গেল। সে জানে, সে খারাপ
থাকলে খারাপ থাকেন তার বাবাও। তাই যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় কথা বলার চেষ্টা করল।
“হ্যালো বাবা।” “কেমন আছিস মা?” “ভালো আছি বাবা, শুধু সামান্য মাথা ব্যথা করছে।” “শোন, তোদের আর ঢাকায় থেকে লাভ নেই। পুলিশ
পুলিশের কাজ করছে। তুই তোর ফুপুকে নিয়ে বাড়ি চলে যা। আমি তোর এডমিশন মালয়েশিয়াতে
করাব ঠিক করেছি। দেশে আর পড়াশোনা করার দরকার নেই। হাসানের খবর পেলে তাকেও সেখানে
পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। তোকে ছেড়ে সে অন্য কোথাও কেন থাকবে?”
রিনির
বলতে ইচ্ছে করল — আমার থেকে পালিয়ে থাকার জন্যই সে হারিয়ে গেছে,
কিন্তু বাবার সঙ্গে তর্ক করতে মন চাইল না। শুধু বলল, “বাবা, ডিবি পুলিশের অনুমোদন ছাড়া আমার ঢাকা ছাড়া নিষেধ।” তালিব সাহেব হেসে বললেন, “ডিবি কেন? এই দেশে কার সাধ্য আছে তোকে আটকায়! আর
ডিবির কাছে এই কেস বেশি দিন নেই। পূলক সেন মারা গেছেন জঙ্গিদের হাতে। আর হাসান
নিজেই পালিয়েছে হয়তো। সো, কেস মোটামুটি ক্লোজ করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবে।
তুই এসব নিয়ে ভাবিস না।” রিনি অবাক হয়ে গেল — এত কিছু জানেন, কীভাবে?
পঞ্চদশ
পর্ব:
ঘড়িতে
১টা ৪২। ডিবি সদর দপ্তরের আলো নিভে গেছে, কেবল সাদাবের রুমটা জ্বলছে।
টেবিলে তিনটি জিনিস — জয়ার পাঠানো পেনড্রাইভ, এক কাপ ঠান্ডা কফি, আর
পুরনো ফাইল যার ওপরে লেখা “Pulok Sen (Deceased)”। বাইরে হালকা ঝড়, জানালার কাঁচে বৃষ্টির ছাপ নেই, কিন্তু বাতাসে
বারুদের মতো গন্ধ।
সাদাব
কম্পিউটার অন করলেন। প্রতিটি ফাইলে ধূর্ত দৃষ্টি। প্রতিটি ঘটনা একের পর এক মাথায়
ঘুরছে, আর চোখ যাচ্ছে বারবার ফাইলের পাতায়। মন বলছে—কোথাও
একটা যোগসূত্র মিস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কী? বা কে? এই তৃতীয় ছায়া কে?
তিনি
বারবার দেখতে লাগলেন সেই সিসিটিভি ফুটেজ… আচ্ছা, হাসানের মতো বোকা বোকা দেখতে একটা ছেলের
প্রেমে এই সব মেয়েরা কেন পড়ে? তার ২৯ বছরের জীবনে তো কখনো প্রেম এলো না। সে দেখতে
বরাবরই ভালো। লেখাপড়া, ক্যারিয়ার সব মিলিয়ে এই হাসানের চেয়ে তার ডিমান্ড মেয়ে মহলে
কম হবার তো কথা নয়, তবু তাকে কোনো মেয়ে প্রেমিক হিসেবে আমলেই নিল না কেন? ভাবতেই
ভীষণ হাসি পেল সাদাবের।
সাদাব
ভাবছিলেন হাসানের অন্তর্ধানের পর যখন পুলিশ তাদের বাসায় যায়, তখন কোনো আলামত কেন
পায়নি। খুব গুছিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। হাসানের অন্তর্ধানের পরে পুলিশ এলো আর
আলমারির দরজা খুলে দেখল। দরজা জোর করে ভাঙা হয়নি; সে অর্ধখোলা অবস্থাতেই
ছিল। কোনো স্ক্রু-ড্রাইভারের ছাপ নেই, কোনো শক্ত-প্রবেশের চিহ্নও নেই। কিন্তু
মেঝেতে আর্দ্র কফি-গুঁড়া ছড়ানো, ন্যাপথলিনের আঠালো চিহ্ন, আর টেপের চৌকস ছেঁড়া
অংশগুলো মিলল। কাঠের ভেতরে ছোট ছোট পলিথিন কণা পাওয়া গেল—ফ্রিজার ব্যাগের অবশিষ্টাংশ। আর আলমারির নীচে পাতলা একটা ঢেউ-ছাপ—যেন ভ্যানের টায়ারের নিচে থেকে কোনো ভারী জিনিস ইনডেন্ট করেছে।
সাদাব
রিপোর্ট দেখে বললেন, “এখানে জোর করে ব্রেক ইন হয়নি—কেউ জানলা/দরজা অজান্তে খোলা রেখেছিল। যদি কেউ এসেও থাকে, সে
বা তারা এসেছে, অনুমিতভাবে দরজা অর্ধখোলা পেয়েছে, ভেতরে ঢুকেই কাজ সেরে গেছে। তাই
বাকি প্রমাণগুলো (টেপ-ছেঁড়া, পলিথিন কণা, কফি কণা) আরও স্পষ্টভাবে দেখা যাবে—কারণ প্রোফেশনালরা জোর করে লক ভাঙার ঝামেলা করেনি।”
ফরেনসিক
নোটে পরে যুক্ত হলো: অপ্রাকৃতভাবে অর্ধখোলা দরজা মানে
- শত্রু-চিহ্ন অনুপস্থিত; ফলে অপারেটররা সরাসরি আলমারিতে ঢুকেছে।
- ফলে তাদের গ্লাভস-অদলবদল, ব্যাগ-আচরণ ও টিপিক্যাল
ট্রান্সপোর্ট-মার্কস (ফ্রিজার ব্যাগ রেসিডিউ) এখানেই থেকে গেছে।
সাদাব
হালকা করে বললেন, “হাসান দরজা লক করে গেলে, স্ক্রু-চিহ্ন থাকত—এখন দেখো, কেউ ঢুকেছে বেসরকারিভাবে; তারা সহজেই আলমারি থেকে প্যাকেট
তুলে নিয়ে গিয়েছে। এই সামান্য তফাতটা পরবর্তী তদন্তে বড় কৌতুক তৈরি করবে—‘জোর করে ঢুকেছে’ বনাম ‘খোলা
রাখা ছিল’—এটাই ওদের কাহিনী বদলে দেবে।”
ঢাকার
উত্তরা, রাত ১টা ২০। রিনি বাবার ফোন শেষ করে স্তব্ধ। “ডিবির কেসের খবর ও জানে কীভাবে?” মাথা ঘুরতে থাকে রিনির। ছোটবেলা থেকেই মা না থাকায় নিজের মধ্যে খুব
কনফিডেন্সের অভাব তার। সে ভীষণ মেধাবী ছিল। বাবার আগ্রহে অনলাইনে ডাটা
এনক্রিপশন, অ্যানালাইসিস সহ বেশ কিছু কোর্স করেছে। ইদানীং টুকটাক
ফ্রিল্যান্সিংও শুরু করেছিল সে। এর মধ্যে হাসানের সাথে বিয়ে তার দুনিয়া বদলে দিল।
বাবার
কথায় তার কেমন যেন মন খারাপ হলো। ফোন তুলল সাদাবকে, এক রিং-এ ধরলেন সাদাব, মনে হলো
যেন তার ফোনের অপেক্ষায়ই ছিলেন।
“হ্যালো সাদাব স্যার।” “রিনি, এত রাতে তুমি?” “সরি আপনি মনে হয় ঘুমাচ্ছিলেন-” “আরে না, আমি এখনো অফিসে, বলো।”
“আচ্ছা হাসান ভাই আর পুলক সেনের কেস নাকি প্রায়
ক্লোজ হয়ে এসেছে।” “কে বলল তোমায়? কই না তো, আমি এখনো কাজ করছি।” “না, মানে বাবা বলছিলেন…” অন্যমনস্ক শোনাচ্ছিল রিনির গলা।
কৌতুহলী
সাদাব জিজ্ঞেস করলেন – “কী বলল তোমার বাবা?”
রিনি
ফোন কানে ধরে এক মুহূর্ত চুপ করে ছিল। ঘরের টিউবলাইটে খাটের পাশে রাখা বাবা-মা সহ
তার ছোটবেলার ছবির পুরনো ফ্রেম—হাসিমুখ, তার কাঁধে হাত, কী নিশ্চিন্ত
নির্ভরতার। সেই মুখটাই আজ অচেনা লাগে। “স্যার,” রিনি আস্তে বলল, “বাবা বলল—ডিবির কেস খুব তাড়াতাড়ি পুলিশের কাছে যাবে। পুলক
‘উগ্রবাদীদের’ হাতে… আর হাসান ‘স্বেচ্ছায় নিখোঁজ’।”
রিনি
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। কী মনে করে অনেকদিন পর তার জিমেইল খুলল, সেখান থেকে
মাইক্রো ওয়ার্কারের ওয়েবসাইট যেখানে সে কাজ করত।
কিছুক্ষণ
পর কম্পিউটার খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল রিনি। হঠাৎই পপ আপ করল ছোট্ট একটা নোটিফিকেশন।
না ঘুমালে হয়তো জানতে পারত তার ল্যাপটপটা-ও ট্র্যাক করা হচ্ছে, আর সেটা একটা আননোন
লোকেশন থেকে।
পরদিন
সকালে পত্রিকার প্রথম পাতার হেডলাইন “ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হাতেই খুন হয়েছেন পুলক সেন”। সকালে ১০ টায় নিজের ফ্ল্যাটে বসে পত্রিকা পড়তে পড়তে ভ্রু
কোঁচকালেন সাদাব। সে এখনো রিপোর্ট জমা দেননি। এর মাঝে কী করে এমন খবর বের হলো।
পুরো সংবাদটি পড়লেন। স্পেসিফিকভাবে কারো নাম উল্লেখ না করে, পুলিশের বরাতে জানানো
হয়েছে। হেডকোয়ার্টারে ফোন করে আইজি-র অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলেন, এর মাঝে কল এলো জয়েন্ট
কমিশনার (ডিবি), ডিএমপি-র।
“সাদাব, পুলক সেনের কেসটা, ডিবি থেকে পুলিশের
কাছে চলে গেছে। তুমি আপাতত অন্য কেইসগুলো নিয়ে আগাও।” ‘কেন’ জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বললেন, “আর শোনো, ঐ যে হাসান নামে ঢাকা ইউনিভার্সিটির একটা ছেলের নিখোঁজের
একটা কেইসও ছিল বোধহয় তোমার হাতে, এটা নিয়ে আপাতত মাথা ঘামানোর কিছু নাই। ছেলেটির
পরিবার থেকে জানানো হয়েছে, ছেলেটি নাকি বাসা থেকে রাগ করে চলে গিয়েছিল, দেশের
বাইরে চলে গেছে। ওর পরিবার নিশ্চিত করে কেইস তুলে নিয়েছে। তুমি আপাতত ফ্রি সাদাব।
গুড জব। টেইক সাম রেস্ট।” আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলেন
জয়েন্ট কমিশনার।
সাদাব
কাল রাতে রিনির ফোনের কথা ভাবলেন। রিনি প্রায় একই কথা বলছিল—তার মানে সব গোড়া এক জায়গাতেই। সাদাব নিশ্চিত হলেন, তালিব রহমান
তার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ব্যবহার করে পুরো তদন্তকে ধামাচাপা দিয়েছেন। কিন্তু
তার মাথার ভেতর তখনো ঘুরছে T.R.-এর এনক্রিপ্টেড নোট এবং হাসানের রেখে যাওয়া ‘প্যাটার্ন’
খোঁজার বার্তা।
তিনি জানেন, তার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা শেষ। এই মুহূর্তে তার একটাই পথ খোলা—ছায়া থেকে কাজ করা।

Comments
Post a Comment