ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১৬ (সমাপ্তি)
ডিবি অফিস, মিন্টো রোড
— দুপুর ১টা ১০।
বাইরে মৃদু বৃষ্টি।
অফিসে আজ অন্যরকম হাওয়া। করিডোরে পুলিশ অফিসাররা ধীর গলায় কথা বলছে, কেউ কেউ
তাকাচ্ছে সাদাবের দিকে — এমনভাবে, যেন সে এখন আর নিজের জায়গায় নেই। তোমার রুমে একটা কাগজের ফাইলে তার মাঝে একট অফিসিয়াল
চিঠি। —
“Case Transfer: Pulok Sen Murder / Hassan
Missing – Handover to General Police.”
সাদাব টেবিলে বসে ছিল,
মুখে নিরাসক্ত হাসি। এই কাগজটার মানে সে ভালো করেই জানে—
এখন থেকে এই কেসে তার
কোনো অফিসিয়াল অনুমতি নেই। কিন্তু ফাইলের ভেতরে এখনও তার ছোঁয়া আছে— রিপোর্টগুলো, ল্যাপটপের স্ক্রিনশট, আর জয়ার পেনড্রাইভে পাওয়া “EchoMask” ফোল্ডার। সবই এখন প্রমাণ—যা কেউ স্পর্শ করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজে চায়।
ঠিক তখন তার এক পুরানো
বন্ধু সামনে এসে দাঁড়াল ফারজানা, সাইবার ইউনিটের ইনচার্জ। তারা একসাথে ট্রেনিং
করেই পুলিশে জয়েন করেছে। সাইবার ইউনিটে কাজ করার জন্য বিভিন্ন কেইসে সাদাব কে
প্রায় ই ফারজানার হেল্প নিতে হয়। তাই আরো জমে উঠেছে এই বন্ধুত্ব। ১৫ দিনের ট্রানিং
শেষে গত কাল ই চায়না থেকে ফিরেছে ফারজানা। আজ অফিসে জয়েন করেই সাদাবের অফিসিয়াল
চিঠী ফারজানাকেও সিসি দেয়া হয়েছে।
রুম এ দরজা ঠেলে ঢুকলো
অত্যন্ত সিরিয়াস চেহারা ক্ষুরধার সন্দরী ফারজানা। ফারজানার আরেকটা পরিচয় হলো সে
অর্থ মন্ত্রীর ভাইয়ের মেয়ে। সে খুব পাওয়ারফুল পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসায়
তাকে সহজে কেউ ঘাটায় না। কিন্তু সাদাবের সাথে তার বন্ধুত্ব অনেক পুরানো।
— “তুমি বুঝেছো, তোমায় কেস থেকে সরানো হয়েছে?”
সাদাব
শান্তভাবে কফি চুমুক দিল।
—“হ্যাঁ। কিন্তু আমার মস্তিষ্কটা তো এখনো ডিএমপিরই
অংশ।”
—“তুমি জানো, এভাবে কাজ করলে ঝুঁকি আছে।”
—“ফাইলটা আমি চালাব না, আমি শুধু তথ্যদাতা। তোমরা
অফিসিয়ালি নাম দেবে, আমি বাইরে থেকে দেখব কে কী করে।”
ফারজানা
একটু থামল, তারপর নিচু গলা য় বলল—
—“তোমার জন্য আমি এক্সেস রেখে দিচ্ছি। কিন্তু কোনো
লিগ্যাল সাপোর্ট থাকবে না।”
—“চিন্তা করো না,” সাদাব
হেসে বলল, “আমি ছায়ায় কাজ করতে অভ্যস্ত।”
ফারজানা
বেরিয়ে গেল। সাদাব নিজের কম্পিউটার খুলল।
সে
খাতায় লিখল— “EchoMask = AI Voice Replica / Used on May 7.” তার নিচে একটা ছোট্ট নোট: “T. R”??????
আজ আর অফিস করতে ইচ্ছে
করছেনা সাদাবে। “ফারজানা, আমার কাছে কিছু সিকিউরিটি লেভেলের ডেটা
আছে, তোমার ইনপুট দরকার। আমি তোমার অফিসে আসছি।”
একটা গভীর নিঃশ্বাস
ফেলে ফাইলগুলো ব্যাগে রাখল। “তাহলে অফিসে না, এবার ছায়া থেকে লড়াই।” সাদাব প্রথম কাজ, জোর জোর করে জোর করে নয়—ধীর কৌশলে সব প্রমাণ তিনস্তরে সংরক্ষণ করল। এক কপি নিজের কাছে, এক
কপি ফারজানার সাইবার ইউনিটে (ইনফরম্যান্ট-লক), আর একটি কপি আইনজীবীর কেস-লক-বক্সে।
এগুলো মিলেই পরবর্তী দিনগুলোর কোর্ট-কৌশল গড়বে।
অফিস থেকে বেরিয়ে সাদাব রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল।
টেবিলের আলোয়
ফারজানার মুখটি স্পষ্ট, কিন্তু তাতে আবেগের চিহ্নের চেয়ে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ধার
বেশি। হাসানের ওয়ালেটে পাওয়া সেই বহু-আলোচিত কোডটি সামনে খোলা। ফারজানা নিস্পৃহ,
প্রায় যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল, "সাদাব, বাবা আমার আবেগকে ব্যবহার করেছিল,
কিন্তু এই কোডটি কেবল হাসান এর নয়, পুলক আঙ্কেলেরও শেষ চাল ছিল।"
ফারজানা কোডটি
বিশ্লেষণ করল: RBK5.30PL3RI2VCT-2807।
" দ্যাখো, RBK
মানে Rahman Bank Key। টি আর তার কিডনি
চক্রের সমস্ত প্রমাণ একটি ব্যক্তিগত লকারে রাখতেন। পুলক আঙ্কেল, যিনি এই চক্রের
বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করছিলেন, তিনি শেষ মুহূর্তে এই টোকেনটি তৈরি করেন।
PL3RI2VCT হলো Pulok's Locker 3rd Row 2nd Vault Confirmation Token—টোকেনটি দিয়ে ওই লকারের ডিজিটাল প্রমাণ পাওয়া সম্ভব ছিল।"
সাদাব চোখ সরু করলেন।
"আর হাসান এই কোড ব্যবহার করে পূলককে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল?"
"না,"
ফারজানা মাথা নাড়ল। "হাসান জানত, পুলক আঙ্কেলের মৃত্যুর পর রিনি ই একমাত্র
ব্যক্তি, যে সম্ভবত এই টি আর চক্রের বাইরে গিয়ে, ডাটা এনক্রিপশন বুঝে এই কোড
ক্র্যাক করতে পারবে তার কারন কি তুমি তো বুঝতেই পারছ। আর ভুলে যেওনা রিনির প্রতি
এটা ছিল তার বিশ্বাস, যা ভালোবাসার চেয়েও বেশি লজিক্যাল।"
পরদিন সকালে, সাদাব
লকারের প্রমাণ হাতে নিয়ে T.R.-এর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ডিজিটাল ফাঁদ পাতলেন। রিনির
ল্যাপটপ ট্র্যাক হচ্ছে জেনে, সাদাব সেখানে একটি ভুয়ো ফাইল নামালেন—'TALIB'S FLIGHT MANIFEST: DELHI'। তালিব সাহেব যেন বিশ্বাস করেন,
সাদাব তার দিল্লি যাওয়ার গোপন রুট ধরে ফেলেছে।
সময়: গভীর রাত,
দিল্লি।
তালিব সাহেব সেই ফাইল দেখে আর এক মুহূর্ত
অপেক্ষা করলেন না। ভোররাতের ফ্লাইটে নয়, তিনি তাঁর প্রভাব কাজে লাগিয়ে কূটনৈতিক
ক্লিয়ারেন্সে একটি বেসরকারি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দিল্লি রওনা দিলেন। তাঁর লক্ষ্য
স্পষ্ট: হাসানকে শেষ করা এবং ক্লিনিকের ডিজিটাল প্রমাণ মুছে ফেলা। সেন্ট মেরি’স ক্লিনিকে করিডোরের আলো ঝলসে উঠল। তালিকাভুক্ত রোগী নন্দিতা
ব্যানার্জির (জয়া) কেবিনের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছেন তালিব সাহেব। তার গায়ের দামি
পোশাক আর চোখে তীক্ষ্ণ সতর্কতা—তিনি কোনো সাধারণ ব্যবসায়ী নন। রিনির ল্যাপটপে
সাদাবের সাজানো 'FINAL EVIDENCE' ফাইলটি দেখার পর তিনি আর এক মুহূর্ত দেরি করেননি।
এদিকে, দিল্লি
ক্লিনিকে জয়া এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। — "তোমার আমাকে পরীক্ষার নাটক কেন করতে হলো,
জয়া?" হাসান বিছানায় শুয়ে ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট স্বরে জয়াকে জিজ্ঞেস করলেন।
জয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে
বলল, তার চোখে এখন আর কোনো সংশয় নেই, কেবল ইস্পাত-কঠিন লজিক। — "ওটা ছিল তালিবের কাছে আমার ইনভাইটেশন। বাবার (পুলক সেন) ফাইল
ঘাঁটতে গিয়ে আমি জানতে পারি, বাবা নিজের নিরাপত্তা ও আমাকে সেফ রাখতে কিডনি
কামালকে ভাড়া করেছিলেন। কিন্তু কামালকে টপকে তালিবের লোকেরা আমার বাবাকে খুন
করেছে (দুর্ঘটনার পর গুম করেছে)। আমি জানতাম, হাসান, তুমি আমার জীবনের একমাত্র
সত্য। তোমাকে বাঁচাতে হলে তালিবের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গায় যেতে হবে। তাই তোমার
পরীক্ষার নাটক সাজিয়ে,তালিবের কিডন্যাপারদের হাতে তোমাকে তুলে দিলাম—যেন তুমি তাদের পাচার রুট ব্যবহার করে কামালকে ব্ল্যাকমেইল করতে
পারো।" — "আর কামাল?" হাসান জানতে চাইলেন। — "সে তো পুলকের লোক ছিল। সে তালিবের প্রতি প্রতিশোধ নিতে
চেয়েছিল। তোমার মতো একজন মেধাবী ব্ল্যাকমেইলারকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে সে ডাবল
এজেন্ট হয়ে তোমাকে এখানে এনেছে। তুমি এখানে আছো মানে, তালিবের সমস্ত চক্রের
প্রমাণ এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। অবশ্যই সে জন্য তাকে আমি পুরস্কৃতও করেছি।"
তালিব সাহেব যখন জয়ার
কেবিনে প্রবেশ করলেন, তার চোখে ছিল শীতল, হিংস্র দৃষ্টি। হাতে পিস্তল। তালিব
সাহেব: "তুমি আমার চক্রের ভেতর ঢুকেছ, জয়া! কিন্তু আমি তোমার বাবার খুনের
সিসিটিভি ফুটেজ (যেখানে পুলক সেন নিজেই পড়ে গিয়েছিলেন) এখনও প্রকাশ করিনি। তুমি
এখন আমার হাতে।"
জয়া হাসল। সেই হাসিটা
ভালোবাসার নয়, নিখাদ বুদ্ধির। — "আপনি ভুল করেছেন, টি.আর. সাহেব। সেই
সিসিটিভি ফুটেজে আরও একটি ছায়া ছিল—তৃতীয় ছায়া, আমার পালক পিতা পুলক সেনের খুনের
সময় উপস্থিত থাকা একমাত্র সাক্ষী। সেই ছায়াটি আপনি। আপনিই পুলক সেনের মৃত্যু
দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করেন এবং হাসানকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য তা রেখে দেন। কিন্তু
আমি আপনার সেই ব্ল্যাকমেইলের ফাইল হ্যাক করেছি।" জয়া তার ফোন তুলে প্লে করল
তালিব সাহেবের AI-কণ্ঠস্বর (Mirror Voice)-এর অডিও, যেখানে তিনি পুলক সেনের কিডনি
পাচারের নির্দেশ দিচ্ছেন।
— "আপনি আপনার ক্ষমতা দিয়ে বাবার লাশ
পাল্টেছেন, আমাকে ক্রিমিনাল বানিয়েছেন আর আওনার ফাঁদে পা দিয়ে রিনি ও আমাকেই
ক্রিমিনাল ভেবে পুরো দেশের সামনে আমাকে কালার করেছে," জয়া বলল, "কিন্তু
আমি জানতাম, আপনার সমস্ত লজিক চলে একটি কেন্দ্রীয় সার্ভার দিয়ে। আপনার সমস্ত
তথ্য, আপনার 'আশার আলো ক্লিনিক'-এর সমস্ত ক্লায়েন্ট লিস্ট, সমস্ত অবৈধ লেনদেন—আমি একটি টাইমার সেট করে হ্যাক করেছি। আপনি যদি এখন আমাকে বা
হাসানকে সামান্যতম আঘাত করেন, তবে সমস্ত তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাবলিক হয়ে
যাবে।"
তালিব সাহেব পিস্তল
শক্ত করে ধরলেন, কিন্তু হাত কেঁপে গেল। তার নিজস্ব ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা আজ
তার বিরুদ্ধেই দাঁড়াল।
ঠিক তখনই, হাসান
বিছানায় শুয়ে তার শেষ শক্তি দিয়ে বললেন, স্পষ্ট ও বিজয়ী স্বরে: — "মামা, বানানো ভুয়া পুলকের সেন ডামির ডেথ সার্টিফিকেট, তোমার
কিডনি পাচারের প্রমাণ—সব এখন সাদাব স্যারের হাতে। তুমি আমার
ভালোবাসাকে ব্যবহার করেছ, কিন্তু আমার বুদ্ধিকে নয়।" তিনি বেড সাইট টেবিলের
উপর রাখা মোবাইলের দিকে নির্দেশ করলেন জয়াকে। “আর এখন
যা হচ্ছে, সব ঢাকায় বসে বাংলাদেশ পুলিশ দেখছে।"
ঠিক এই মুহূর্তে ঢাকা ডিবি হেডকোয়ার্টার্স:
যখন তালিব রহমান
দিল্লি অভিমুখে রওনা দিয়েছেন , সাদাব ফারজানার চ্যানেল এর হেল্প নিয়ে ডিবি প্রধান
কে মাঝ রাতে ঘুম থেকে তুলে সমস্ত ঘটনা বর্ননা করেন। অনুরোধ করে দিল্লির সাথে
যোগাযোগ করার, ডিবি প্রধান পরথমে একটু ড্বিধান্বিত থাকেন কিন্তু সাদাবের সাথে
ফারজানাকে দেখে মত পাল্টান। সাদাব দ্রুত ডিবি প্রধানের দিকে তাকিয়ে বললেন:
"স্যার, আপনার সামনে লাইভ প্রমাণ! একজন এমপি পদপ্রার্থী, একজন আন্তর্জাতিক
অপরাধী। জয়ার হ্যাকিং এবং রিনির ডিক্রিপশন—সব মিলিয়ে এই মুহূর্তটিই সেরা। আপনার কূটনৈতিক
ক্ষমতা ব্যবহার করুন, ইন্টারপোল এবং দিল্লি পুলিশের সাথে জরুরি যোগাযোগ করিয়ে এই
ক্লিনিকটি ঘেরাও করার ব্যবস্থা করুন!" ইমার্জেন্সি নেটওয়্যারকে দিল্লি পুলিশ
কে জানাণ একজন পাচারকারি রুটের গড ফাদার এইমুহুর্তে দিল্লির একটি ক্লিনিকে আছে।
তিনি তাদের লাইভে ব্যাপার টি নিশ্চিত করে গ্রাফতারে জন্য অনুরোধ করেন। ফারজানা
জয়ার সাথে যোগাযোগ করে লাইভের ব্যাপার টা নিশ্চিত করে। ফারজানা তার ব্যক্তিগত
চেম্বার থেকে একটি সুরক্ষিত ভিডিও লিংক ব্যবহার করে জয়ার কেবিনের ভেতরের সমস্ত ঘটনা
লাইভ দেখছেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ডিবি প্রধান।
দিল্লির ক্লিনিকে
তালিব সাহেব তখনো
হতভম্ব। তিনি পিস্তল উঁচু করে ধরে আছেন, কিন্তু ফায়ার করতে পারছেন না। তিনি জয়াকে
ধমক দিয়ে পিস্তল নামাতে বললেন, "তুমি এসব নাটক বন্ধ করো!"
হাসান ক্ষীণ স্বরে
বললেন, "মামাকে সময় দাও, জয়া। কূটনৈতিক প্রক্রিয়া এত দ্রুত হয় না।"
জয়া বুঝতে পারল,
সাদাবকে সময় দিতে হবে। সে হাসিমুখে তালিব সাহেবের দিকে তাকিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে
দিল: "আপনি এখনো ভাবছেন এটা নাটক, টি.আর.? এই নিন, আপনার কেন্দ্রীয় সার্ভারের
'রুট এক্সেস পাসওয়ার্ড'। আপনি নিজে দেখুন, কতক্ষণ পর আপনার সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ছে।"
জয়া স্ক্রিনে একটি জটিল পাসওয়ার্ড দেখাল, যা দেখে তালিবের চোখ কপালে উঠল।
প্রায় দশ মিনিট কেটে
গেছে। তালিব সাহেব যখন সার্ভারের পাসওয়ার্ড নিয়ে মরিয়া হয়ে হাতড়াচ্ছেন, ঠিক
তখনই বাইরে দ্রুতগামী গাড়ির শব্দ শোনা গেল। ক্লিনিকে ঢোকার প্রধান পথটি ঘিরে ফেলল
পুলিশের গাড়ি।
তালিব সাহেব পিস্তলটি
হাতে তুলে নিতে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
কেবিনের দরজা ভেঙে
পড়ল। দিল্লি পুলিশের স্পেশাল অপারেশনস টিম কক্ষে প্রবেশ করল। একজন ঊর্ধ্বতন অফিসার
কমান্ড করলেন: "তালিব রহমান, আপনি অবৈধ কিডনি পাচার এবং হত্যায় অভিযুক্ত।
আপনি গ্রেফতার।"
তালিব সাহেবের হাত
থেকে পিস্তল মেঝেতে পড়ে গেল। তার রাজনৈতিক প্রভাব, তার সমস্ত ক্ষমতা—সবকিছু ভেঙে পড়ল।
গ্রেফতারের মুহূর্তে
জয়ার হাতে থাকা মোবাইলে রিনির ভিডিও কল আসল। স্ক্রিনে রিনির মুখ—শান্ত এবং দৃঢ়। রিনি (ভার্চুয়াল স্ক্রিনে): "বাবা, আমি রিনি।
'চূড়ান্ত যুক্তির রক্ষক' হিসেবে আমি তোমার লকার নম্বর ডিকোড করে আমিই সাদাব
স্যারকে দিয়েছি। তোমার মেয়ে হিসেবে আমি আজ তোমার সমস্ত লজিককে পরাজিত
করলাম।"
তালিব সাহেব চোখ বন্ধ
করলেন। তার পতন, তার মেয়ের হাতেই লেখা ছিল। কোনো কাকতাল ছিল না, ছিল কেবল নিয়তি।
তালিব সাহেবকে
গ্রেফতার করা হলো।
হাসানের সুস্থ হতে আরো
কিছুদিন লাগল। জয়া আর হাসান দিল্লীতে আরোকিছুদিন অপেক্ষায় থাকলো তাদের অনাগত
সন্তানের প্রতীক্ষায়। জয়া বুঝে গেছে নিয়তি কেউ বদলাতে পারেনা, সময় ঠিক জীবনকে
নিয়তির কাছে নিয়ে আসে। আর তার নিয়তি ছিল হাসানের সাথে বাঁধা।
তিন মাস পর: নতুন পথ ও
নিখুঁত দল
ঢাকায়, তিন মাস পর।
সাদাব খান তার অফিসে। তার ক্ষুরধার বুদ্ধিতে ধরা পড়েছে কিডনি পাচারকারী চক্র আর
তার বস এমপি পদপ্রার্থী রাজনীতিবিদ তালিব রহমান, সংক্ষেপে টি.আর.। পুরানো
ডেলিস্টার এর রিপোর্ট থেকে তিনি বের করেছিলেন—স্ত্রী
হত্যার দায়ে ১৫ বছর আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন আদম ব্যবসায়ী তালিব রহমান। ডেইলি
স্টারের রিপোর্টে তাকে দেখানো হয় টি.আর. নামে। তিনি পরে রাজনৈতিক পরিচয়ে মুক্তি
পান এবং তালিব রহমান থেকে হয়ে যান টি.আর.।
তিনি এখন সম্পূর্ণ
নতুন একটি এনক্রিপ্টেড ফাইল নিয়ে কাজ করছেন—'T.R. Network Traces'।
এমন সময় দরজায় টোকা
পড়ল। রিনি দাঁড়িয়ে। তার চোখে এখন আর কোনো দুর্বলতা নেই, বরং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি।
গায়ে সাদামাটা সালোয়ার কামিজ, কিন্তু আত্মবিশ্বাস ঝিলিক দিচ্ছে। সে মালয়েশিয়ার
অফার প্রত্যাখ্যান করেছে।
রিনি: "স্যার,
আমি একটি ফরেনসিক ডেটা অ্যানালিস্ট ফার্মে কাজ পেয়েছি। তালিব সাহেবের জামিনের
চেষ্টা চলছে। আমার কাজ হলো, তাঁর সমস্ত ডিজিটাল চিহ্ন মুছে ফেলা—যেন তিনি আর কোনোদিনও ফিরে না আসতে পারেন।"
সাদাব মুগ্ধ হলেন।
টেবিল থেকে কফি মগটা তুলে নিলেন। "তোমার সাহস আর যুক্তি অসামান্য, রিনি। তুমি
একজন ভালো ডিটেকটিভ হতে পারতে।"
রিনি সামান্য হাসল,
সেই হাসিতে ছিল চাপা অভিমান। রিনি: "আমি ডিটেকটিভ নই, স্যার। আমি ডাটা
এনালিস্ট। আমি জানি, আপনার সাসপেনশন সাময়িক। কিন্তু আমি এটাও জানি, একা একা এই
নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়।" রিনির চোখে চোখ রাখলেন সাদাব। সেই চোখে এখন আর
কোনো কৌতূহল নেই, আছে সমান মেধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তাদের সম্পর্কের রসায়ন যেন
কোনো সাধারণ আকর্ষণ নয়, বরং সমান বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্রিকোয়েন্সিতে চলার ছন্দ।
সাদাব: "তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে চাইছ?"
রিনি: "সাহায্য
নয়, স্যার। আপনার কাজে অংশগ্রহণ করতে চাই। আমি জানি, আপনি কোনোদিন পুরোপুরি অবসর
নেবেন না, আমিও না। এই শহরের প্রতিটি অসঙ্গতি, প্রতিটি কালো দিক—আমরা দু'জন একসঙ্গে তা ঠিক করতে পারি। আমার লজিক, আপনার অভিজ্ঞতা।
আমরা দুজন... আমরা একটা নিখুঁত দল।"
সাদাব কফি মগটা টেবিলে
রাখলেন। তিনি ধীরে ধীরে উঠে এসে রিনির দিকে হাত বাড়ালেন। সাদাব: "রিনি, তুমি
আমার দেখা সবচেয়ে বুদ্ধিমতী আর লজিক্যাল মানুষ। আমাদের পথটা কেবল সত্য খোঁজার, আর
হয়তো... সেটাই আমাদের নিয়তি।"
রিনি তার হাত সাদাবের
হাতে রাখল। তার চোখে এখন ভয় নেই, আছে নতুন জীবনের স্পষ্ট এক দৃষ্টি। রিনি:
"নিয়তি থাকুক বা না থাকুক, স্যার। আমাদের যাত্রা এবার শুরু করা যাক।

Comments
Post a Comment