ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১২ ও ১৩
দ্বাদশ
পর্বঃ
ডিবির
এএসপি সাদাব মোহাম্মদের কাছে কেসটা খুবই জটিল আর আকর্ষণীয় লাগছে। ডিবি পুলিশের এই
তরুণ অফিসার কেসটা ভিন্ন আঙ্গিক থেকে সূত্র খোঁজার চেষ্টা করছেন। তার অতীব আগ্রহের
আরেকটা কারণ— হাসান ছেলেটি তার ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র।
সাদাব জয়ার ফোন কলগুলো ট্র্যাক করতে গিয়ে দেখলেন, হাসানের নিখোঁজ হবার কিছুক্ষণ
আগেও তার একটা নাম্বারে প্রায় ৩৫ মিনিট কথা হয়েছে, আর সেই নম্বরটি অতি
আশ্চর্যজনকভাবে হাসানের এক্স গার্লফ্রেন্ড কান্তার। সাদাব দ্রুত কান্তাকে ট্রেস
করার চেষ্টা করতে লাগলেন। কাকতালীয়ভাবে আজ সন্ধ্যায়ই কান্তার ফ্লাইট। সাদাব তার
সর্বোচ্চ ক্ষমতা আর স্পেশাল কিছু অনুমতির মাধ্যমে এয়ারপোর্ট থেকেই কান্তাকে আটক
করলেন। কান্তাকে ইমিগ্রেশন থেকে বের করে এনে চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের রুমে জিজ্ঞাসাবাদ
শুরু করলেন। কান্তা আকাশ থেকে পড়লো যেন— “আমার সাথে অবশ্যই জয়ার সেদিন কোনো কথা হয়নি।”
“কিন্তু আপনার নাম্বারে জয়ার সাথে আপনার কথা
হয়েছে, এই দেখুন আপনার কল লিস্ট,” বলে একটা লম্বা স্লিপের মতো কাগজ এগিয়ে দিল
সাদাব। কান্তা বিরক্তি নিয়ে কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল— “এই নাম্বার আমি ইউজ করিনি কোনোদিন। আমার নামে
কেনা হলেও এটা ব্যবহার করত হাসান, সেই স্কুল লাইফ থেকে।”
এবার
মুখ পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেলো। মানে জয়ার সাথে হাসানের অন্য কোনো সিম দিয়ে কথা
হয়েছে, ঠিক যে সময়ে হাসান নিখোঁজ হয়েছে বলে জানা যায়। এই মেয়ে জয়া অতীব
ধুরন্ধর। তাকে যে কোনো মূল্যে ধরতেই হবে।
অনেক
তদবিরের পর জামিন মিলেছে রিনির। যখন ময়নাতদন্তে উঠে এসেছে লাশটি হাসানের নয়,
আদালত রিনিকে শর্ত সাপেক্ষে জামিন দিল। জামিনে বেরিয়ে রিনি দেখা করলো সাদাবের
সাথে। রিনির মুখে সব কথা শুনে সাদাবের মাথায় নতুন এক দুশ্চিন্তা ভর করলো— হাসানের বাসায় পাওয়া লাশ যদি পূলক সেনের হয়ে থাকে, তবে আগে
পাওয়া লাশটা কার? আর কেনই বা সে লাশটা পূলক সেনের বলে চালানোর চেষ্টা করা হলো?
ময়নাতদন্তে পূলক সেনের ডিএনএ টেস্ট করানো হয়নি? অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে সাদাব
ভাবছেন। কেন যেন সাদাবের মনে হচ্ছে, হাসানের বাসায় কোনো একটা সূত্র অবশ্যই পাওয়া
যাবে। সে আরেকবার হাসানের বাসায় যেতে চায়। নিজেই তদন্ত করে দেখতে চায় নিজের
সন্তুষ্টির জন্য।
রিনি
ইদানীং বাসায় খুব বিমর্ষ হয়ে পড়ে থাকে। সে মোটামুটি নিশ্চিত যে হাসান আর
দুনিয়াতে নেই। হাসানের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল সত্যি, কিন্তু ছোটবেলা থেকে সে
হাসানের অনেক স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছে। রিনির মাঝে মাঝে নিজেকে দায়ী মনে হয়। তার
সাথে বিয়ে নিয়ে হাসানকে চাপ দেওয়া না হলে হয়তো হাসান এভাবে হারিয়ে যেত না।
রিনির ভাবনায় ছেদ পড়ে ফোনের শব্দে, কম্পন হচ্ছে। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে
সে মোবাইল অপারেটর কোম্পানির বার্তা দেখলো। বার্তাটা ডিলিট করতেই প্রচ্ছদ চিত্রে
হাসানের হাসিমুখের একটা ছবি ভেসে ওঠে, ফিরোজা রঙের পোলো শার্ট পরা সুদর্শন এক
যুবকের প্রতিমূর্তি। রিনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
হঠাৎ
চমকে একটা কথা মনে পড়ে যায়, সে ফোনের ইতিহাস খোঁজা শুরু করে। হাসান নিখোঁজ হবার
দিন একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে তার কাছে কয়েকবার কল এসেছিল। পরে অনেকবার কল
দিয়েও নাম্বারটি আর খোলা পায়নি সে। আজ কী ভেবে যেন নাম্বারটি আবার ডায়াল করলো
রিনি। নাহ, বন্ধ। রিনি সাদাবের নাম্বারে ডায়াল করলো। ফোনের ব্যাপারটা সাদাবকে
জানালো রিনি। সাদাব নাম্বারটি শুনে ভ্রু কুঁচকালেন। এটিই সেই নাম্বার যে নাম্বারে
জয়ার ফোন রেকর্ডে পাওয়া গিয়েছিল।
সাদাবের
কাছে এখন অনেকগুলো সত্য আর তথ্য, সে বসে আছে তার চেয়ারে, এক এক করে মেলাচ্ছেন।
কিছুক্ষণ আগে হাসানের বাসা থেকে পাওয়া লাশটা পূলক সেনের বলে শনাক্ত করা গেছে।
পূলক সেনের ব্যবহৃত জামাকাপড় থেকে, এমনকি একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৃত্যশিল্পীও
পূলক সেনের ব্যবহৃত ইনসুলিন সিরিঞ্জ দিয়ে গিয়েছিলেন ডিএনএ ম্যাচ করতে। দেশসেরা
এই নৃত্যশিল্পী অবশ্য গোপনে সাদাবকে জানিয়ে গেছেন পূলক সেনের সাথে তার আন্তরিক
সম্পর্কের কথা, গত কয়েক বছর ধরেই একসাথে বাস করছিলেন তারা। এই তথ্যটির কোনো একটি
যোগসূত্র আছে কি হত্যাকাণ্ডের সাথে! ভাবতে লাগলেন সাদাব। নৃত্যশিল্পী আফসানা মৌরি
অবশ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন, হাসান একবার পূলক সেনকে তার বাসায়
আবিষ্কার করে ফেলেছিল। সে রাতে পূলক সেন হাসানকে কল দিয়ে নাকি অনেকবার চাপ
দিয়েছিলেন এই তথ্য কোনোভাবেই যেন হাসান কাউকে না জানায়। হাসানও নাকি বলেছিল,
কখনো কেউ জানবে না। আফসানা মৌরির তথ্য অনুযায়ী জয়া পূলক সেনের পালিতা কন্যা,
যদিও এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ তিনি দিতে পারবেন না বলেই জানিয়েছেন। পূলক সেনের
স্ত্রীর কিছু মেডিক্যাল অবস্থার কারণে সন্তান ধারণে অক্ষম ছিলেন। জন্মের সময়
জয়ার মা মারা গেলে, পূলক সেনের স্ত্রী জয়াকে তার বাবার কাছ থেকে নিয়ে আসেন।
জয়ার জন্মদাতা বাবা ছিলেন পূলক সেনের এক বাল্য বন্ধু।
সাদাব
হাসানের ফ্ল্যাটের আইপি টিভির সফটওয়্যারটা নিজের মোবাইলে ইন্সটল করলো। কিউআর কোড
স্ক্যান করে পুরোনো ইতিহাস বের করার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলো একদম ফাঁকা। একটা
জিমেইল অ্যাড্রেস দিয়ে লগইন করা হয়েছিল: joysan53@gmail.com। সাদাব বুঝলো জয়া
আর হাসানের নাম মিলিয়ে রাখা একটা ইমেইল অ্যাড্রেস। সাদাব তার বেস্ট ফ্রেন্ড
রাফসান ফারুকীকে ফোন দিলেন। ভীষণ পাগলাটে রাফসান একজন এথিক্যাল হ্যাকার। ইমেইল
অ্যাড্রেসটার আদ্যোপান্ত বের করতে বললেন সাদাব, খুব দ্রুত। হাসানের বাসা থেকে কোনো
খুনের অস্ত্র পাওয়া যায়নি। উদ্ধার হওয়া লাশের মৃত্যুর কারণের তেমন কোনো
অস্ত্রের উল্লেখ না, বরং কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কথাই বলা হয়েছে। আর কর্তিত
আঙুলটা কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিখুঁতভাবে কাটা হয়েছে...। হঠাৎ একটা সম্ভাবনা
উঁকি দিল সাদাবের মনে, সে হাসানের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া জিনিসগুলো এক এক করে
মিলিয়ে দেখতে লাগলেন।
জয়া
ওরফে নন্দিতা দাঁড়িয়ে আছে ভারতের এক ক্লিনিকে। আগামী কয়েক মাস সন্তান হবার আগ
পর্যন্ত সে এখানেই থাকবে— সিদ্ধান্ত আর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। জয়া তার
মাকে পাঠিয়ে দিয়েছে, মায়ের এক দাদার বাড়িতে, অবশ্যই প্রচুর টাকাও দিয়েছে
সাথে। জয়া কথা বলছিল ডাঃ বিজয় রাও-এর সাথে— “আমরা যদিও কাউকে এতদিন এখানে রাখি না, কিন্তু
আপনার কেসটা বিশেষ বিবেচনায় আমরা আপনাকে ডেলিভারি পর্যন্ত এখানে রাখার সিদ্ধান্ত
নিয়েছি। তাছাড়া আপনার স্বামীর ব্যাপারটিও আমাদের বিবেচনা করতে হচ্ছে। ওনার
মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতা আসা পর্যন্ত আমরা আপনাকে অসহায় না রেখে ওনার কাছাকাছি
রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“থ্যাংক ইউ ডাঃ রাও। আপনি আমার অনেক উপকার করলেন।
আমি আপনাদের ক্লিনিকের জন্য সামান্য কিছু অনুদানের ব্যবস্থা করেছি। এখন থেকে প্রতি
মাসে একজন অসুস্থ এতিম সন্তানের চিকিৎসা খরচ বহন করবে পূলক সেন ফাউন্ডেশন।” হেসে বলল জয়া।
‘দ্যাটস
রিয়েলি গ্রেট।’
“আপনি
তাহলে আজই ভর্তি হয়ে যান। তার আগে কি আপনি আপনার স্বামীর সাথে দেখা করতে চান?”
“উম...
আসলে না, আমি চাইছি ও আরেকটু সেরে উঠুক, তারপর ওর মুখোমুখি হই। বুঝতেই পারছেন
বিরাট একটা মানসিক আঘাতের মাঝে আছে ও।”
‘ঠিক
আছে, আপনি রেস্ট করুন,’ বলে কলিং বেলে একজন পরিচর্যা কর্মীকে ডেকে
জয়ার কেবিন দেখিয়ে দিতে বললেন রাও।
রাফসান
ফারুকী খুবই কাজের একজন ছেলে। ঐ মেইলিং অ্যাড্রেসের পাসওয়ার্ড না শুধু, এর সাথে
কানেক্টেড ফেসবুক সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোর খুটিনাটি তথ্য বের
করে ফেলেছে। সাদাব মেইলে লগইন করলো। এরপর রাফসানের পরামর্শে প্রথমেই সংযুক্ত ফোন
নাম্বারটা বদলে ফেলল। খুব সম্প্রতি যদিও ফোন নাম্বার বদলে ভারতের একটা ফোন নাম্বার
দেওয়া হয়েছিল এখানে, নাম্বারটা টুকে নিল সাদাব। ফোনে এসআই আবিদকে দায়িত্ব দিল
এই ফোন নাম্বারের বিস্তারিত যত সম্ভব দ্রুত বের করতে। এর পাশাপাশি আরও কিছু...।
এরপর
এক এক করে ইনবক্সে থাকা ইতিহাসগুলো দেখতে থাকলেন। ভ্রুর ভাঁজ আরও কুঁচকে যাচ্ছে
সাদাবের। এক সময় নিজের অজান্তেই বলে উঠলো— “উফফ, এই মেয়ে, মেয়ে না ডাইনি?”
সাদাব
বুঝতে পারেন যে কোনো মূল্যেই জয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে, নয়তো এই রহস্যের জট
খুলবে না, আর জয়া আরও অপরাধ করতেই থাকবে। সাদাবের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে।
তার জুনিয়রদের ব্যর্থতায়, এত এত সূত্র মিস করে গেছে। তারা আরেকটু সতর্ক হলে
হাসানকে অনেক আগেই উদ্ধার করা যেত। এখন হাসান আদৌ বেঁচে আছে কিনা কে জানে।
সিনিয়র
অফিসারকে ফোন করলেন সাদাব। জয়ার পুরো প্ল্যানটা এখন তার সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
সাদাবের সিনিয়রের রুমে বসে একের পর এক সিসিটিভি ফুটেজ (যেগুলো সে জোগাড় করেছে
তার পুরনো বন্ধু ডিবির আইটি ইনচার্জ ফারজানার কাছ থেকে, আর একটা খুব বিশেষ হাসানের
বাসার ভিডিও— সেটা খুব বিশেষ একটা উপায়ে, যার গল্প পরে
আসছি) দেখিয়ে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন সাদাব। কিন্তু সেদিন
ঘটনা মোড় নেয় বছরের সবচেয়ে বড় আলোচিত ঘটনায় যা কেবল সংবাদ মাধ্যম না, সোশ্যাল
মিডিয়ার প্রতিটা হ্যান্ডেল ভরে যায়...।
ত্রয়োদশ পর্ব
যেদিন পূলক সেন মারা
গেলেন সেদিনের কথা—
হাসানের প্রেমের
ব্যাপারটা জানাজানি হবার পর হাসানের বিরুদ্ধে ব্যাপক রাগান্বিত হয়ে ওঠেন পূলক সেন।
এদিকে নিজের গোপন অভিসার হাসানের সামনে প্রকাশ পাওয়ায়, হাসানকে নিজ রাস্তা থেকে
সরিয়ে দেওয়াই সবচেয়ে সহজ হবে বুঝতে পারেন পূলক সেন। তিনি ভেবেছিলেন হাসানকে
কিডন্যাপ করিয়ে কিডনি পাচারকারী র্যাকেটদের কাছে তুলে দেবেন। কিন্তু হাসানকে
জয়া অন্তরীণ অবস্থায় লুকিয়ে রেখেছিল কোথাও, যেটার ঠিকানা পূলক সেন পাচ্ছিলেন
না। এর মাঝে জয়ার প্রেগন্যান্সির খবরে পূলক সেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
কিডনি কামালের দলের লোকের মাধ্যমে যখন হাসান-জয়ার সংসার আর এই ভাড়া ফ্ল্যাটের
খবর সে পায়, কোনো কিছু না ভেবেই সে হাসানের ফ্ল্যাটে চলে আসে। সেদিন ছিল হাসানের
পরীক্ষা। ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষা বলে জয়া কোনো অবস্থাতেই হাসানকে পরীক্ষা দিতে না
করে। হাসানকে বলে যে হাসান পরীক্ষা দিতে গেলে হয়তো তাকে কিডন্যাপ করবে পূলক সেনের
লোক। হাসানের বদলে জয়ার প্ল্যান মোতাবেক হাসানের এক জুনিয়র ছেলেকে হলে পাঠায়
জয়া। পূলক সেনের কাছে যখন জয়ার লেখা চিঠি আসে, পূলক সেন হাসানের বাড়িতে যান
জয়াকে ফিরিয়ে আনতে।
পূলক সেন হাসানের
বাসায় এসেছিলেন খুব সকালে, তখনও হাসান ঘুমে। দরজার সজোরে ধাক্কায় ঘুম ভেঙেছিল
তার। চোখ কচলিয়ে গেট খুলে চমকে যাওয়া হাসানের মুখ, সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট
হাসানের চমকে যাওয়া মুখের ছবি। এখানে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হাসানকে প্রায় ঠেলে
ভেতরে ঢুকলেন পূলক সেন। উচ্চস্বরে কথা-কাটাকাটির একমাত্র ইস্যু—হাসান-জয়ার অবৈধ সম্পর্ক। প্রথম দিকে হাসান খুব শান্তভাবে সামাল
দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ক্রমান্বয়ে পূলক সেনের আগ্রাসী মনোভাব হাসানের
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেয়। কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে হাসান পূলক সেনের গোপন
সম্পর্কের ইঙ্গিত করলে, পূলক সেন হাতের কাছে থাকা ভারী পেপারওয়েট ছুঁড়ে মারেন
হাসানের দিকে। হাসান তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে যায়। তখন হাসানও চিৎকার করে
বলতে থাকে— “আপনিই বা জয়ার জন্য এত মায়া দেখাচ্ছেন কেন,
আপনি কি জয়ার জন্মদাতা বাবা নাকি! আমি সব জানি, আপনার সব খবর আমি বের করেছি।
জয়াকে কখনো কিছু বলিনি শুধুমাত্র জয়া কষ্ট পাবে বলে।”
পূলক সেন হিতাহিত
জ্ঞান হারিয়ে কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করে। ঠিক সেই সময়ে হাসানের ঘরে ঢোকে
জয়া, বাইরে থেকে শব্দ পেয়ে প্রায় দৌড়ে ঢোকে জয়া। ঢুকে দেখে ফ্লোরে বসে আছে
হাসান, আর পূলক সেন পিস্তল তাক করে রেখেছে তার দিকে। জয়া রুমে প্রবেশ করেই চিৎকার
করে ওঠে। হাসান লাফিয়ে উঠে জয়াকে টান দেয় তার সামনে। পূলক সেন— “ইউ সান অব এ বিচ, আমার মেয়েকে আমার বিরুদ্ধে
লাগাচ্ছিস!”
জয়া বলে ওঠে— “কী বলছ বাবা, তুমি শান্ত হও,” বলে পূলক সেনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। সেই মুহূর্তে
হাসান মুখ ফসকে বলে ফেলল— “কে তোমার বাবা জয়া! পূলক সেন তোমার পালক বাবা,
তুমি তার ঔরসজাত সন্তান নও।” অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জয়া। হাসান
চিৎকার করে বলতে থাকে— “জয়া, তুমি জানো না, এই পূলক সেন কত বড় বাটপার!
উনি রেগুলার থাকেন উনার রক্ষিতার কাছে, এখন আমাকে মারতে আসছে। জয়া, উনাকে চলে
যেতে বলো।”
জয়া অবিশ্বাস্য
দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো বাবার দিকে। “বাবা, হাসান যা বলছে তা কি সত্যি! আমি তোমার
সন্তান না!”
এবার আর নিজেকে ধরে
রাখতে পারলেন না পূলক সেন, এগিয়ে যেতে থাকেন আগ্রাসীভাবে। স্ট্যান্ড ফ্যানের
বৈদ্যুতিক কেবলে পা জড়িয়ে পড়ে যান পূলক সেন। ভারী স্ট্যান্ড ফ্যানটি গড়িয়ে
পড়ে তার পায়ের উপরে, স্ট্যান্ডের ফ্যানের কাভারটা খুলে যায়। ঐ সময় হাত দিয়ে
ব্যালেন্স সামলাতে গিয়ে হাতের আঙুল কাটা পড়ে পূলক সেনের।
এরমধ্যে সে আরও
উত্তেজিত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দ্রুত তাকে বিছানায় শোয়ানো হয়। দৌড়ে আসে
জয়া, চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে হাত-পা ডলে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে সে। হাসানকেও
উত্তেজিত ভঙ্গিতে পূলক সেনের বুকে দুই হাতে চাপ দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে
দেখা যায় ভিডিওতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই
হাসান এবং জয়া বুঝে যায়, এই পৃথিবীর মায়া ছেড়েছেন পূলক সেন। এবার হাসানকে
এককভাবে দায়ী করতে দেখা যায় জয়াকে। হাসান বলতে থাকে অবশ্যই সে তার বাবাকে খুন
করেনি। কিন্তু জয়া একমনে বলতেই থাকে হাসানই তার বাবার খুনি। হাসান এই পর্যায়ে
জয়াকে বলতে থাকে— “জয়া, একটু বোঝার চেষ্টা করো, উনি নিজে এসে
আমাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিলেন। তুমি আসতে দেরি করলে হয়তো গুলিই চালিয়ে বসতেন। উনি
নিজের রাগ দমন না করতে পেরে আমাকে মারতে গিয়ে সম্ভবত কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা
যান। তুমি উনার মৃত্যুর জন্য শুধু শুধু আমাকে দায়ী করো না। বরং এখন শক্ত হও,
কীভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারি। পুলিশের ঝামেলা হতে পারে। আর শোনো, তোমাকে
কষ্ট দেওয়ার জন্য না, উনি আসলেই তোমার জন্মদাতা পিতা নন।”
জয়া চোখের পানি মুছে
বলল— “হাসান, উনি আমার জন্মদাতা না হলেও উনি আমার
বাবা। আজকের আগ পর্যন্ত আমি একবারের জন্যও বুঝিনি উনি আমার বাবা নন। আমি চাওয়ার
আগেই আমার বাবা আমাকে সব দিয়েছেন। ইদানীং বাবার সাথে যা কিছু মনোমালিন্য হচ্ছে
সব-ই তোমাকে নিয়ে, নয়তো কোনোদিনও আমার বাবা আমার সাথে উঁচু গলাতেও কথা বলেননি।
আজ তোমাকে ভালোবাসতে গিয়ে আমার বাবাকে আমি হারিয়ে ফেললাম।”
‘জয়া, আমরা আমাদের ভাগ্যের হাতের শিকার। আজ এই
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য তুমি বা আমি কি দায়ী?” হাসান
বলল।
জয়া বলল— “এই লাশ আমাদের অবশ্যই গুম করতে হবে, কাউকেই
জানানো যাবে না। এরপর অন্য কিছু চিন্তা করছি।” জয়া
যখন এসব বলছিল, তখনই ফোন বেজে উঠল পূলক সেনের মোবাইলে। ফোনটা ধরে স্পিকারে দেয়
জয়া, কিন্তু 'হ্যালো' বলার আগেই এক অপরিচিত কণ্ঠ— “স্যার, কখন যাব ভার্সিটির ঐ ছেলেটাকে কিডন্যাপ করতে! আমাদের এইখানে
এমনিতেই একটা গোলমাল লেগে গেছে, আমাদের ছেলেরা ভুল করে নিজেরা মারামারি করতে গিয়ে
এক বুড়োকে ক্রসফায়ার করে ফেলছে, এখন ঐটাকে নিয়ে ঝামেলায় আছি। ভাবতেছি আবার ঐ
ছেলেটাকে কিডন্যাপ করতে গিয়ে নতুন কোনো গোলমাল না বাঁধে!”
ভীষণ আতঙ্কে জয়ার হাত
থেকে ফোনটা প্রায় পড়ে যায়। দ্রুত ফোনটা তুলে নেয় হাসান এবং তৎক্ষণাৎ সংযোগটি
বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফোনের স্ক্রিনে 'কামাল' নামটি জ্বলজ্বল করছে।
হাসান
উত্তেজিত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “জয়া, আমার মাথায় হঠাৎই একটা প্ল্যান আসছে।
আমাদের হাতে সময় নেই। এই প্ল্যানটা হয়তো আমাদের বাঁচিয়ে দেবে।” হাসান দ্রুত ফোনের বার্তা
(টেক্সট) অপশনে গিয়ে লিখল:
"যে
বুড়োকে মারছো, তাকে দ্রুত সরাও। আর ভার্সিটির ছেলেটা লাগবে না আজ। আমি একজনকে
পাঠাচ্ছি—আমার জামাকাপড়, আংটি আর ফোন নিয়ে গ্রিন রোডের
মোড়ে দেখা করো। ঐ লাশের মুখে এমনভাবে আঘাত করো যেন চেনা না যায়। কাজ শেষ হলে পরে কথা হবে।"
মেসেজটি
পাঠিয়ে জয়ার দিকে তাকাল হাসান। “জয়া, তুমি কি বুঝতে পারছো? ওরা একটা অচেনা লাশ
নিয়ে ঝামেলায় আছে। আমরা পূলক সেনের লাশকে সেই লাশের সাথে বদলে দেব। তারপর ঘোষণা
করব আমি নিখোঁজ।”
জয়া
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে হাসানের দিকে তাকায়, “আমার বাবার লাশ বদলে দেবে তুমি! তুমি একজন
অত্যন্ত অমানুষ!”
“তুমি ভুল বুঝতেছো জয়া, দেখো তুমি নিজেই দেখেছো
কাকা মানে তোমার বাবা আমাকে মারতে এসে নিজেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, সেখানে কি
আমার দায় ছিল! আর আমি তো তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমার সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই।
উনি যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন, সেটা পুলিশের কাছে আমরা প্রমাণ করতে পারবো না।
এখন তুমি আমাকে হেল্প না করলে আমি আর তুমি দু'জনেই ফাঁসবো।”
চোখ
মুছে জয়া। হাসানকে বড্ড অচেনা লাগছে তার, কিন্তু হাসানের তথ্য যদি সত্যি হয়, তবে
সে আসলেই কি পূলক সেনের পালিতা সন্তান!
জয়া
ফিসফিস করে বলে— বারবার একই কথা বলতে থাকে, “এটা দুর্ঘটনা, তাই না হাসান? তুমি তাকে মারোনি, তাই না?”
হাসান
এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় জয়ার কপালে। উত্তর দেয়, “না।” হঠাৎ ভিডিওতে দেখা যায়, জয়া ড্রয়ারে কিছু
একটা খুঁজছে। কিছুক্ষণ পর খুঁজে পায় একটা কালো স্কচটেপ। জানালার পর্দা টেনে বাইরে
তাকায়।
হাসানের
কথায় জয়া দ্রুতই তার বাবার লাশের কাপড় বদল করে। এরপর হাসান পূলক সেনের
জামাকাপড়, আংটি সব নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। জয়াকেও বলে এখান থেকে যত দ্রুত
সম্ভব চলে যেতে। হাসান জানায়, সে নিজেও কিছুদিন আত্মগোপনে থাকবে, আর জয়া যেন
হাসান যে হারিয়ে গেছে সেটা সবাইকে জানায়।
পূলক সেনের লাশকে খুব
ভালো করে কম্বলে মুড়িয়ে ফেলা হয়। তা আলমারিতে বড় এক পলিথিনে মুড়ে আলমারিটাকে
সিল করে রাখা হয়। বেরিয়ে যায় হাসান এবং জয়া। কোনো বিচিত্র কারণে যে পেনড্রাইভে
এই ভিডিওটা পাওয়া গিয়েছে, সেটিতে আর কোনো ফুটেজ নেই।
ভিডিও ফুটেজে এইটুকু
দেখার পর সাদাব তার সিনিয়র অফিসারকে জানায়, “স্যার,
কোনো কারণে পূলক সেনের সন্দেহজনক যে লাশটা আগে ইউনিভার্সিটি এলাকায় পাওয়া
গিয়েছিল, সেটার ময়নাতদন্তে কোনো না কোনো প্রভাব খাটানো হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো— জয়া এবং হাসানকে পেছন থেকে কেউ একজন হেল্প করেছে, সম্ভবত বড় কেউ।
এই কেউটা কে, সেটা বের করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ স্যার।”
সাদাবের সিনিয়র
জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু সাদাব, এই ভিডিও তুমি কোথায় পেলে?” সাদাব মুচকি হাসলো, “স্যার, সে এক লম্বা কাহিনী। তবে আমার মনে হয়
ফুটেজটা কেউ আমাকে দিতে চেয়েছে, তাই পেয়েছি। তবে এই কেউটা সম্ভবত জয়া সেন
নিজেই।”
সিসিটিভি ফুটেজ খুঁজে
পাওয়ার গল্প (রিনির জামিনের পরের রাত)
রাত
তখন ঢাকা শহরে থমকে আছে। রাস্তায় কেবল বৃষ্টির পরে জমে থাকা পানির শব্দ।
সাদাব
গোপনে ঢুকেছেন জয়ার ফ্ল্যাটে—চাবি সে সংগ্রহ করেছে অফিসের পুরনো
কনফিডেনশিয়াল সার্চ ওয়ারেন্ট দিয়ে। তার দৃঢ় ধারণা, জয়ার ফ্ল্যাটে কিছু না
কিছু সূত্র অবশ্যই মিলবে—তা সে পূলক সেনের মৃত্যুর হোক কিংবা হাসানের
নিখোঁজ হওয়ার।
ড্রয়িংরুমে
দাঁড়িয়ে আলো জ্বালাতেই চোখে পড়ল বনেদি আর আড়ম্বরতা। ফার্নিচারগুলো প্লাস্টিক
দিয়ে মোড়া। সাদাব পা বাড়ালো বাঁ পাশের দুটি রুমের প্রথমটিতে—একদম ছবির মতো সাজানো বেডরুম। দরজার নব ঘুরিয়ে ঢুকে লাইট জ্বালালো
সাদাব। খাটের পেছনের দেয়ালে পূলক সেন ও তার স্ত্রীর অল্পবয়সী হাস্যোজ্জ্বল ছবি।
আলমারি
তালাবদ্ধ। সাদাব তার মাস্টার-কি দিয়ে খোলার চেষ্টা করল—খুলেও গেল। খুব অবাক হলো, এমন আধুনিক বাসায় এমন পুরনো লকের আলমারি!
ভেতরে একদম ফাঁকা—দেখে মনে হলো কখনও কেউ ব্যবহারই করেনি।
পাশের
বেডরুমে ঢুকল সাদাব। এই রুমটি খোলাই ছিল। তার মনে হলো যেন এই ঘরটা তার জন্যই রেখে
দেওয়া। বাতাসে পুরোনো মেয়েলি পারফিউমের গন্ধ। টেবিলে ছড়িয়ে আছে অর্ধেক খোলা
বই, আর দেয়ালে ঝুলছে জয়া–কান্তা–হাসানের স্কুলের ছবি। টেবিলের ড্রয়ার,
জামাকাপড় রাখার আলমারি—সব খুঁজে দেখছেন সাদাব। তার হৃদস্পন্দন যেন
নিজের কানে শুনতে পাচ্ছেন। সবকিছুই যেন থেমে আছে।
ধীরে
ধীরে ঘরের ভেতর হাঁটছিলেন সে; চোখ তার প্রশিক্ষিত—কোনো
কোণে অস্বাভাবিক চিহ্ন খুঁজছে। তারহীন টেবিল, ছেঁড়া কভার, আর পুরোনো এক ল্যাপটপের
ধুলো-মাখা স্ক্রিন—সব যেন একসাথে কোনো গল্প বলছে। কী গল্প, ঠিক
বুঝতে পারছেন না সাদাব, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু যেন তাকে বলতে চায়।
ঠিক
তখনই ব্যালকনিতে নড়াচড়া। ভীষণ সতর্ক সাদাব কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবারে হাত দিয়ে
আস্তে এগোলেন। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল—রিনি।
ভীষণ
অবাক হলো সাদাব। এই মফস্বলের অল্পবয়সী মেয়ে এই ফ্ল্যাটে ঢুকল কীভাবে? এত সাহস সে
পেলই বা কোথায়?
সে
একা এসেছে, পায়ের শব্দ পর্যন্ত লুকিয়ে। চোখে উদ্বেগ, হাতে ছোট টর্চ।
সাদাবকে
দেখে ভয় পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে, তবু মনে হলো—সে কিছু জানে, কিন্তু বলতে ভয় পাচ্ছে।
রিনির
চোখ বরাবর টর্চ ফেললেন সাদাব। তীব্র আলো পড়তেই দেখা গেল—রুপালি রঙের একটা ছোট পেয়ারিং ডঙ্গল/সিম স্লিভ রিনির হাতে কাঁপছে।
রিনি সেটার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে—চোখে ভয়, কিন্তু একধরনের দৃঢ়তাও আছে।
ঠিক
তখনই সাদাব এগিয়ে এলেন। রিনি চমকে উঠল।
সাদাব: “তুমি এখানে একা কেন, রিনি?”
রিনি: “আপনিই বা এখানে কেন?”
সাদাব: “আমি অফিসিয়াল সার্চে এসেছি।”
রিনি: “আর আমি ব্যক্তিগত... কিছু খুঁজছিলাম।”
দুজনেই
একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল—যেন দুজনেই জানে, তাদের গন্তব্য এক, কিন্তু
উদ্দেশ্য ভিন্ন। সাদাব ভয় দেখানোর জন্য বললেন, “তোমাকে
আমি গ্রেপ্তার করতে পারি জানো? দাও দেখি তোমার হাতে যা আছে।”
ভীতসন্ত্রস্ত
রিনি এগিয়ে দিল ছোট ডঙ্গলটা। সাদাব ফ্ল্যাশলাইট ফেলতেই ছোট্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠল—
“Device Active. Live Ping: Hasan’s Apartment — Fuller Road / Palashi belt.”
রিনি
হাঁপ ছাড়ল। “মানে হাসানের বাসা ট্র্যাক করা হচ্ছিল?”
সাদাব
মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। কেউ হাসানের প্রতিটি গতিবিধি নজরে
রাখছিল।”
রিনি:
“জয়া না পূলক?”
সাদাব:
“এখনও নিশ্চিত না। ডিভাইসটা পূলক সেনের স্টাডি
থেকে উদ্ধার হয়েছিল, কিন্তু লগে দেখা যাচ্ছে হাসানের বাসা নিয়মিত পিং পাচ্ছিল।
এই ছোট সিম-স্লিভটা সম্ভবত এখান থেকেই একসময় পেয়ার করা হয়েছিল।”
সাদাব
জয়ার পরিত্যক্ত ল্যাপটপটা খুললেন। অবাক হলেন—জয়ার
মতো ধুরন্ধর প্রকৃতির একজন মেয়ে কেন ল্যাপটপ ফেলে গেল? নাকি ইচ্ছা করেই রেখে
গেছে? সে কি জানত পুলিশ আসবে, এবং কিছু অনিমেষে জানাতে চাইছিল? ভাবতে ভাবতেই সে
ডঙ্গলটি ল্যাপটপে কানেক্ট করলেন।
ডেস্কটপে বহু ফোল্ডার—মিউজিক, ফটো, তবে একটিতেই চোখ আটকে গেল: Hospital.
সাদাব ফোল্ডারটি খুললেন। তার ভেতরে ফাইলের নাম—Temp Log / Delhi Node.
ভেতরে একটিমাত্র ডকুমেন্ট—St. Mary’s Clinic, Room 412, G-Block, New Delhi
Hospital Complex.
রিনির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। “দিল্লি? ওখানে কেন হাসপাতালের ঠিকানা থাকবে?”
সাদাব ঠান্ডা গলায় বললেন, “কারণ এই ট্র্যাকিং শুধু হাসানের জন্য না, আরও কেউ ছিল। হয়তো
হাসানের সঙ্গে দিল্লির কোনো যোগসূত্র ছিল... কিংবা জয়া এখন ওখানেই আছে।”
সাদাবের মনে আরেকটা সন্দেহ উঁকি দিল—তবে কি জয়া কোনোভাবে তার অবস্থান জানাতে চাইছিল?
সম্ভাবনাটি
আপাতত নিজের ভেতরেই চেপে গেলেন। রিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে বজ্রপাত;
জানালার কাঁচ কাঁপছে। তার চোখে এখন ভয় নয়, দৃঢ়তা। “যেই এই ডিভাইস লাগাক, জয়া হোক বা পূলক—আমি জানব। আর যদি এই দিল্লি কানেকশন সত্যি হয়, তাহলে খেলা শুরু
হয়েছিল আমাদের ভাবনার অনেক আগেই।”
সাদাব
তাকে থামাতে গেলেন, কিন্তু রিনি ঘুরে চলে গেল দরজা দিয়ে। পেছনে পড়ে রইল শুধু
ডিভাইসের ক্ষীণ ব্লিঙ্কিং আলো— যেন ফিসফিস করে বলছে, “তোমরা এখন খুব কাছে চলে এসেছো।”
রাত
সাড়ে বারোটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড কাছে পলাশীর হাসানের ফ্ল্যাটে
সাদাব মোহাম্মদ টর্চের আলো ফেললেন। বাইরে মৃদু বৃষ্টি শেষে ভিজে বাতাস, দূরে
শাহবাগ মোড়ে পুলিশের সাইরেন মিলিয়ে যাচ্ছে। ফ্ল্যাটটা দ্বিতীয় তলায়—নীচে পুরনো গ্রিল দেওয়া বারান্দা, পাশেই কালী মন্দিরের ঘণ্টা হালকা
বাজছে। আয়নার ওপর টিপ দেওয়া শব্দ এখনো মুছে যায়নি— “ডাইনী।” বাতাসে কাঁচের গন্ধ, আর অদ্ভুত এক দম বন্ধ
নীরবতা।
দিল্লি,
রাত দুইটা
সাউথ
এক্সটেনশন-এর ক্লিনিক। ডাঃ বিজয় রাও বললেন— “পেশেন্ট–এক্স এখন স্থিতিশীল, মিস ব্যানার্জি। কিন্তু
ট্রমা গভীর। ডান কিডনি নেই। আপনি চাইলে পাঁচ মিনিট দেখতে পারেন।”
জয়া
(নন্দিতা ব্যানার্জি নামে ভর্তি) চুপচাপ ঢুকল। বিছানায় হাসান—মুখে অক্সিজেন, চোখ আধখোলা। জয়ার হাত কাঁচে ঠেকল। সব রাগ,
প্রতিশোধ, ভয় এক মুহূর্তে গলে গেল। ডাক্তার বললেন— “কেউ বর্ডার থেকে রেখে গেছে। নাম নাই, ঠিকানা নাই। কিন্তু জখমের
সেলাই পেশাদারি।”
জয়া
জানালার দিকে তাকাল। নিজের পেটে হাত রাখল—শিশুটি নড়ছে। “তুমি
বাঁচবে,” সে ফিসফিস করল। “আমিও
বাঁচব। কিন্তু খেলা এবার আমি শেষ করব।”
ঠিক
তখনই ফোন কম্পিত করল। মেইল: joysan53@gmail.com
Subject:
Last Mirror
Attachment:
video.mp4
ভিডিওতে
হাসানের ফ্ল্যাটের সিসিটিভি—পূলকের পড়ে যাওয়া, ফ্যান–গ্রিলের শব্দ, জয়ার চিৎকার। শেষে ধরা পড়ল এক ছায়া—জানালার গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ। স্ক্রিনে টেক্সট— “তুমি একা ছিলে না।” জয়ার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। বাইরে জানালায় দেখল—দুজন কালো পোশাকের লোক দাঁড়িয়ে, চোখে গগলস। সে ফোনটা বন্ধ করে
আয়নায় তাকাল। “তৃতীয় ছায়া, এবার আমি তোমাকেই খুঁজব।

Comments
Post a Comment