ধারাবাহিক থ্রিলার (নিয়তি) ৩য় পর্ব হাসান নিখোঁজ হওয়ার পনের দিন প্রায় পার হয়ে গেছে, জয়ার জীবন কাটছে ভয়াবহ দুর্ভাবনায়। এদিকে নিজের মাঝে একটু একটু করে বড় হওয়া হাসানের সন্তান, এখনো কাউকে বলতেই পারেনি। মাকে বললে কী হতে পারে ভেবে জয়া অস্থির হয়ে যাচ্ছে। বাবার হঠাৎ মৃত্যুটা জয়ার মা একদমই মেনে নিতে পারেননি, খাওয়া-দাওয়া বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছেন। হাসানের মামা ঢাকায় পাগলের মতো থানা-পুলিশ করে বেড়াচ্ছেন। কোনো লাভ হয়নি, এখন পর্যন্ত কোনো সূত্র (ক্লু) পাওয়া যায়নি। এর মাঝে জয়া নিজের প্রেগন্যান্সি, তাও আবার হাসানের নিখোঁজ অবস্থায়, কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছে না কিছুতেই। এদিকে হাই লেভেলের চাপে জয়ার বাবার কিছু সম্ভাব্য খুনি বের করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। যদিও মিডিয়া সোচ্চার এসব অপপ্রচারের জন্য। ধারণা করা হচ্ছে কিছু হাই প্রোফাইল সিক্রেট রিপোর্টিংয়ের কারণে তাকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। পূলক সেনের এক কলিগের কাছ থেকে জানা গেছে, 'হিউম্যান অরগ্যান ট্রান্সপ্ল্যান্টের' একটা সিক্রেট র‍্যাকেটের সাথে জড়িয়ে থাকা কিছু হাই প্রোফাইল ব্যবসায়ী আর পলিটিশিয়ানদের জড়িত থাকার একটা সূত্রের (ক্লু-এর) উপর ভিত্তি করে একটা রিপোর্ট নিয়ে কাজ করছিলেন পূলক সেন। জয়া আজ ক্যাম্পাসে যাবে ঠিক করেছে, হাসানের কোনো সূত্র খুঁজে পায় কিনা দেখা যাক। একটা অসহ্য আতঙ্ক অবশ্য আছে, বাবার লাশ পাওয়া যাবার জায়গাটা দেখার এক বিরাট ভয়ংকর কষ্ট হয়তো তার হবে। কিন্তু জয়াকে শক্ত হতেই হবে, হাসানকে খুঁজে বের করতেই হবে। দিনে দুপুরে এমন করে তার মানুষটা হারিয়ে যাবে! জয়াকে অবাক করে দিয়ে আজ কান্তা এসে হাজির জয়ার বাসায়। জয়াকে ওর বাবার মৃত্যুতে সান্ত্বনা জানায়। হাসানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। জয়া কান্তাকে দেখে ভেঙে পড়ে। অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে কাঁদে, এক সময় না পেরে সে তার প্রেগন্যান্সির খবর দেয় ছোটবেলার বেস্ট ফ্রেন্ড কান্তাকে। কান্তা স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। কান্তা আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছে, সাথে যাচ্ছে ওর হাসবেন্ড। কান্তা কবে বিয়ে করল! অবাক হলো জয়া। ‘এই তো গত সপ্তাহেই। এই কারণেই আসতে পারিনি রে তোর খবর নিতে,’ বলল কান্তা। ‘আচ্ছা শোন, হাসানের কোনো খবর পেলে আমাকে জানাস প্লিজ। যোগাযোগ রাখিস।’ জয়ার কাছে খুব অবাক লাগে কান্তার হঠাৎ বিয়ের খবর, কেউই তাকে জানালো না। ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে হাসানের ফ্ল্যাটে গেল সে। গেট খুলে খুব অবাক হলো, মনে হচ্ছে কেউ একজন থাকছে এখানে, কারণ অদ্ভুত পরিষ্কার তার ঘর। পুলিশ এসে সার্চ করে গেছে শুনেছে সে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে। আরেক বিপদ হলো, বাড়িওয়ালা বাড়ি ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছে এক মাসের মধ্যে। সে অবশ্য তিন মাস সময় চেয়েছে। কী করবে ভাবছে জয়া। সব মিলিয়ে জট পাকিয়ে যাচ্ছে মাথা। কী মনে করে যেন হাসানের টেবিলের ড্রয়ার খুলল জয়া। খুব সাজানো-গোছানো মানুষ ছিল হাসান। ড্রয়ারে হাসানের ওয়ালেট আর ঘড়ি দেখে একটু অবাক হলো জয়া—পরীক্ষার হলে কী তাহলে সে ঘড়ি ছাড়া গিয়েছিল! আর ওয়ালেটই বা এখানে কেন? ওয়ালেট ভুলে ফেলে যাবার মানুষ সে না। কী ভেবে ওয়ালেটটা খুলল সে। ওয়ালেটের ভেতরে তার একটা ছবি দেখে জয়ার বুকটা হু হু করে উঠলো। এত ভালোবাসা ছেড়ে হাসান কোথায় চলে গেলো! ওয়ালেটের ভেতরে এক হাজার টাকার দুটো নোট, কিছু খুচরা দশ-বিশ টাকার নোট আর একটা ছোট গোল প্লাস্টিকের পয়সার মতো দেখতে কিছু। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখল জয়া, কোনো কূল-কিনারা করতে পারলো না। নিজের ছবিটা বের করলো। পেছনে একটা নাম্বার লেখা: RBK5.30PL3RI2VCT-2807। কিসের নম্বর কে জানে! ছাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো জয়া, কিছু গাছ লাগিয়েছিল হাসান। জয়া ভাবলো পানি দিয়ে যাবে। গাছগুলো বেশ সজীব আছে এখনও, অন্য ফ্ল্যাটের কেউ হয়তো ছাদে এসেছিল। যদিও তারা থাকতে উপরে ছাদে কেউ আসতো না। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ালো জয়া। চোখের পানি আর আটকাতে পারছে না কিছুতেই। ভীষণ মনে পড়ছে তার হাসানকে। হাসানের সিগারেট খাওয়াটা সে দু’চোখে দেখতে পারতো না, এখন কেন যেন হাসানের সিগারেটের গন্ধটাও সে খুব মিস করছে। মনে হচ্ছে বেনসনের গন্ধ সে এখনো পাচ্ছে। ভেবেই চমকে উঠলো সে, তার মনে হলো কেউ একজন তার পেছন থেকে দ্রুত সরে গেল। চমকে পেছন ফিরে কাউকেই দেখতে পেলো না, কিন্তু সিঁড়ি ভেঙে কাউকে নামতে শুনলো। জয়া দ্রুত সিঁড়ির কাছে গেল, কেউ নেই কিন্তু খুব পরিচিত একটা গন্ধ। জয়ার আর কিছুই ভালো লাগছে না, সে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রিকশা নিল। ক্যাম্পাসের জমজমাট পরিবেশটা এক দুপুরে কিছুটা স্তিমিত। জয়া সূর্যসেন হলের কাছে গিয়ে, হাসানের বন্ধু আবিদকে কল দিল। ওদের স্কুল ফ্রেন্ড আবিদের রোল নাম্বার হাসানের পরেই। আবিদ জয়াকে একটা অদ্ভুত তথ্য দিল—হাসান নাকি পরীক্ষার মাঝেখানে প্রায় ২০ মিনিট ছিল না, মানে ওয়াশ রুমে ছিল। তারপর পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে গেছে সবার আগে। জয়া কী মনে করে যেন আবিদকে কান্তার কথা জিজ্ঞেস করলো। আবিদ জানেই না কান্তার বিয়ের খবর, অথচ আবিদের গ্রামের বাড়ির দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিল কান্তা। আর কিছু চিন্তা করার মতো ধৈর্য নেই জয়ার আজ। খুব ক্লান্ত লাগছে জয়ার। দ্রুত বাসায় ফিরল জয়া। ড্রয়িং রুমে খুব সুন্দর একটা মেয়ে বসে আছে। জয়ার খুব চেনা লাগলো মেয়েটাকে কিন্তু মনে করতে পারলো না। বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকেই এখন বাসায় আসছে। জয়ার মা জানালো, ও হাসানের মামাতো বোন রিনি। জয়ার খুব অবাক লাগলো রিনিকে দেখে, অনেক ছোটবেলায় একবার হাসানের বাসায় দেখেছিল, এত সুন্দর হয়েছে সে! রিনির চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, ঘুম হয়নি মনে হচ্ছে। হাসানের ৩ বছরের ছোট মামাতো বোন রিনি, হাসানের খুব ন্যাওটা ছিল ছোটবেলায়। রিনি জানালো হাসানের মা খুব অসুস্থ, চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসেছেন, হোটেলে উঠেছেন, হাসানের বাসার চাবির জন্য জয়ার কাছে এসেছে রিনি। রিনির হাসিটা খুব সুন্দর, জয়া ভাবলো। এত ঝামেলার মাঝেও জয়া রিনিকে বলতে বাধ্য হলো—‘রিনি তুমি তো খুবই সুন্দর হয়েছ, আগে তো ছোট ছিলে, মনে নেই?’ ‘দিদি, ওর কোনো খবর পাচ্ছিনা, ফুপুরও শরীর খুব খারাপ।’ জয়ার একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো, হাসান যে ঢাকায় একা বাসা নিয়ে থাকে, এটা তো ওর মা, মামা বা রিনির জানার কথা না, তাহলে কীভাবে রিনিরা জানলো? ‘রিনি, হাসানের বাসার চাবি আমার কাছে কে বলল?’ ‘দিদি আমরা তো জানতাম ও হলে থাকে, কিন্তু কয়দিন আগে টিভি দেখে জানলাম, ও বাসা নিয়েছিল। আর ফুপুর শরীর খুব খারাপ আমরা যখন ঢাকায় রওনা দিচ্ছিলাম, আব্বাকে ফোন করে ওর এক বন্ধু ফুপুর খবর নেওয়ার সময় বলল, আপনার কাছে চাবি আছে আর ওর বাসায় চাইলে আমরা থাকতে পারি।’ ‘আর কিছু বলেনি?’ জানতে চাইল জয়া? ‘না বলেনি।’ জয়া দ্বিধায় (দোটানায়) পড়ে গেল রিনিকে চাবি দেবে কিনা, আসলেই দেওয়া ঠিক হবে কিনা। জয়া, হাসানের মায়ের ফোন নম্বরটা চাইল। রিনি ফোন নাম্বারটা দিল, ফোনটা সুইচড অফ বলছে। রিনির মুখের দিকে তাকালো জয়া, ফোন অফ। ‘দেখো রিনি, আমি বুঝতে পারছি তোমাদের ব্যাপারটা, কিন্তু হাসানকে না বলে আমি কীভাবে ওর বাসার চাবি তোমার হাতে দেই বলতো?’ ‘হাসানের বাসার চাবি আপনি হাসানের স্ত্রীর (ওয়াইফের) কাছে দিতে পারবেন না?’ ‘হাসানের স্ত্রী মানে, হাসানের স্ত্রী কে?’ ‘কেন, মাস তিনেক আগে হাসানের সাথে বিয়ে হয়েছে আমার!’ ‘কী আজেবাজে বলছ!’ ‘আপনি ফোন করে ফুপুকে জিজ্ঞেস করতে পারেন?’ জয়ার কেমন যেন গা গোলাচ্ছিল, সারাদিনের ক্লান্তিতে এমনিতেই নিজের শরীর জানিয়ে দিচ্ছে হাসানের সত্তা। তার উপর এইসব চাপে পাগল হয়ে যাবে জয়া মনে হচ্ছে। কিছু বোঝার আগেই জ্ঞান হারালো জয়া।




http://dlvr.it/TNv6XZ

Comments

Popular posts from this blog

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১৬ (সমাপ্তি)

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ০১ ও ০২

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১৪ ও ১৫