ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ০১ ও ০২
আজ হাসানের শেষ পরীক্ষা, পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই তাকে সুখবরটা দিবে জয়া, তাই অপেক্ষা করছে হাসানের বাসায়। হাসানের হবে কেন, বাসাটা হাসান আর জয়ার দুজনেরই। ভাবতেই হাসলো জয়া। এই বাসাটা সে মনের মতো সাজিয়েছে, ছোট্ট একবেড রুমের একটা বাসা, সামনে একটু ডাইনিং, খোলা ছাদের ধার ঘেরা ফ্ল্যাটের পেছনের দিকে রান্নাঘর আর ওয়াশরুম। খুব প্রিয় জয়ার এই বাসাটা। তার আর হাসানের নিজেদের বাসা, খুব কষ্ট করে একটু একটু করে এই সংসার গড়েছে তারা। কত বয়স হবে ওদের, ২৩ বছরে পড়ল হাসান, জয়া ২৪ এ। ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু তারা। বছর তিনেক হলো হাসান আর জয়ার সংসারে। সেইদিনের কথা খুব মনে পড়ে জয়ার, ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন ও........
জয়ার
বেস্ট ফ্রেন্ড কান্তার বয় ফ্রেন্ড ছিল তখন হাসান, তারা তিনজন ছোটবেলার বন্ধু,
একসাথে স্কুল শেষ করেছে। ভীষন সুপুরুষ হাসানের প্রতি অনেকের মেয়েরই
ক্লাশ থাকলেও হাসানের মন প্রাণ আত্মা সব টা জুড়ে কেবল কান্তা। কান্তাও হাসানের
জন্যই যেন জন্মেছিল। স্কুলের সবাই জানতো তাদের ব্যাপারটা। কান্তার বোনেরাও জানতো। কান্তা আর হাসানের
প্রেমের সাক্ষী ছিল তাদের কমন ফ্রেন্ড জয়া। জয়া ও যে হাসান কে খুব পছন্দ করতো না
এই কথা জয়া নিজেও কখনো অস্বীকার করতে পারবেনা। তবুও বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রেমিক কে
বন্ধুর বেশি কিছু নিবেদন করতে রুচি হয় নি কখনো। এইচ এস সি পরীক্ষার আগে হঠাৎই মারা
গেলেন হাসানের বাবা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে
গেলেন এন হাসানের মা, কোনরকমে হাসানের এইচ এস সি সি পরীক্ষার
পর সব গুটিয়ে চলে গেলেন গ্রামে। সেখানেও বিপত্তি, দাদী বেচেঁ
থাকায় চাচারা কেউই সম্পত্তি বুঝিয়ে দিল না হাসানের মা-কে।
অসহায় হাসান আর তার মা আশ্রয় নিলেন হাসানের নানা বাড়ীতে। হাসানের মামা অনেক
আন্তরিকতায় গ্রহন করলেন হাসান আর তার মা-কে। এইচ সি পর হঠাৎ
গ্রামে চলে যাওয়া আর হাসানের জীবনের টানা পোড়নে আস্তে আস্তে কান্তা কেন যেন
হাসানের থেকে দূরে সরে গেল, হাসান চাইলেও সহজে যোগাযোগ করতে
পারছিল না।
হাসান
সাহস করে একদিন মুখোমুখি হলো কান্তার।
"কী, ব্যাপার এড়িয়ে চলছিস নাকি"
"এড়িয়ে চলার কিছু নেই, এমনি সময় পাই না, বাইরে পড়তে যাব, আই ই এল টি এস দিব, বিজি"
"দ্যাখ আমি সোজা সাপ্টা কথা আশা করছি, কী হয়েছে বলবি!
"
ওয়েল, হাসান আমার মনে হয় আমি আসলে তোর প্রতি
আর ছোটবেলার ফিল টা পাচ্ছিনা, ইউ সিম কিন্ডা বোরিং টু মি"
"ইজ দ্যাট সো! অর ইউ ফাইন্ড মি এ বিট ইন
ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস!"
"শোন অতো রুড ভাবছি না, আসলে আমার মনে হয় আমাদের আর
কোন ইস্যু নেই, আমাদের ব্রেক আপ টাই বেটার"
"কান্তা আমি ভাবতেই পারছিনা, তোকে ছাড়া আমি থাকতে
পারবো নারে"
"প্লিজ, সিনেমার ডায়ালগ দিস না, ঠিক হয়ে যাবে সব" আর কোন কিছু বলার সুযোগ না
দিয়ে কান্তা হেটেঁ বেরিয়ে গেল হতবিহ্বল হাসানের সামনে থেকে। হাসান পুরোপুরি ভেংগে
পড়ল। উদভ্রান্ত হয়ে গেল সে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে এইচ এস সি তে বোর্ড স্ট্যান্ড করে বসলো হাসান
বিন হাফিজ। আমাদের এই গল্পের প্রধান চরিত্র "হাসান"
বিশ্ববিদ্যালয়
ভর্তি কোচিং করতে ঢাকায় এক মেসে উঠলো হাসান, ঠিক মেস না তিনবন্ধু মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া
নিয়েছিল আগারগাঁও এ, ওদের আগের বাসার কাছেই। এর মাঝেই কান্তা
জানালো হাসানের সাথে আর কন্টিনিউ করতে চাচ্ছে না। ঝড় বয়ে যাচ্ছিল হাসানের উপর দিয়ে,
পুরানো বন্ধুদের অনেকের সাথে ইচ্ছে করেই যোগাযোগ কমিয়ে দিল হাসান।
কিন্তু জয়া নাছোড়বান্দার মতো ঝুলে রইলো। হাসানের খবরাখবর খুব ভালই নিচ্ছিল বাসা
থেকে মাঝে মাঝে রান্না করে আনছিল বাবা-মায়ের চোখ ফাকিঁ দিয়ে।
হাসানের অন্য বন্ধুদের সাথেও খুব জমতো জয়ার। সবাই মিলেই গ্রুপ স্টাডি করত। কান্তার
চলে যাওয়ায় বিপর্যস্ত হাসানের পাশে খুব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল জয়া।
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিল হাসান। হাসানের চেয়ে
বেশি খুশি জয়া। কিন্তু জয়া চান্স পেল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অন্য বন্ধুদের
মাঝে হাসান ছাড়া চান্স পেয়েছিল আর একজন।
হাসানের
সাথে জয়ার বন্ধুত্বটা জমে উঠেছে বেশ, জয়াদের বাসায় অবাধ যাতায়াত হাসানের। ছোটবেলায়
হাসানদের স্বচ্ছলতার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জয়ার মা ও, তাই
প্রায়ই বাড়ীতে ডেকে ভালমন্দ খাওয়ান তাকে। মামার আর্থিক সাহায্য আর বাবার জমানো
কিছু টাকায় বেশ ভালই চলছিল হাসান আর ওর মায়ের। তবু হাসান ক্লাসের ফাঁকে কিছু
টিউশানি করে নিজের খরচ চালায়। কান্তার জন্য তীব্র এক কষ্ট পুষে রাখে সে মনে। জয়া
অনেক চেষ্টা করেও সে কষ্ট মন থেকে মুছতে পারেনা।
ইদানীং
বেশ সিগারেট ধরেছে হাসান, অসহ্য বিরক্ত লাগে জয়ার।
"সিগারেট খাওয়াটা তোর জরুরী কেন?"
"
তোকে কৈফিয়ত দিব ক্যান, দেখছিস না তোর বান্ধবী
কেমন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, আমি জ্বালায় দিব সব"
"ধূর, শোন আমার মনে হয় কান্তার কোন উপায় ছিল না বলেই
এমন করেছে, দেখেছিস না কারোর সাথে আর যোগাযোগ নেই
"
"জানিস আমি কিন্তু জন্মেছি শুধু কান্তার জন্য"
এই
কথাটা অসহ্য বিরক্তিকর ঠেকলো জয়ার কাছে। উঠে গিয়ে সিগারেট টা টান দিয়ে ফেলে চলে
গেল একটা রিক্সা ডেকে। পরের কয়দিন আর খোজঁ নেই জয়ার।
সেদিন
বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে টিউশানিতে গিয়েছিল হাসান, ফেরার পথে ঝুম
বৃষ্টি। আজ ছাতাও নেই সাথে, দুই গলি পরের জয়ার বাসা। কিভেবে
সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় সে হাজির হলো জয়ার বাসায়। বাসায় নক করতেই জয়া গেট খুলে
ভেতরে আসতে বলল, কাক ভেজা হাসান কে। হাসানের চুল বেয়ে তখন
বৃষ্টির পানি ঝরছে, মুগ্ধ হয়ে দেখছিল জয়া।
"টাওয়াল দে না একটা, আর আন্টিকে বল না আমায় একটু চা
দিতে""
"বাসায় কেউ নেই হাসান, তুই বয় আমি চা করে দিচ্ছি"
টাওয়াল
দিয়ে চা করতে গেল জয়া,
ভেজা শার্ট টা কী ভেবে যেন খুলে টাওয়াক পেঁচিয়ে বসল হাসান। সোফার
উপরেই ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্ত শ্রান্ত হাসান। চা হাতে রুমে ঢুকে হাসানের এই অবস্থা
দেখে খুব মায়া হলো জয়ার, কাছে গেল ওকে ঠিক মতো শুইয়ে দিতে।
মানুষ আসলে তার নিয়তির হাতের পুতুল মাত্র। যা ভাবে, যা চায় ঘটে তারচেয়ে ও চমকপ্রদ ঘটনা, আর তাই, জয়া সে সন্ধ্যায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল হাসানের মাঝে, হঠাৎ লোডশেডিং আর হাসানের গায়ে জ্বরের উত্তাপ তাকে কখন যে নিজেকে অনেক
অনেক বেশি উদারতায় গ্রহন করতে উদ্ভুদ্ধ করলো হাসানকে। হাসান ও জ্বরের ঘোরে আর
বিভ্রমেই কিছুটা জয়ার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। জয়ার ক্ষেত্রে সেটা ছিল পূজার
নৈবদ্য আর হাসানের জন্য হয়তো কান্তাকে ভোলার চেষ্টা বা বিভ্রম ছিল, তা জানা যাবে ঘটনা পরিক্রমায় পরে।
হাসান আর জয়া যখন নিজেদের সম্বিত ফিরে
পেল, জয়ার চোখে
তখন অশ্রু, হাসান দ্বিধায় মুখ ফসকে বলে ফেলল "সরি"।"সরি, মানে!
তুই যা করেছিস তা ভুল করে করেছিস, এবং তাতে
ভালবাসা ছিল না??" রাগী গলায় জিজ্ঞেস করে জয়া।
সত্যিটা বলতে পারেনা হাসান যে জ্বরের
ঘোরে, আলো
আধাঁরিতে জয়াকে কান্তা ভেবে বিভ্রম হয়েছিল। উঠে বসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল-
"না আমি ভেবেছিলাম, তুই রাগ করেছিস।
আচ্ছা আমি এখন আসি" ।খুব দ্রুত উঠে চলে গেল হাসান।
বাইরে তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। হাসান ভীষন রকম অনুশোচনায় ভুগছে, সে এটা চায় নি। জয়া তার বেস্ট ফ্রেন্ড, কান্তা তার
প্রেম, তার পূজা। সে কিনা নিজের সব গৌরব খুইয়ে বসল এমন
একজনের কাছে, মা ছাড়া যে তার সবচেয়ে আপনজন কিন্তু প্রেম নয়।
উফফ, নিজেকে অসহ্য বিরক্তিকর লাগছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আজ
আর মেসে ফিরবে না সিদ্ধান্ত নিল হাসান। ভালবাসাহীন কোন শারীরিক স্পর্শ তার সত্যি
ঘৃণার কারন। নিজেকে তীব্র ঘৃণা হচ্ছে তার। হাসান ভাবলো মায়ের কাছে যাবে, কিছুটা শান্ত হওয়া তার খুব দরকার। আর কিছু না ভেবেই গুলিস্তান থেকে
মুন্সিগঞ্জের বাসে উঠে বসল হাসান।
প্রচন্ড জ্বর নিয়ে যখন বাড়ি পৌছল
হাসান, তখন রাত ১০
টা। কলিংবেলের শব্দে গেট খুলল মামাতো বোন তৃণা। "ভাইয়া,
তুই হঠাৎ কোন খবর না দিয়ে""
তৃণাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গেটের
উপরেই জ্ঞান হারালো হাসান। হাসানের ৬ ফুট ২ ইঞ্চির শরীরটা উপর এমনভাবে পড়ল, যে শব্দে পুরো বাসা মোটামুটি
কেঁপে উঠলো। কপালের কিছু অংশ কেটে রক্ত বের হয়ে গেল, হাসানের
মা-মামা হতভম্ব হয়ে গেলো। দ্রুত হাসানকে তুলে বিছানায়
শোয়ালেন মামা আর তৃণা। হাসানের গা তখন পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।
হাসানের ওভাবে চলে যাওয়ার পর এক
স্তম্ভিত অনুভূতি হচ্ছিল জয়ার, তার ছোট্টবেলার বন্ধু, জীবনের প্রথম প্রেম হাসান কে
এভাবে সে কখনো চায়নি, কোন দিন ও ভাবে নি হাসান এর সাথে
এইভাবে কোন সম্পর্কে জড়াবে। হাসানের খুব জ্বর ছিল, ওমন করে
বেরিয়ে গেল, আজ রাত টা থেকে গেলে পারতো। কী করছে কে জানে,
ভেবে ফোন দিল। দুইবার রিং হলো, কোন খবর নাই।
হাসানের জ্বর একটু কমলো শেষ রাতে। সে
উঠে কী মনে করে মায়ের কাছে গিয়ে শুলো,
মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাদঁতে লাগলো। হাসানের মা রাজিয়া বেগম, ভাবলেন হাসানের শরীর হয়ত খুব বেশি খারাপ লাগছে, কিন্তু
হাসান শুধু কাদঁছে আর বলছে- মা, আমি
খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। রাজিয়া বেগম কিছুও বুঝতে পারছেন না। তবু বলছেন
"শান্ত হও বাবা, কী হয়েছে! সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি
ভুল বুঝতে পারলে অবশ্যই ক্ষমা পাবে। কী ভুল হয়েছে"
হাসান কিভাবে কী বলবে বুঝতে না পেরে
বলল-
"মা আমি আমার এক বন্ধুর
সাথে বিরাট অন্যায় করে ফেলেছি"
হাসানকে শান্ত করার জন্য মা বললেন "বন্ধুই তো মাফ চেয়ে নাও,
আল্লাহ ও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করেন, আর তোমার বন্ধু তো মানুষ"
হাসান জয়ার কাছে ক্ষমা চাইবার
সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু কিভাবে মুখোমুখি হবে সে জয়ার, কান্তাই বা কী ভাববে এটা শুনলে। হাসান টেনশান টা
আর নিতে পারছিল না। ভাবলো একটু সুস্থ হয়ে ঢাকায় গিয়েই সে প্রথমেই মুখোমুখি হবে
জয়ার। নিজের বিছানায় শুতেই চোখ বুজে আসলো হাসানের। ঘুম ভাংলো দুপুরের পর।
ফোন হাতে নিতেই দেখলো ৫২ টা মিসকল
জয়ার। হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলব্যাক করলো। ফোন ধরলেন জয়ার মা। যা শুনলো তা শুনতে
প্রস্তুত ছিল না হাসান। হাসানকে খুঁজতে হাসানের মেসে যাওয়ার পথে একসিডেণ্ট হয়েছে
জয়ার। মাথায় দুইটা স্টিচ লেগেছে। এবার আর হাসানের কিছুই ভাল লাগছিল না। কোনরকমে
দুইটা নাপা খেয়ে ছূট লাগালো ঢাকার উদ্দেশ্যে।
জয়া চোখ মেলে দেখে তার পাশে মুখ শুকনো
করে বসে আছে হাসান। জয়াকে তাকাতে দেখে হাসান বলল "" কেমন আছিস?""
"তোকে দেখে খুব ভাল লাগছে"
"আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম
জানিস"
"কী ভেবেছিলি মরে যাবো!"
"ধুর না! আমাকে খুজঁতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছিস শুনে আমার খুব অনুশোচনা হচ্ছিল"
"তুই ফোন ধরছিলি না কেন"
"মায়ের কাছে গিয়েছিলাম,
জ্বর ছিল যে"
হাত বাড়ালো জয়া, এগিয়ে দিল নিজেকে হাসান,
হাত দিয়ে জ্বর দেখে আঁতকে উঠলো জয়া, "এত
জ্বর নিয়ে এখানে বসে আছিস কেন? আজব! মা
এই মা, ম"
"আরে আন্টি একটি বাসায়
গেছে, আমাকে রেখে, চলে আসবে ঘন্টা
খানেকের মধ্যে, তুই ভাবিস না""
"হাসান, আমার কাছে একটু আয়, একটা জিনিস বলতে চাই, কানে কানে"
লজ্জায় লাল হয়ে হাসান বলল বল-" শোন, তোকে বলিনি কখনো কিন্তু আজ বলতে আর দ্বিধা নেই, তোকে
আমি ভালবাসি হাসান। তুই এত বোকা কেন আমাকে কান্তার কথা বলে শুধু জেলাস করতি,
তুই ও যে ভালবাসিস এটা বলতে এত নাটক করতে হলো!" খুব আদুরে গলায় বলল জয়া।
হাসান কী বলবে ভেবে পেলো না, জয়া পুরো ব্যপারটা অন্যভাবে
ব্যাখা করছে। হাসান সত্যিটা বললে কী ভাবে রিয়াক্ট করবে বুঝতে পারছিল না। জয়া বলে
উঠল-"বিয়ে করবি আমাকে!"
হাসান কী বলবে বুঝতে পারছিল না। এর
মাঝেই জয়ার মা চলে আসলো। হাসান ফিরে গেলো মেসে। হাসানের জ্বর সারতে আরো বেশ
কিছুদিন লাগলো, ফোনেই
টুকটাক কথা হচ্ছিল জয়ার সাথে। জয়া দ্রুতই সেরে উঠছিল। এর মাঝে সপ্তম আশ্চর্যের মত,
হাসান এক সকালে আবিষ্কার করলো তার বিছানায়, তার
পাশে শুয়ে আছে জয়া! মোটামুটি লাফ দিয়ে উঠলো হাসান।
"তুই, এখানে এভাবে!! কেন"
"হ্যাপী বার্থ ডে
"
হাসান ভুলেই গিয়েছিল আজ ওর জন্মদিন।
"কিন্তু তুই এভাবে এখানে
আমার বিছানায় কেন, গেট কে খুলে দিল! সবাই
কী ভাবছে ছি ছি"
"সবাই খুব ভাল ভাবছে,
গেট খুলেছিল রাহি, আমি ওকে বলেছি ওদেরকে
সারপ্রাইজ দেবার জন্য বলা হয় নাই, আমরা বিয়ে করেছি"
"কী! মিথ্যে কেন বলেছিস, তাও আবার এত বড়""
"তুই এমন করছিস কেন,
বিয়ের কী বাকি আছে নাকি কিছু, নাকি তুই শুধু
সেদিন কিছুক্ষণ টাইম পাস করেছিস আমার সাথে?"
হাসান কী বলবে ভেবে পেল না। "তাই বলে সবাইকে এভাবে
বলতে গেলি কেন?"
"চুপ করতো আগে মুখ ধুয়ে
কেক কাট"
সেদিনের পর থেকে তারা অলিখিত স্বামী-স্ত্রী, অন্তত
বন্ধু মহলে, প্রথম প্রথম হাসানের কিছু দ্বিধা ছিল, জড়তা ছিল। কিন্তু জয়ার তীব্র ভালবাসা, হাসানকেও
জয়াকে ভালবাসিয়েছে।। কান্তার জায়গাটা কখন যে একটু একটু করে দখল করে নিয়েছে জয়া
হাসান বুঝতেও পারেনি। হাসানের পৃথিবী এখন জয়া।
এর মাঝে পার্ট টাইম একটা জব পেয়ে যায়
হাসান। জব পেয়ে আলাদা একটা ছোট ফ্ল্যাট নেয় সে, এর মাঝেই জমে উঠে তাদের লাল নীল সংসার। হাসান
ভেবেছিল মাস্টার্সের পর মা-কে সব জানাবে। এদিকে জয়ার মূল
ভয়টা ছিল বাবাকে নিয়ে, ভিন্ন ধর্মের একটা ছেলে কে কী জামাই
হিসাবে মেনে নেবেন বিখ্যাত সংবাদিক পূলক সেন! বাবার ভয়ে আজ
পর্যন্ত সব কিছু খুব বেশি গোপন করে রেখেছিল জয়া। কিন্তু এর মাঝেই প্রেগন্যান্ট হয়ে
পড়ে সে। হাসানের মাস্টার্স পরীক্ষার মাঝে জয়া যখন এই ব্যাপারটা জানতে পারে,
সে হাসানকে জানানোর একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করে যে হাসানের শেষ পরীক্ষার
দিন ই সে জানাবে সব।
কিন্তু পরীক্ষা শেষ হয় ১.৩০ টায়, বিকাল
৪ টায় ও ফিরলো না হাসান। যদিও এক সাথেই লাঞ্চ করার কথা তাদের। কখনোই হাসান কথার
বরখেলাপ করেনি। হাসানের সব প্রিয় খাবার রান্না করেছে আজ জয়। লাল শাড়ী পড়ে খুব
সুন্দর করে সেজেছে আজ জয়া। আর বাসার ড্রয়ারে মা-কে সব জানিয়ে
চিঠি লিখে রেখে এসেছে। আজ আর বাড়ী ফিরবে না সে। হাসানের সাথেই বাকী জীবন কাটাবে সে,
এই সিদ্ধান্তেই ঘর ছেড়েছে সে। একদিকে জয়াকে পুরোপুরি পাওয়া অন্যদিকে
বাবা হবার আনন্দে হাসানের রিয়াকশান কেমন হবে ভাবতেই এত ভাল লাগছিল জয়ার। বিছানায়
পিঠ এলাতেই ঘুমিয়ে গেল সে। ঘুম ভাংলো যখন প্রায় সন্ধ্যা। হাসান ও ফেরেনি এখনো।
এদিকে পরীক্ষা হলে ফোন নেয়া নিষেধ বলে, হাসানের ফোন টিও
টেবিলের ওপর সুইচড অফ। ভীষন ভয় আর শংকায় পড়ে গেছে জয়া। কী ভেবে যেন টিভির সুইচ টা
অন করে চ্যানেল বদলাচ্ছিল।
হঠাৎই ভয়ের এক শীতল স্রোত বয়ে গেলো
জয়ার মেরুদন্ড বেয়ে এক ভয়ংকর সংবাদে।
টিভিতে প্রচারিত ব্রেকিং নিউজ- প্রখ্যাত সাংবাদিক
পূলক সেন নিহত হয়েছেন, আততায়ীর হাতে। কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে
তাকে’
কী করবে বুঝতে পারছেনা জয়া। বাবার
হঠাত মৃত্যুর সংবাদ, তাও এভাবে। হাসানের সাথে চলে এসেছে বলে বাসায় ফোনটাও ছেড়ে এসেছে যাতে ওকে
খুঁজে না পাওয়া যায়। এদিকে হাসানের কোন খবর নেই। হাসান কে কিভাবে রিচ করবে ভাবতে
ভাবতে হাসানের ফোন অন করতে গিয়ে রীতিমতো ধাক্কা খেল জয়া, হাসানের
ফোনের মধ্যে সিম নেই কোন। ফোনে লক ও নেই, এম্নিতে হাসানে
ফোনে প্যাটার্ন লক থাকে, আজ কিচ্ছু নেই। পুরো ফোন বুকে কারো
নাম্বার নেই। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে জয়ার। তার তীব্র বমি পাচ্ছে। ওয়াশরুমে যাওয়ার
আগেই বমি করে ফ্লোর ভাসিয়ে ফেলল সে। ফ্রেশ হয়ে রুম ক্লিন করে কোনরকমে সে নিচে নেমে
একটা রিক্সা নিয়ে বাড়ী ফিরতে চাইলো।
প্রখ্যাত সাংবাদিক পূলক সেনকে কে বা
কারা বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তায় নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে। কোন ক্লু এমনকি
ওয়াপন টাও পাওয়া যায় নাই। এমনভাবে লাশটাকে কুপিয়েছে যে মুখাবয়ব বদলে গেছে। পুরো
শরীরটা চাপাতি জাতীয় কিছু দিয়ে ইচ্ছা মত কোপানো হয়েছে। যখন তাকে কোপানো হচ্ছিল, কাকতালীয় ভাবে কোন শব্দ পাওয়া
যায় নাই, তার মুখ আগেই বেধে নেয়া হয়েছিল। বৃষ্টির দিন হওয়াতে
ঐ দিক টা বেশ ফাকা থাকে। বিরাট প্ল্যান করে এটা করা হয়েছে। প্রচন্ড রাগ থেকে কেউ
এটা করেছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠন এটাকে মৌলবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা
দেয়ার চেষ্টা করছে। পুলিশ সন্দেহভাজন দুইজন কে ধরেছে, যারা
সোহরোয়ার্দি উদ্যানে নিয়মিত ড্রাগ বেচে। আপাতত মানুষের মনের আগুন ছাইচাপা দেয়ার
একটা দূর্বল প্রেচেষ্টা। এদিকে প্রেসক্লাবের সামনে মানব বন্ধন করছে সাংবাদিকদের
একটি সংস্থা। রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে এই দিকের।
পূলক সেন গোড়া ধার্মিক ছিলেন না, তবে হ্যাঁ নিজের ধর্মের প্রতি জাত্যাভিমান ছিল। একমাত্র মেয়ে জয়াকে নিয়েই তার ভূবন আবর্তিত হত। জয়ার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে একটু খুতখুতে ছিলেন তিনি। জয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড হাসান কে তিনি দুই চোখে দেখতে পারতেন না, হাসানের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার আর বোকাটে চেহারা কোনটাই তার পছন্দ ছিল না, তার চেয়েও বিরক্তিকর ছিল তার মেয়ের অতিরিক্ত হাসান প্রীতি, ভাল কিছু বাসায় রান্না হলেই এই ছেলে বাসায়। সে অনেকবার মেয়ের মায়ের মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলেন হাসানের সাথে সম্পর্ক টা আসলে জয়ার কতদূর। জয়ার মা বারেবার ই তাকে নিশ্চিন্ত করেছে। সে যদিও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারেনি, তবু কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে সে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে একটা প্রেগ্ন্যান্সি স্ট্রিপ পেয়েছিল, এই বাসায় যেহেতু জয়া ছাড়া আর কেউ প্রেগ্ন্যান্ট হবার মত নেই তাই সে ভীষন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। জয়া ভার্সিটি যাবার পরে তন্ন তন্ন করে বাসা খুঁজে হাসানের সাথে বেশ কিছু ছবি পেয়েছে, যেগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে তাদের বিয়ের ছবি। পূলক সেনের ইচ্ছে করছিল সব ভেঙ্গে চুড়ে ফেলেন। সে কখনোই নিম্নবিত্ত এক মুসলিম ছেলের কাছে মেয়েকে তুলে দিতে পারেন না। তাকে অনেক কঠিন কিছু খেলা খেলতে হবে, খেলা গুলো জটিল আর এমন হবে যেন জয়া কষ্ট না পায়, জয়ার সন্তানের একটা ব্যাবস্থা নিতে হবে, দেরি করা যাবেনা। পৃথিবীর অন্যতম নিষ্ঠুরতার প্ল্যান করলেন পূলক সেন। আজ সকালেই সে জয়ার লেখা চিঠিটা পেয়েছিলেন তার ড্রয়ারে, মুচকি হাসলেন। আজকেই তাহলে সেইদিন যে দিনের প্রিপারেশান তিনি নিয়েছেন গত কয়েকদিন থেকে। কিন্তু আজ বিকেলেই পাশার দান উল্টে যাবে তা সে কক্ষনো ভাবতে পারেন নি। কিংবা ভেবেছিলেন কি!!

Comments
Post a Comment