ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ০৪ ও ০৫
রিনি খুব দুঃখী একটা মেয়ে। জন্মের সময়ই তার মা মারা গিয়েছিলেন, তাই সে বড় হয়েছে বাবার কাছে। রিনির বাবা তালিব সাহেব একজন খুব রাগী মানুষ, যদিও রিনির ধারণা—তার সব রাগই কেবল ভান। মেয়ে মানুষটাকে ঠিকভাবে মানুষ করার জন্যই যেন সারাক্ষণ বকাঝকা করেন তিনি। রিনি জানে, তার বাবা তার কোনো অনুরোধই ফেলে দেন না, শুধু এমন ভান করেন যেন রিনি খুব বিরক্ত করছে।
রিনির ইচ্ছা ছিল ঢাকায় গিয়ে পড়বে, কিন্তু বাবার কারণে যেতে পারেনি। ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন বাবার আকাশপাতাল জ্বর এল। রিনির মনে হলো, তার ঢাকা যাওয়ার কথাই যেন বাবাকে অসুস্থ করে ফেলেছে। ফুপু বলেছিলেন যেতে, কিন্তু তার আর মন চায়নি। আসলে লেখাপড়ায় তেমন আগ্রহ তার কখনোই ছিল না—ঢাকা যেতে চেয়েছিল কেবল হাসানের জন্য।
হাসান তার ফুপাতো ভাই। সবসময় বড় ভাইসুলভ আচরণ করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসি-ঠাট্টায় সবাইকে মাতিয়ে রাখত। ছোটবেলা থেকেই হাসানের এই হাসিখুশি স্বভাবটা রিনির ভীষণ ভালো লাগত। একটু বড় হতেই আবিষ্কার করল—হাসান কয়েকদিন না এলে তার বুকের ভেতর অজানা কষ্ট জমে। এস.এস.সি রেজাল্টের দিন হাসান না আসায় সে সারারাত কেঁদেছিল।
রিনির বাবা মেয়েকে বেশ ভালোই বুঝতেন। না হলে বোনকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে হাসানের বিয়েতে রাজি করাতে পারতেন না। তালিব সাহেবের কাছে হাসান ছিল একেবারেই অগোছালো ছেলে—একজন জেদি রাজনীতিবিদের কাছে এমন একজন মানুষকে অপছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু হাসানও কেন জানি মামাকে ভয় পেত; ছোট থেকেই তাকে দেখলে যেন অপরাধীর মতো পালিয়ে যেত।
তিন মাস আগের ঘটনা। হাসানের মায়ের হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে, আর হাসান পাগলের মতো ছুটোছুটি শুরু করে। অসুস্থ অবস্থায় মা হাসানকে রিনির সাথে বিয়ের কথা বলেন, কিন্তু সে রাজি হয় না। চিকিৎসার খরচও অনেক, টাকা দরকার। হাসানের একমাত্র উপায় ছিল মামার কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া, কিন্তু সেক্ষেত্রে রিনির প্রসঙ্গ সামনে এসে পড়ত—তাহলে টাকা পাওয়া কঠিন হতো। ঠিক করেছিল রিনিকে জয়ার কথা জানাবে, তারপর মামার কাছ থেকে টাকা ধার চাইবে। কিন্তু সেদিনই মায়ের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, চিকিৎসার পুরো ব্যবস্থাই করে দেন মামা। হাসান কৃতজ্ঞ গলায় বলেন, ‘আমি টাকাটা আপনাকে ফেরত দেব মামা, অবশ্যই দেব।’ মামা হেসে বলেন, ‘সে দেখা যাবে,’ আর ওর পিঠে চাপড় দেন।
বিয়ের দিনটা আজও রিনির মনে আছে। হাসানের মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতেই তালিব সাহেব আর দেরি করতে চাননি। হাসান কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার মা চোখের জলে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন কিভাবে ভাইয়ের সহায়তায় তারা বেঁচে আছেন, এখন সেই কৃতজ্ঞতার প্রতিদান দেওয়ার সময়। হাসানের না বলার কোনো সুযোগ ছিল না। সে শুধু বলেছিল, ‘রিনিকে আমি বোনের চোখে দেখি।’ কিন্তু তালিব সাহেবের ব্যক্তিত্বের সামনে তার আপত্তি টেকেনি। চোখ বন্ধ করে বিয়েটা করে ফেলল হাসান। রিনির কাছে সেটা ছিল জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন—তার প্রিয় স্বপ্ন যেন অচিন্তনীয়ভাবে সত্যি হয়ে গেল।
কিন্তু সেদিনই জরুরি ফোন আসে হাসানের কাছে। পরদিন ইনকোর্স পরীক্ষা, রাতেই ঢাকা ফিরতে হবে। সেই ছিল তাদের শেষ দেখা। ঢাকায় ফিরে হাসান টিউশনি, ক্লাস, পার্টটাইম কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে গেল যে ফোনে ঠিক মতো কথা বলতেও পারত না। উত্তর দিত শুধু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’। পরীক্ষা শেষ হলে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। কিন্তু এরই মাঝে হাসান উধাও হয়ে গেল।
হাসানের নিখোঁজের পর রিনি রাতের পর রাত জেগেছে। তার বাবা মেয়ের কষ্ট বোঝতেন এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন হাসানকে খুঁজে বের করার। হাসানের মা আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকায় আনতে হয়। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক তখনই এক অচেনা কল আসে—জানা যায়, হাসান ঢাকায় একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে, আর তার চাবি আছে হাসানের বন্ধু জয়ার কাছে।
রিনি ছুটে আসে জয়ার কাছে। এত চিন্তার মাঝেও খবরটা শুনে একটু আনন্দিত হয়—ভাবল, হাসান নিশ্চয়ই তাকে সারপ্রাইজ দিতে বাসা নিয়েছে! কিন্তু হাসান আর তার বিয়ের কথা শুনে জয়া কেন অজ্ঞান হয়ে গেল, কিছুই বুঝল না রিনি—শুধু চিৎকার করে সাহায্য চাইল।
জয়ার জ্ঞান ফেরে মায়ের কঠিন মুখ দেখে। ডাক্তার জানালেন—জয়া প্রেগন্যান্ট। স্বামীর মৃত্যুশোকের চেয়ে মেয়ের এই অবস্থাই মায়া সেনকে বেশি চিন্তিত করে তুলল। তিনি কিছুই জানতেন না। পাশে বসে রিনি উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘দিদি, কেমন লাগছে?’ জয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বেঁচে আছি—এটাই এখন অসহনীয়।’
মা মৃদু গলায় বললেন, ‘তুই কিছুই জানাসনি আমাকে। সত্য কথা বলবি, আমি রাগ করব না।’ জয়া নির্বাক—রিনির সামনে কী বলবে! হাসান কি তবে তাকে প্রতারণা করেছে? না, তার হাসান এমন নয়। হয়তো কোনো বড় গোলমেলে ব্যাপার আছে। জয়া বলল, ‘তুমি বরং আন্টির কাছে যাও, উনি অসুস্থ। আমি একটু সুস্থ হলেই কাল সকালে চাবিটা দিয়ে আসব।’ রিনি কিছু না বলে চলে গেল।
জয়া এবার মাকে ডেকে বলল, ‘মা, তুমি বসো। আমি কিছুই করিনি যাতে তোমাদের অসম্মান হয়। আমি আর হাসান গোপনে বিয়ে করেছি, কারণ জানতাম বাবা মানবে না। তোমাকে বলতেও ভয় পেয়েছিলাম। আই’ম সরি মা।’ বলে মায়ের গলা জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। মায়া সেনও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। যেন দুই নারী—দুজনই প্রিয় পুরুষকে হারিয়ে এখন কেবল একে অপরের শোকে একত্রিত।
তবু মায়া সাহসী হয়ে উঠলেন। ডাক্তারি পরীক্ষা ও পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করলেন। জয়া ঠিক করল, হাসানের মায়ের সঙ্গে দেখা করবে—সব খুলে বলবে। তার আগে গেল হাসানের বাসায়। ঢোকার আগে অদ্ভুত ভয় লাগছিল। এই বাসা তো সে নিজে সাজিয়েছে—আলমারিতে তার কাপড়, বেসিনে তার টুথব্রাশ। সবকিছুই যেন তার সুখময় জীবনের সাক্ষী।
কিন্তু হাসান রিনিকে বিয়ে করেছে—এটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র হয়েছে। ভাবল, এখানে একদিন থাকবে, নিজেকে সময় দেবে।
বাসার বাড়িওয়ালার কাছে শোনা গেল পুলিশ নাকি এক্সট্রা চাবিটা নিয়ে গেছে। ভ্রু কুঁচকালো জয়া। ঠিক করল, ডিআইজি আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলবে। ছাদে গিয়ে দরজা বন্ধ করল, ভেতরে ঢুকে দেখল—কি সুন্দর ছিমছাম ঘর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে জল এসে গেল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় এখনও লেগে আছে তার কপালের টিপ। হাসান আয়নার সামনে দাঁড়ালেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরত। সেই স্মৃতি মনে পড়তেই বুকটা ভার হয়ে এল।
বিছানায় বসে কাগজ-কলম নিল। সবকিছু গোছাতে শুরু করল—শৈশব, প্রেম, বিয়ে, মায়ের অসুস্থতা, হাসানের অর্থকষ্ট, মামার টাকা, সব। ফ্রিজ খুলে দেখল খাবার নেই, শুধু বরফ আর একটা প্যাকেট। খুলে দেখল—একটা মানুষের আঙুল! প্যাকেটের ওপর লেখা ‘QXMRN-2058’। জয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। তাহলে হাসানের নিখোঁজ হওয়ার পর কেউ বাসায় ঢুকেছিল! যার কাছে চাবি আছে… কে সে?
ব্যাগ থেকে পানি বের করতে গিয়ে হাতে এলো রুপার নূপুর—হাসানের উপহার। তাতে কিছু অদ্ভুত অক্ষর খোদাই করা: “YBIFBSBLKJB3”. হাসান বলেছিল এটা একটা কোড। ডিকোড করতে পারলে তাকে এক গোপন জায়গায় নিয়ে যাবে। জয়া তখন পারেনি। এখন মনে হচ্ছে হয়তো সেই কোডের ভেতরেই লুকিয়ে আছে রহস্যের সূত্র।
ঠিক তখনই ফোন ভাইব্রেট করল। অচেনা নাম্বার। ক্লান্ত কণ্ঠে রিসিভ করতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল—
‘কি! সত্যি!!’

Comments
Post a Comment