সাঁঝের বেলা

 অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে এক কাপ কফি খায় রাকিব, এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আজকেও খাচ্ছিল, এমন সময় রূপা এসে ফোনটা দিয়ে গেল ক্রমাগত টেক্সট আসছে।  দূর্দান্ত সুন্দরী আর প্রবল ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন রূপা কখনোই স্বামীর ব্যাক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায় না। হাত বাড়িয়ে ফোন টা নিল রাকিব। নিতু টেক্সট করছে- মুখ তুলে বলল রাকিব,” নিতু আমার স্কুলের ফ্রেন্ড শফিকের ওয়াইফ, আজ একটা কাজে ব্যাংকে এসেছিল, থ্যাংক্স জানাতে টেক্সট করেছে”। ও আচ্ছা বলে রূপা রুমে চলে গেলো। অকারণে সন্দেহ করা রূপার স্বভাব না তবুও রাকিব কেন বোকার মত কৈফিয়ত দিতে গেল জানে না।

রাকিব, ব্যাংকার,  থার্ড জেনারেশান একটা প্রাইভেট ব্যাংকের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সে। ছোটবেলা থেকেই স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েছে, লম্বা সুদর্শন সে। বয়স ৩৫। বছর পাচেঁক আগে তার প্রফেসরের মেয়ে কর্পোরেট কর্মকর্তা রূপাকে বিয়ে করেছে সে, স্মার্ট সুন্দরি আর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রূপাকে রাকিবের শিক্ষক মা ই পছন্দ করেছেন। যে-ই দেখে সেই বলে মানিক জোড়।

প্রফেসর শ্বশুরের দেয়া ফ্ল্যাটে থাকে তারা, রাকিব, রূপা আর ছোট রোদসী। দিনের বেলা ডে- কেয়ার আর রাতে মার কাছে। রাকিব শুনেছিল মেয়েরা নাকি বাপের নেওটা, তার মেয়েটাও তার কাছে ঘেষে না। রূপা ব্যাক্তিত্বের কাছে কোথায় যেন বরাবর হার মেনে থাকে রাকিব। না রূপা ডোমিনেটিং না, রাকিব একটু ইন্ট্রোভার্ট, তার ধারনা সে ভুল সময়ে জন্মেছে, তার আরো ৩০ বছর আগে মফস্বলে কোথাও জন্মালে ভাল হত। মার্কেটিং এর তুখোড় ছাত্র রাকিবের প্রিয় বিষয় সাহিত্য, তার প্যাশান লেখালেখি আর গান। রূপার একেবারেই ইন্টারেস্ট নেই এসবে। উইকএন্ডে রাকিবের পছন্দ বাসায় বসে মুভি দেখা আর প্রিয় গান শোনা। রূপা চায় তার মায়ের দিকের বা কলিগদের বিভিন্ন পার্টি এটেন করতে। মাঝে মাঝে রাকিব ও যায় রূপা আর রোদসিকে খুশি করতে, বেশিরভাগ দিন ই তার ঘুম পায়। প্রায়ই দেখা যায় কোনার দিকের কোন সোফায় হা করে ঘুমাচ্ছে। রূপা ভেবে পায়না, এমন জমজমাট পার্টিতে এত শব্দের মাঝে একটা লোক এমন নাক ডেকে ঘুমিয়ে যায় কি করে। ইদানীং আর তাই রাকিবকে নেয় না সে। এই রাত গুলা রাকিবের খুব প্রিয়, সে অনেক রাত অবধি প্রিয় গান শোনে, বই পড়ে, লেখে। মাঝ রাতে ওরা ফিরে এলে ঘুমায় পরদিন দুপুর অব্দি। রূপা স্ত্রী হিসাবে দায়িত্বশীল, বাসায় কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও সকালে পাশে বসে ব্রেকফাস্ট করিয়ে অফিসে পাঠায় রাকিব কে, অবশ্যই দুপুর ২ টা থেকে ২.৩০ টার মাঝে ফোন করে লাঞ্চ করেছে কিনা রাকিব সেটা ইনশিওর করে। সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে ফিরে নাশতা খায় একসাথে। কিন্তু রাকিবকে ওর কাছে খুব গোমড়ামুখো কিছুটা খ্যাত আর ওল্ড ফ্যাশন্ড লাগে। তার বাবার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল রাকিব, সেই সূত্রেই বিয়ে। রূপার সবসময় মনে হয় আন্ডাররেটেড একটা  ছেলেকে সে বিয়ে করেছে। যদিও রাকিবের ক্যারিয়ার বা পারিবারিক অবস্থান কোন দিক দিয়েই তাদের চেয়ে কম নয় ওরা, তবুও রূপার রাকিবকে কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত লাগে।

অন্যদিকে রাকিবের মনে হয় সে যেন কখনোই পায় নি রূপাকে, কখনোই নিজেকে রূপার সামনে মেলে ধরতে পারেনি সে, খুব আধুনিকা রূপার সাথে তার রুচির পার্থক্য যোজন যোজন।

 তার পুরানো গানের রুচি, সাহিত্যের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ বরাবরই রূপার অবজ্ঞার বিষয়ে পরিনত হয়েছে। আরো বেশি গুটিয়ে গেছে রাকিব। আশ্চর্যের ব্যপার হল তাদের কখনো ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি হয়নি। রাকিবের খুনিশুটি রূপার এত বিরক্ত লাগত যে রাকিব আরো দূরে সরে থাকতে লাগলো। নিজের একটা একাকী জগতে কেন্নোর মত ঢুকে থাকে সে। অফিস বাসা এই তার জীবন। বাসায় থাকলে হেড ফোনে গান। সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে বৈবাহিক সম্পর্ক ঝালাই রুটিন। সেখানেও কোন ছন্দ পায় না রাকিব। বন্ধুদের কাছ থেকে কেন যেন নিজেই পালিয়ে থাকে রাকিব। যদিও সবার ধারনা সুন্দরি সফল বউ আর মোটাবেতনের চাকরির অহংকারে পা পড়েনা রাকিবের।

আজ হঠাৎই তার স্কুলের বন্ধু শফিকের ফোন, তার ব্যাংকে শফিকের শ্বশুরের কিছু টাকা এফ ডি করা ছিল, শ্বশুরের মৃত্যুর পর ওর ওয়াইফ ই একমাত্র ওয়ারিশ তাই টাকা তুলতে যাবে শফিকের বউ নিতু। শফিকের রিকোয়েস্ট রাকিব যেন নিতুকে হেল্প করে, অনেক বড় মুখ করে বন্ধুর কথা বলেছে নিতুকে।রাকিব নিশ্চিন্তে থাকতে বলে শফিককে। স্কুলে শফিকের নাম ছিল হোলি কাউ। অত্যন্ত সরল ছিল মধ্যবিত্ত শফিক।

 শফিকের বউ নিতু সালাম দিয়ে রাকিবের কেবিনে ঢুকলো, রাকিব তার এক জুনিয়র স্টাফকে ডেকে সব ক্লিয়ার করে দিতে বলে মিটিং চলে গেল। যাবার আগে অনেকবার সরি বলেছে সে নিতুকে। মিটিং শেষ করে এসে অবশ্য নিতুকে আর পায় নি, কাজ সেরে চলে গেছে বাসায়। সন্ধ্যায় থ্যাংক্স জানাতে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছিল রাকিব কে-

আমাদের গল্প শুরু এখানে থেকে।

‘আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া থ্যাংক্স’

‘ইটস অল রাইট, আমি সরি থাকতে পারিনি বেশিক্ষন’

‘না ভাইয়া, খুব উপকার হয়েছে আমার’

‘নিতু শফিক কে নিয়ে একদিন বাসায় আসবেন’

‘ভাইয়া তার পোস্টিং তো কুমিল্লায়, আপনি জানেন না।’

‘সরি জিজ্ঞেস করা হয় নি’

গল্প এগিয়ে যায়। রাকিব ভীষন অবাক হয়, নিতুর সব পছন্দ ঠিক তার মতো। নিতুও কবিতা খুব ভালবাসে এবং তাদের প্রিয় কবি ও একই- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। রাকিব আর নিতু কবিতা নিয়ে প্রতিদিন রীতিমতো ঝড় তোলে ম্যাসেঞ্জারে। রূপা তার রুটিনে ব্যাস্ত। রাকিব যেন একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পায় নিতুর সাথে বন্ধুত্বে। এর মাঝে দুইবার শফিক ঢাকায় আসলে ঘুরে এসেছে ওদের বাসা থেকেও। রাকিব খুব অবাক হয়, নিতু মেয়েটা কিভাবে যেন টের পেয়ে যায় তার প্রিয় পছন্দের সব। রান্নার  সময় কী করেই বা বোঝে ভুনা খিচুড়ির সাথে অবশ্যই জলপাইয়ের আচার লাগে রাকিবের। কিভাবে সে যেন জেনে যায় আজ লাল শাড়িতেই দেখতে চাচ্ছিল রাকিব তাকে। শফিকের সাথে আড্ডা তেমন যমতো না রাকিবের, ফিজিক্সের প্রফেসর শফিক কখনোই ওদের কথার মাঝে আগ্রহ পেত না, সে চলে যেত ঘুমাতে/রেস্ট করতে। আড্ডা জমতো রাকিব আর নিতুর। আড্ডা দিতে দিতে প্রায় মাঝরাত হয়ে যেত প্রায়ই। রার ১১ টায় অবধারিত রূপা ফোন- বাসায় আসো। অগত্যা আদর্শ স্বামীর মত  হৃদয় পূর্ণ করে ফিরে যেত নিজের ঘরে। আর নিতু আর নার্ড স্বামীর পাশে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলত কোন এক আরাধ্য রাকিবের জন্য, যাকে পাওয়া যাবেনা জেনেও অর্জনের তীব্র বাসনা অনুভব করতো নিতু।

 ইদানীং রাকিব খুব খুশি খুশি থাকছে। অফিসে যাওয়ার আগে রূপার উপর ভরসা না করে দুইবার আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। প্রিয় পারফিউম টা স্প্রে করে কানের পেছনে। রাকিব এখন জীবনের প্রতি তীব্র আগ্রহ অনুভব করে। অফিসে কাজের ফাকেঁ অজস্রবার চেক করে ম্যাসেঞ্জার।

কী অদ্ভুত ভাল লাগায় ভরে থাকে তার মন। বেনামে কবিতা লেখাটা খুব বেড়েছে তার। লিখার সাথে সাথেই তার চাই নিতুর ফীডব্যাক। ম্যাসেঞ্জারে না পেলে নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে সন্ধ্যায় নিতুর বাসায়। জয়েন ফ্যামিলির বউ নিতুকে ৫ মিনিট কাছে পাওয়াও টাফ। তবু রাকিব সব অগ্রাহ্য করেই যায় নিতুর বাসায়। আজ দূর্দান্ত একটা কবিতা লিখেছে সে, নিতুকে শোনাতেই হবে। সকাল থেকে ম্যাসেঞ্জারে মহারাণি অফলাইন। ফোনেও পাচ্ছেনা। আষাড়ের বৃষ্টিতে আজ তার ব্যাংকে কাজ ও কম। রাকিব তাই একটু আগেই পৌছে যায় নিতুদের বাসার সামনে। শফিকদের মগবাজারের এই বাসাটা অনেক পুরানো। গাড়িবারান্দা পার হয়ে দোতালায় শফিকেএ ফ্ল্যাটের সামনে আসতেই কারেন্ট চলে যায়। পুরানো এই বিল্ডিং এ জেনারেটর ও নেই। দরজায় নক করে রাকিব। পুরানো ধ্যান ধারনায় চলা শফিকদের বাসায় সাধারনত গেট খোলেন শফিকের বাবা কিংবা কাজের খালা। কিন্তু আজ রাকিবকে অবাক করে দিয়ে গেট খোলে নিতু, হাতে মোমবাতি। নিতুর চুল ভেজা, আর সে ভেজা চুক থেকে আসছে ডাভ শ্যাম্পুর তীব্র ঘ্রাণ(যেটা সে পরে জিজ্ঞেস করে জেনেছে)। রাকিবের মনে হতে থাকে এই দৃশ্য কোন পার্থিব জগতের না, নিতু কোন স্বর্গের অপসরি। বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে রাকিব। হাটুঁ গেড়ে বসে নিতুর সামনে।

নিতু দু’পা পিছিয়ে যায়, রাকিব কাপাঁ গলায় বলে উঠে নিতু আমি তোমাকে ভালবাসি। এরপর আর কোন কিছু মনে নেই রাকিবের, ঘোর লাগা সে সন্ধ্যায় রাকিব নিজেকে আবিষ্কার করে নিতুর মাঝে নতুন করে, নিতুও গ্রহন করে রাকিব কে প্রবল আবেগে। যখন ঘোর কাটে তখন বাসা থেকে রূপার ফোন, বৃষ্টির মাঝে কোথায় তুমি, বাসায় আসো। নিতুর উষ্ণতা ছেড়ে বাড়ী ফিরে রাকিব। আর নিতু….রাকিবের ঘোরে হারিয়ে ভুলেই গিয়েছিল আজ বাসায় একা সে…….

নিতুর কথা...

ছোট বেলা থেকেই ভীষন চুপচাপ নিতু। কিন্তু খুব জেদী। মধ্যবিত্ত বাবার ২ মেয়ের মধ্যে বড় সে, বাবা-মায়ের সব স্বপ্নপূরণ যেন তাকেই করতে হবে, সব যেন তাকেই বুঝতে হবে। তার অন্য বন্ধুরা যখন স্কুল থেকে ফিরে খেলতে যেত কিংবা ঘুমাতো, নিতু মায়ের সাথে সাথে রান্না ঘরের কাজে সাহায্য করে যেত। নিতু তাই মায়ের চোখের মণি। নিতুর একমাত্র শখ বই পড়া। এলাকার লাইব্রেরি,  বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র সবই তার প্রিয় জায়গা। তের-চৌদ্দ বছরেই নিতু যেন কিভাবে অনেক অনেক বড় হয়ে গেলো। বোনদের দেখে শুনে রাখা, পড়াশোনায় সাহায্য করা সবই সে সামলাতো। বাবার সামর্থ্য ছিল না তিন মেয়েকে টিচার রেখে পড়ানোর, আর তাই নিতুকে আর্টসেই পড়াতে চেয়েছিলেন বাবা, তাহলে অন্তত টিচারের খরচ টা কমবে। নিতু এই প্রথম বাবা- মায়ের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সায়েন্স পড়ার জন্য বেঁকে বসেছিল। এবং জানিয়েছিল তার জন্য কোন টিচার লাগবে না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এস এস সি তে সে সায়েন্স থেকে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট করে বসলো।  বাবা-মা খুব খুশি। মা তো অনেকক্ষণ শুধু কাঁদলেন,। নিতুও কাদঁলো মা কে ধরে। বাবা এবার সাহস করে স্বপ্ন ও দেখা শুরু করলেন তার এই মেয়ে হয়ত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিছু হবে। নিতু যে খুব অদ্ভুত একটা মেয়ে, আবারো সবাই দেখলো যখন নিতু দেশ সেরা কলেজে ভর্তি হল আর্টসে। বাবা রাগ করে এক সপ্তাহ কথা বললেন না। নিতু, এক সপ্তাহ পরে বাবাকে গিয়ে বলল- 'বাবা কথা বলছ না কেন, সায়েন্সে পড়লেই কী আমি তোমার মেয়ে আর না পড়লেই কী তা নই" 'বাবা শোন আমার সায়েন্স আর ভাল্লাগছে না, আমি ডাক্তার হতে পারবো না বাবা, বাবা আমি সাহিত্য পড়তে চাই" প্লিজ তুমি রাগ করোনা।  

মেয়ের কথার কাছে হার মানলেন সিদ্দিক সাহেব।মেনে নিলেন মেয়ের জেদ। এইচ এস সি তেও খুব ভাল রেজাল্ট করে নিতু। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সাইকোলজিতে পড়ার সময় পাশের পাড়ার ৪ বছরের সিনিয়র শফিকের মত নার্ডের প্রেমে পড়ে যায় সে, হয়ত শফিকের সারল্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। সে যখন থার্ড ইয়ারে শফিকের বি সি এস হয়ে যায়। সরকারি কলেজে প্রভাষকের চাকরি পেয়েই বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠে শফিক। অগত্যা অনার্স শেষের আগেই বিয়ে করে শফিকের একান্নবর্তী পরিবারে চলে আসে নিতু। বিয়ের পরই নিতু বুঝতে পারে কী ভুল টাই না সে করেছে! শফিক শুধু সরল ই না সে একজন ওয়ার্কোহোলিক, গোঁয়ার, ক্যারিয়ার পাগল এবং বোকা। শফিকের প্রথম পোস্টিং ছিল সিলেটের এম সি কলেজে। নিতু স্বপ্ন দেখতো তাদের প্রথম ঘর হবে চা বাগানে ঘেরা কোন জায়গায়, সন্ধ্যায় দু'জন হাটতে বের হবে, তারে ছাদে বসে গান শুনবে। নিতুর প্রথম স্বপ্ন ভংগ হয়, যখন শফিক নিতুকে ঢাকায় রেখে যায়। সদ্য বিবাহিতা নিতুর জন্য একান্নবর্তী পরিবারের বিরাট সামাজিক দায়িত্বটা বড্ড বেশিই হয়ে যায়। নিতুর একমাত্র প্যাশান ছিল বই পড়া, এই সংসারে এসে প্রথমেই তার বই পড়ার উপর বাধা আসে। নিতু খুব অবাক হয় এমন শিক্ষিত এক পরিবারে একাডেমিক বই পড়ার বাইরে বই পড়াটাকে সময়ের অপচয় হিসাবে দেখা হয়, শুধু তাই নয়, এই পরিবারে মেয়েরা একটা সাবমিসিভ জাতি, সবার খাবারের পর তারা খেতে বসে, এমনকি নিতু ক্যান্সার পেশেন্ট শাশুড়িও পুরুষদের খাবার হবার পর খেতে বসেন। শফিক প্রথম দিকে সপ্তাহে একদিন আসতো, বৃহস্পতিবারে রাতে ফিরে সে এক লম্বা ঘুম দিয়ে শুক্রবার দুপুরে উঠে জুম আর নামাজ পড়ে লাঞ্চ করত। লাঞ্চের পর শফিকের ৩ ভাই আর বাবা মিলে বসে পারিবারিক আলোচনা, শফিকের বড় ভাইয়ের ওয়াইফ লতা ভাবি খুব আমুদে প্রকৃতির মানুষ কিন্তু একটু মোটা দাগের। এস এস সির পর বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারনে আর পড়া হয়ে ওঠেনি, এর সাথে নিতু খুব বেশিক্ষন গল্প চালিয়ে যেতে পারতো না। এই বাসায় নিতুর এক মাত্র বন্ধু ছিল শফিকের জমজ বোন শান্তা আপু, শান্তা আপু জন্মের পর ই পোলিওর কারনে পায়ে কিছুটা সমস্যা হওয়ায় খুড়িয়ে হাটতেন। অজ্ঞাত কারনে বাসার কেউ ই এমনকি শফিক ও তাকে দুইচোখে দেখতে পারতো অথচ শান্তা আপুর ব্যাক্তিত্ব ছিল দারুন,খুব সুন্দর গান গাইতে পারতেন। শফিকের বাবা জোর জবরদস্তি করে উনাকে মোটা টাকার বিনিময়ে এক বয়ষ্ক ডিভোর্সি লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে তার খোড়া মেয়ে কে নিবে? শান্তা আপুর হাসবেন্ড অত্যন্ত বদমেজাজি মানুষ ছিলেন। কারনে অকারনে গায়ে হাত তুলতেন এবং গালাগালি করতেন।শান্তা আপু বিয়ের ৮ মাসের মাথায় ফেরত আসেন বাবার বড়িতে এবং সিদ্ধান্ত জানান তিনি আর ফেরত যাবেন না।তিনি নিজের একক চেষ্টায় পড়াশোনা চালিয়ে যান, এই বাসায় কারো সাপোর্ট তো তিনি পান ই নি বরং পেয়েছেন নিদারুন অসহযোগিতা। এমনকি নিতুর  শাশুড়ি ও তার মেয়ে কখনো এক বিন্দু সাপোর্ট করেননি. নিতুর বিয়ের প্রথম দুই বছর ওর সার্বোক্ষনিক বন্ধু ছিলেন শান্তা আপা। শফিকের সাথে দুরত্বটা বাড়ছিল শফিকের ব্যাস্ততা আর উদাসিনতায়। শান্তা আপুর চেষ্টা আর উৎসাহে কোনরকমে অনার্স পাশ করে নিতু ২বছর লেইটে।

এর মাঝে শাশুড়ির শরীর আরো খারাপ হতে থাকল, পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল শফিকের ব্যাস্ততা, ইউ কে তে পি এইচ ডির ফান্ডিং পাওয়ার চেষ্টায় বিভোর শফিক যেন নিতুকে অলমোস্ট ভুলেই বসল। অনিয়মিত দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝেই কন্সিভ করলো নিতু, হঠাৎ ই বদলে গেল যেন বাসার আবহাওয়া, সবাই এত খুশি, শফিকের বড় ভাইয়ের কোন সন্তান নেই। তাই নিতুকে নিয়ে সবার অতিরিক্ত মনোযোগ। শুধু ভ্রুক্ষেপ নেই শফিকের, ভীষন নির্লিপ্ত সে, আই ই এল টি এসের প্রিপারেশান নিয়ে মহা ব্যাস্ত। প্রেগন্যান্ট বউ এখন তার বিরক্তি উৎপাদন করছে শুধু। শফিকের বিরক্তি আরো বাড়িয়ে দিয়ে শফিকের মা আমেনা বেগম মারা গেলেন। শফিকের প্রিপারেশান বাধাঁগ্রস্থ হবে বলে মায়ের জানাজা পড়েই সিলেট চলে গেল শফিক। নিতুর শরীর দিন দিন খারাপ হতে লাগলো, শফিকের বাড়ি আসার সময় নাই, শান্তা আপাও একটা ভাল স্কলারশীপ যোগাড় করে পাড়ি জমালেন মালয়শিয়া। নিতু বড্ড একা হয়ে গেল, নিতুর বাবা- মা শফিকের বাবাকে অনেক অনুরোধ করে নিতুকে নিয়ে গেল তাদের বাসায়। জুলাই মাসের এক দুপুরে কী মনে করে বৃষ্টিতে ছাদের কাপড় আনতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল নিতু। 

ইমার্জেন্সি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন নিতুর বাবা- মা। পাক্কা ৩ দিন পর নিতুর যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন তার ছোট দুই বোন তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, নিতু কিছুই মনে করতে পারছিল না। হঠাৎই তার  নেমে যাওয়া পেটের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো জীবনের প্রথম পেতে যাওয়া অমূল্য উপহারকে হারিয়ে ফেলেছে সে। ডুকরে কাদঁতে লাগলো নিতু। মা এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন নিতুকে। নিতু খুজতে লাগল শফিককে। নিতুর ভাসুর আর জা জানালেন শফিকের সিনিয়র স্কেলের কোন একটা পরীক্ষার জন্য আসতে পারেনি সে, কাল রাতে আসবে। 

হাসপাতাল থেকে সোজা শ্বশুরবাড়িতে ফিরল নিতু, মা-বাবা অনেক জোর করা সত্বেও কিছুতেই আর ও বাসায় গেলো না নিতু। শ্বশুরবাড়িতে এসে প্রথমাবারের মত শফিকের সাথে সিলেটে যেতে চাইল  নিতু। কী ভেবে যেন না করলো না শফিক। সিলেটে গিয়ে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখত নিতু প্রায় রোজ রাতেই, স্বপ্ন টা খুব নিষ্ঠুর । নিতু দেখতো এক ফুটফূতে সন্তানের মা হয়েছে নিতু। শফিক সে সন্তান কে গলা টিপে মারছে। প্রতিদিন একই স্বপ্ন দেখে মাঝ রাতে ঘুম ভাংতো নিতুর। অবস্থা এমন দাড়ালো যে শফিককে সহ্যই করতে পারছিলো না নিতু। শফিক একবার ভাবলো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবে, তারপর ভাবলো সবাই তাহলে তার বউকে হয়ত বা পাগল ভাববে। তারচেয়ে বরং কিছুদিন সময় দিয়ে দেখা যাক, এই ভেবে ঢাকায় তাদের বাড়িতে নিয়ে এলো শফিক। বাসায় এসে অতিরিক্ত হাসিখুশি হয়ে গেলো নিতু, কিন্তু শফিকের ধারে কাছে সে ঘেষে না। শফিক ও অনেক চেষ্টায় একটা স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেলো নেদারল্যান্ডসে।  যদিও সে নিতুকে সাথে নেয়ার অনেক ট্রাই করল, নিতু কিছুতেই তার সাথে গেলো না।  শফিক ও ভাবলো হয়ত তাদের এই দূরে থাকাটা নিতুর জন্য ভাল হবে, আশায় থাকল নিতু নিজেই হয়ত তার কাছে যাবে কখনো। শফিক চলে যাওয়ার পর মাস্টার্সে আবার ক্লাস শুরু করে নিতু, তার সব মনোযোগ তখন ক্লাস আর পরীক্ষায়। মাস্টার্স পরীক্ষার কয়দিন আগে তার ছোটবোন নিম্নি পাড়ার এক বখাটে ছেলের সাথে পালালো আর সেই শোকে বাবা স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে পড়ল।

নিতুর মাস্টার্স ফাইনালের ভাইবার দিন সকালে মারা গেলেন নিতুর বাবা। চোখের জল মুছে শক্ত হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল নিতু। আত্মীয় স্বজন বলতে এক চাচা ছাড়া তেমন কেউ ছিল না নিতুর। নিতুর চাচা আর ভাসুরই দাফন সহ সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছিল। নিতু থেকে গেলো মায়ের কাছে। নিতু ভাবছিল মাকে কোথায় রাখবে, একা মাকে রেখে যেতেও পারবেনা। অথচ শ্বশুরবাড়িতে তার কাছেই বা কিভাবে রাখবে? নিতু ভাবছিল শফিকের সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবে, কিন্তু সকাল থেকেই শফিকের নেদারল্যান্ডের ফোন নাম্বার বন্ধ। নিতুকে ভীষন অবাক করে দিয়ে পরদিন বিকালে শফিক এসে হাজির। খুশি হবার বদলে কেমন যেন রাগ লাগলো নিতুর। তবুও খুশি হল এই ভেবে যে মাকে তার কাছে রাখার প্ল্যান টা সে শফিকের সাথে সামনা সামনি ই করতে পারবে। এম্নিতে এবার বিদেশ থেকে আসার পর শফিক আগের চেয়ে অনেক সাবলীল। তাই সাহস করে মা’কে নিজের কাছে কথাটা শফিককে বলেই  ফেলল নিতু, কিন্তু স্বল্পভাষী শফিক অবাক হয়ে বলল যে তার মায়ের দায়িত্ব শফিক কেন নিতে যাবে! নিতুকে সময় দিতেই সে দেশে এসেছে, তার মায়ের দায়িত্ব নিতে নয়। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নিতু আর একটি কথা বলেনি। শফিক অবশ্য এ নিয়ে আর কথাও  বাড়ায়নাই। শফিক ভাবলো মিটেই গেছে হয়ত ঝামেলা। নিতুর মায়ের সাথে মাঝে মাঝে গল্প ও করছে, খোজখবর ও রাখছে। তবু মনে হতে লাগলো শফিকের সবই করছে কেমন যেন আন্তরিকতাহীন ক্ষতিপূরনের চেষ্টা হিসাবে। রাতে শফিক ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে নিতুর কেমন যেন গা গোলানো ঘিন ঘিন করতে লাগলো, তার মনের কোনে এখনো সন্তান হারানোর বেদনা রয়ে গেছে। আর সে প্রচ্ছন্নভাবে তার সন্তান হারানোর জন্য শফিককেই দায়ী করে। নিতুর সবসময় মনে হয়, শফিক তাকে সে সময় সাপোর্ট দিলে আজ হয়ত তাদের মাঝে তাদের সন্তান টা থাকতো। শফিক নিজেও সে ঘটনার জন্য অনুতপ্ততা বোধ করে। নেদারল্যান্ডস এ পি এইচ ডির মাঝ পথে সে ফিরে আসে দেশে নিতুকে সময় দেবে বলে আর নিজের করা অবহেলার ক্ষতিপূরন করবে বলে। আর সুপারভাইজার কে সে ম্যানেজ করে থিসিস টা সে দেশে বসেই করবে বলে, আর সে জানায় ফাইনাল সাবমিশান আর ডিফেন্সে সে আবার ফেরত যাবে নেদারল্যান্ডসে।

নিতু ইদানিং শফিককে এড়িয়ে চলে, শফিক কাছে আসলেই কেমন কুকড়ে যায়। শফিক অনেকবার তাকে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য বলে, কিন্তু নিতু কেন জানি শফিকের সাথে আর স্বাভাবিক হতে পারেনা। তবু নিতু রাজি হয় শফিকের সাথে সেইন্টমার্টিন ট্যুরে যেতে। শফিক অনেক আগ্রহের সাথে পুরা ট্যুর প্ল্যান করে। ট্যুরে যাবার দিন সকালে চাচার বাসায় মারা গেলো নিতুর মা। মায়ের মৃত্যুর পর  নিতু পুরাপরি চুপ হয়ে গেলো। এই দুনিয়ায় কারোরই কিছু যায় আসলো না তাতে। কেবলি শফিকের সাথে শীতল সম্পর্ক টা বরফের মত আরো জমে গেলো শুধু.

 

 

 

রাকিবের কথা...

উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান রাকিব। বাবা ইঞ্জিনিয়ার আর মা শিক্ষিকা। শিক্ষিকার মায়ের ছত্রছায়ায় ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনা আর এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিতে দারুন ছিল রাকিব। স্কুলের সেরা ছাত্র না হয়েও, সবার আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতো রাকিব। বাবা ছিলেন ভীষন রাশভারি কিন্তু বন্ধুত্ব পরায়ণ। সব মিলিয়ে সুখি স্বচ্ছল পরিবারের রাকিব, সমবয়সীদের ঈর্ষার কারন ছিল ছোট থেকেই। ঈর্ষার কারনেই হয়তো রাকিবের কখনোই খুব একটা ভাল বন্ধু নেই। রাকিব এম্নিতে বাইরে এক্সট্রোভার্ট হলেও নিজের একটা জগতে সে বাস করতো। রাকিবের মা সাজেদা আনোয়ার ছিলেন রাকিব দের পাশের স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল। মায়ের কড়া নজরদারি আর একমাত্র সন্তান হওয়ায় অতিরিক্ত মনোযোগে রাকিব সবসময়ই কেমন যেন আড়ষ্ট বোধ করত, যদিও তার মা কখনোই তাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেনি বরং বন্ধুদের ব্যাপারে অনেক বেশি ছাড় দিতে চাইতেন তবু কেন জানি রাকিব মায়ের সামনে কখনোই স্বতঃস্ফুর্ত আচরন করতে পারতো না। রাকিবের কাছের বন্ধু বলতে আসলে তেমন কেউই ছিল না, যারা ছিল তারা কেবলই শুধুই ক্লাস মেট বা সময় কাটানো বন্ধু। স্কুল শেষ করলো রাকিব, ভর্তি হলো কলেজে। কলেজে পড়া চলাকালিন সময় থেকে পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেছিল রাকিব। রাকিবের লেখার মজার ব্যাপার ছিল গল্প, উপন্যাস, কবিতা সব কিছুতেই সে সাবলীল। কিন্তু মানুষের সাথে কমিউনিকেশানে কেন জানি সবসময়ই তার বড্ড সমস্যা হয়। কলেজ জীবন শেষ করে দেশের প্রথম সারির একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং মেজরে বি বি এ , এম বি এ করে রাকিব। যদিও তার ইচ্ছা ছিল কোন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, কিন্তু রাকিবের মায়ের ধারনা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলামেলা পরিবেশে রাকিব নষ্ট হয়ে যাবে। বি বি এ পড়ার সময় ই বাবাকে হারাইয় রাকিব। এম বি এ করার পর চাকরি পেতে একটুও বেগ পেতে হয় নি রাকিবের। বলা যায়, রাকিবের জীবন টা ঠিক তেমনই কেটেছে যেমন টা তার মা চেয়েছে। মায়ের ব্যাক্তিত্ত্বের ছায়ায় থাকার কারনে রাকিবের কখনই প্রবল ব্যাক্তিত্বের প্রকাশ ঘটেনি। প্রেমের ক্ষেত্রেও রাকিব কেন জানি মায়ের মুখাপেক্ষি থাকাটাকেই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত মনে করেছে সবসময়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে দুই একজন ক্লাসমেট বা জুনিয়রদের ভাল লাগলেও , মায়ের হয়ত পছন্দ হবেনা ভেবে আর বেশিদুর আগায় নি সম্পর্কগুলো। এম বি এর পরপর চাকরি নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাকিব, লেখালেখিটা ও কমে যায়, রাকিবের মা তার লেখালেখিটা অপছন্দ না করলেও কখনো উৎসাহিত ও করেন নি। বলা যায়, এই বিষয়ে তার এক ধরনের শীতলতা ছিল। রাকিবের এক মাত্র রিলিফের জায়গা ছিল বই পড়া আর লেখালেখি। বাবার মৃত্যুর পর মা কেমন যেন চুপ হয়ে গেল, রাকিব কে নিয়েও আর তার মাথা ব্যাথা খুব একটা নেই। তিনি নিজেও এক সময় রিটায়ার্ড করলেন। রাকিবের বিয়ের প্রশ্নে তিনি যদিও মুখে বলেছিলেন রাকিবের পছন্দই শেষ কথা, তবু, নিজের পছন্দেই রাকিবের প্রফেসরের মেয়েকে বাছলেন। এই ক্ষেত্রে বলা যায় রাকিবের মা আবারো খুব সুক্ষ বৈষ্য্যকিতার বিচারে রূপাকে বাছাই করলেন। রূপা, তার প্রফেসর বাবা মায়ের ছোট মেয়ে, রূপার বড় বাই প্রবাসী , কখনোই দেশে আসবেনা। রূপার বাবা-মায়ের প্রায় সব প্রপার্টি বলতে গেলে তারই, তাছাড়া রূপা নজরকাড়া সুন্দরি, ভাল কর্পোরেট জব করে, ভদ্র, মার্জিত। বলতে গেলে রাজকণ্যা আর আর্ধেক রাজত্ব দুইটাই পাবে তার একমাত্র সন্তান রাকিব। রাকিব কে অবশ্য বিয়ে ঠিক করার পর বেশ কয়েকদিন কথা বলার ও ডিসিশান নেয়ার সময় দিয়েছিলেন। রাকিব বরাবরই ইনডিসিশানে ভোগে, তার উপর সারাজীবন কোন মেয়ের খুব কাছেও যায় নি সে। ওতো চোখ ধাঁধানো সুন্দরীর কাছে যাওয়াটা তার কাছে বিরাট নতুন এক অভিজ্ঞতা, সে নতুনত্বের আলোয় চাপা পড়েই গেলো , যে আবারো কোন এক প্রবল ব্যাক্তিত্ববতী নারীর ছায়াতলেই সে তার সামনের দিন গুলো কাটাতে যাচ্ছে। কিন্তু রূপার কেন যেন রাকিবের অত্যধিক সারল্য আর লাজুক ভাবটা ভাল লেগে গেলো, সুদর্শন রাকিবের উদাসি চোখের প্রেমে পড়ে গেলো সে। যদিও সে রাকিবের হতবুদ্ধি হওয়াটাকে পছন্দ করতে পারলো না। তবুও দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে টা হয়েই গেলো। বিয়ে- বউভাতের ধকল সামলাতে না সামলাতেই তারা উড়াল দিল বালি তে হানিমুনের জন্য। হানিমুনের দিনগুলোতেই রাকিব বুঝে গেলো তার মস্ত ভুল হয়ে গেছে, রূপা আর সে দুইজনই ভিন্ন ঘরানার দুইজনের মানুষ। রাকিব চায় শান্ত ভাবে চুপচাপ পাশাপাশি থেকে সময় টা কাটাতে, রূপার চাওয়া ঘুরে বেড়ানো , পার্টি করা, এক্সপ্লোর করা। রাকিবের নাভিশ্বাস উঠে যায় রূপার সাথে, যদিও বুঝতে দেয়া না কিছু। এত নিয়ম মাফিক জীবন রাকিবের হাঁসফাঁশ লাগে। রাকিবের বিয়ের পর পরই রাকিবের মা তাদের গ্রামের বাড়িতে মেয়েদের জন্য এক কলেজের কাজ হাতে নেয়, এর জন্য তিনি ছেলের বউয়ের কাছে সংসার ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে, রাকিব অনেক অনুরোধ করে, কিন্তু মা বুঝিয়ে বলেন কাজে ব্যস্ত থাকলেই তিনি ভাল থাকবেন। রাকিবের মা গ্রামে যাওয়ার মাস ছয়েক পরে ই কনসিভ করে রূপা, আর সে খুশিতে মেয়েকে বিলাস বহুল ফ্ল্যাট গিফট করেন মেয়ের বাবা। রাকিব শান্তিনগরে তাদের নিজেদের বাড়ি ছেড়ে সেখানে কিছুতেই উঠতে চাইছিল না, রূপার জেদ আর প্রবল ব্যাক্তিত্বের কাছে হার মানে রাকিব। তার বাবার বানানো ডুপ্লেক্স ছেড়ে বেইলি রোডের ফ্ল্যাটে উঠে তারা। এই বাড়িতে এসে রাকিব কেন যেন আরো দুখি হয়ে পড়ে। তার শৈশব কৈশোরের বাড়িতে তার ছোটবেলা ফেলে আসতে তার বুক ফেটে যাচ্ছিল, ঐ বাড়ী র ছাদের তার এক টা নিজস্ব ঘর ছিল, যেখানে সে নিজের মত থাকতে ভালবাসতো সে। নতুন ফ্ল্যাটের চাকচিক্যে নিজেকে খুব একা লাগে রাকিবের। রূপা অবশ্য অবিবেচক নয়, রাকিবের জন্য তাই এই এই বাড়ির এক টা গেস্ট রুম বরাদ্দ দেয় সে স্টাডি হিসাবে। রাকিব খুশি হয়, কিন্তু অন্যদিকে তার প্রবল বিতৃষ্ণা জাগে, নিজের উপর। নিজের কোন চাওয়াই সে কোন দিন প্রকাশ করতে পারেনি। স্টাডিটা রাকিবের এক মাত্র দম ফেলার জায়গা ছিল। রাকিবের জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন ছিল যেদিন তার মেয়ে রোদসী জন্ম নেয়, রাকিব ই তার নাম রাখে রোদসী। আলো ঝলমলে রৌদ্রময় দিনে জন্মালো রোদসী। ছোট্ট রোদসীকে পেয়ে যেন প্রাণ পেল রাকিব, অফিস থেকে ফিরেই তার সব ব্যাস্ততা রোদসীকে নিয়ে, সবাই বলতো রোদসী দেখতে নাকি হুবুহু রাকিবের মত। কিন্তু রাকিবের মনে হয় সে দেখতে রূপার মত। রোদসীকে নিয়ে রাকিবের অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস টা আদিখ্যেতা লাগে রূপার। রূপার ধারনা রাকিবের অতিরিক্ত আদর-আহ্লাদে বিগড়ে যাবে রোদসী আর তাই রাকিবের কাছে থেকে খুব সূক্ষ্মভাবে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে ফেলে রোদসীকে। রাকিব ও গুটিয়ে যায় নিজের মধ্যে। রূপাকে নিয়ে অভিযোগের কোন জায়গা নেই রাকিবের। শুধু রূপার মনের কোন খোঁজ সে পায় না, বড্ড বেশি আর্টিফিশিয়াল লাগে তার রূপাকে। রূপা ই বা কবে তার মনে খোঁজ জানতে চেয়েছিল!! দীর্ঘশ্বাসে চাপা পড়ে গেছে আপাত দৃষ্টিতে পারফেক্ট একটা বিবাহিত সম্পর্কের উষ্ণতা।

নিতুর নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ ই রাকিব আসাটা বেশ রোমাঞ্চকর। শফিকের স্কুল বন্ধু রাকিব, শফিকের কাছে অনেক গল্প শুনেছিল নিতু রাকিবের এক সময়। রাকিব কে স্কুলে হার্টথ্রব রাকিব বলতো শফিকরা, অত্যন্ত সুদর্শন রাকিবের গানের ছিল চমৎকার, গিটার বাজাতো। শফিক বরাবরি রাকিবের ব্যাপারে উচ্ছসিত প্রশংসা করেছে স্ত্রীর কাছে। শফিকের রেফারেন্সে রাকিবের সাথে যখন নিতুর দেখা হলো, নিতু তখন ভগ্ন হৃদয়ের এক বিপর্যস্ত তরুনী। রাকিবের সদা হাস্যোজ্জল শৈল্পিক মন মানসিকতায় নিতু এক ধরনের রিলিফ খুঁজে পাচ্ছিল। রাকিবের কবিতা, রাকিবের শিশু সুলভ চপলতা নিতুর সাথে রাকিবের দ্রুৎ বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। ভোজন প্রিয় রাকিবকে খাওয়াতে ভাল লাগতো নিতুর। রাকিবের জন্যই নিতুই আবার রান্না ঘরে ঢোকে। শফিকের খাওয়ার ব্যাপারে খুব একটা শৌখিনতা নেই বলে খুব একটা রান্না ঘরে যাওয়া হয় নি নিতুর। শফিকদের বাসায় রান্নার লোক থাকায় নিতুর ও কখনোই রান্নার প্রয়োজন হয়ে পড়েনি। কিন্তু রাকিব যেদিন এই বাড়ীতে আসত খুব আবদার করতো এটা ওটা খাবার জন্য, মাস দুয়েকের মধ্যেই রাকিবের খাবার রুচি বুঝে যায় নিতু আর রাকিবের জন্য রাঁধতে গিয়ে বাসার সবার জন্যই মাঝে মাঝে টুকটাক রান্না করে সে বাসার সবার জন্য। শফিক ও বেশ আগ্রহ করে তার রান্না খায় যদিও রাকিবের মত উচ্ছসিত প্রশংসা কখনোই কেউ করেনা। রাকিব মাঝে মাঝে বাসায় আসলে নিতুর ভালই কাটে সময় কাটে, নিতুর মত রাকিবের ও প্রিয় বিষয় কবিতা। রাকিবের লেখার হাত চমৎকার। নিতু মুগ্ধ হয়ে শোনে রাকিবের ভরাট কন্ঠের আবৃত্তি। রাকিবের আসা যাওয়ায় নিতুর মন ইদানিং কিছুটা ভাল লাগে বলে রাকিবের এই বাসায় নিয়মিত যাওয়া আসা আর নিতুর সাথের বন্ধুত্ত্বটা শফিক ও খুব আন্তরিক ভাবে নেয়।

রাকিবের ছোটভাই সাকিবের বাসায় সেদিন দাওয়াত ছিল বাসার সবার, প্ল্যান ছিল সবাই রাতে ওই বাসায় থাকবে, নিতুর খুব জ্বর থাকায় যাওয়া হয় নি তার, শফিকও ছিল কর্মস্থলে, সে সন্ধ্যায়, জ্বর কাটাতে গোসল করছিল নিতু, তখনই গেট কেউ একজন নক করে, বেশ কয়েকবার নক করার পর গেট খোলে নিতু। দেখতে পায় আকাশি নীল শার্ট পরা রাকিবকে, রাকিব কেমন যেন ঘোর লাগা চোখে দেখছিলো নিতুকে। হঠাৎ ই হাটু মুড়ে বসে ঘোর লাগা গলায় রাকিব তাকে বলে ‘নিতু তোমাকে ভালবাসি”। নিতুর মনে হচ্ছিল এই কথাটা শোনার জন্যই তার এই জন্মের অপেক্ষা, আশে পাশে যেন সব দুলে উঠলো নিতুর। কি মনে করে রাকিবের মাথাটা জড়িয়ে ধরেছিল সে বুকের সাথে। এরপরের কয়েক ঘন্টায় রাকিব আর নিতু ভেসে চলল যেন প্রজাপতির মত। বহুদিনে চাপা পড়া স্বতঃস্ফূর্ততা আজ যেন বাঁধ ভাঙ্গা আবেগে পরিনত হয়। কখন যে প্রায় মাঝরাত হয়ে যায় টের পায় নি আজ কেউই। উভয়ে সম্বিত ফিরে পায় যখন রাকিবের ফোনে কল আসে রূপার ‘’ কোথায় তুমি? বাসায় আসো’ রাকিব দ্রুত নিতুর উষ্ণতা ছেড়ে ফিরে যায় রূপার কাছে। একটু বেখাপ্পা লাগে রাকিবের নিতুর, কিন্তু সদ্য শেষ হওয়া প্রেমের উত্তেজনায় ব্যাপারটাকে একদম ইগ্নোর করে যায় সে। রাকিব কিছু না বলে রীতিমত দৌড়ে বের হয়ে যায়।

সে রাতে নিতু একা থাকার সুবাদে অনেক্ষন একা অদ্ভুত ভাল লাগা নিয়ে কাটায়, কিছুক্ষন কাঁদে ও একা, সে কান্না সুখের না অসুখের নিজেও বুঝতে পারেনা। রাকিবের স্পর্শ আর আবেগে নিজেকে তার অসম্ভব সুখি মনে হতে থাকে। মনে হতে থাকে কত নারীর আরাধ্য রাকিব কিনা ওমন পাগলের মত ভালবাসে তার মত আটপৌড়ে শ্যমা এক নারীকে। তাদের বাস্তবতা, সংসার ভবিষ্যৎ সব ছাপিইয়ে নিতু কেবলই তীব্র প্রেম অনুভব করে রাকিবের। সে ভেবেছিল আজ রাত টা রাকিব হয়ত তার কাছেই থাকবে। কিন্তু হঠাত রাকিবের ফিরে যাওয়া কিছুটা হতবিহবল যে করেনি এমন নয়। কিন্তু, বহুদিনের ক্ষরতপ্ত মরুতে ঝোড়ো হাওয়া অ্যার বৃষ্টীর দমকায় হারিয়ে গিয়েছিল সব শংকা আর ভয়, সেখানে ছিল কেবলই ভালবাসার সোঁদা গন্ধ। আনমনে রাকিবের কথাই ভাবছিল, ঘড়ি ফেলে গেছে সে। গুছিয়ে রাখল রাকিবের ঘড়ি নিতু। ঠিক তখনই রাকিবের মোবাইল থেকে একটা এস এম এস আসে ‘সরি’।

 

নিতু ভেবে নিলো ওভাবে মাঝ রাতে তাকে একা ফেলে যাওয়ায় বোধ হয় বোধদয় হয়েছে সাহেবের। যাক, তবুও তো ‘ সরি’ হয়েছেন। অনেক টা তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলো নিতু। পরদিন সকালে নিতুর ঘুম ভাংলো অনেক বেলা করে, মোবাইল চেক করে দেখলো মোবাইলে অপারেটরদের কিছু প্রমোশনাল এস এম এস ছাড়া আর কোনই এস এম এস বা ফোন কল নেই। রাকিব সাধারনত সকালে গুড মর্নিং ম্যাসেজ পাঠায়, কিন্তু আজ কিছুই নেই। নিতু ভাবে হয়তো রাকিব ও আজ দেরি করেই উঠেছে কিংবা কাল রাতে দেরি করে ঘুমিয়ে হয়ত অফিস যেত দেরি হয়েছে। নিতু ব্রেক ফাস্ট করতে বসে ফোন দেয় রাকিব কে। আন রিচেবল বলছে। ভ্রু কুচকে কিছুটা বিরক্ত হয়, আবারো ডায়াল করে সে, উহু ফোন আনরিচেবল। মানে কী? ফোন বন্ধ!! কাল রাতে ঠিকমতো পৌঁছেছিল তো বাসায়!! ভাবে আজ বিকালে নিশ্চয়ই আসবে রাকিব। অপেক্ষা করে নিতু।

রাতে নিতুর সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর সময় হঠাৎ স্ত্রীর ফোনে সম্বিত ফিরেছিল রাকিব। কিছুটা রূঢ ভাবেই সে নিতুকে ফেলে চলে এসেছিল নিজের ঘরে। নিজে ড্রাইভ করে বলে সবসময় সতর্ক হয়ে চালাতে চায়, তাই বাসার লিফটে ওঠার সময়ই নিজের কৃতকর্মে অনুতপ্ত হয়ে ‘সরি’ এস এস এস পাঠিয়েছিল সে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কি যে লজ্জা লাগছে তার, সে ভেবেই পায় না তার মতো ওয়েল ব্যালেন্সড সংসারি মানুষ কিভাবে ওমন পা পিছালালো, কিভাবে এত বেশি ঘোরে পড়ে গিয়েছিল। উফফ, বন্ধুর বিশ্বাস আর নিতুর একাকীত্বের ফায়দায় যেন নিয়েছে সে! নিজেকে খুব বেশি ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে আর!! আর একটা প্রশ্ন বারেবার যেন এড়িয়ে যাচ্ছে, সে কী আসলেই নিতু কে ভালবাসে, নাকি ক্ষনিকের মোহে মনের অবদমিত কামনার শিকার হয়েছে সে। ঘুম হলোনা রাকিবের আর। সকালে বড্ড তাড়াতাড়ি ই যেন আজ অফিসে যাবার তাড়া, রূপাও আজ খেয়াল করছে তার তাড়া, একবার জিজ্ঞেস করেই ফেলল ‘ মিটিং আছে তোমার আজ? অতো দ্রুত খাচ্ছ কেন’ ‘

‘কাল রাতে ফিরলেও দেরি করে, রাতে ঘুমালেও স্টাডিতে, অফিসে কোন ঝামেলা চলছে কী?’ কথায় নিজেকে ধাতস্থ করার মিথ্যে চেষ্টা করে রাকিব ‘ হুম একটা বড় ফান্ডিং পাওয়ার কথা ছিল আমার ব্রাঞ্চের, সেটা নিয়েই ব্যাস্ত। শোন আমার আজ ও হয়ত দেরি হবে। মোবাইলে চার্জ দিতে ভুলে গেছি’। এক গাদা মিথ্যায় নিজেকে আর স্ত্রী কে বুঝিয়ে  নিজের গাড়ি না নিয়ে উবার ডেকে নিল রাকিব।

অফিসের কাজেও কিছুতেই আজ আর মন বসছে না তার, কী নিদারূন এক অপরাধবোধ পেয়ে বসেছে তাকে। প্রেম ভালবাসা কিংবা নিদেন পক্ষে বন্ধুত্ব নয়, সে যা বোধ করছে অপরাধ বোধ। কী করবে সে!! ইচ্ছে করেই ফোন বন্ধের নাটক করছে আজ, নিতুর মুখোমুখো দাড়াতে পারবে কী আজ আর কিছুতেই। একবার ভাবছে ক্ষমা চেয়ে নিবে। কারো সাথে আলোচনা করবে। কিন্তু তেমন বন্ধু বলতে কেবল ই নিতু। আরেকটি ভয় তাকে জাকিয়ে বসেছে আর তাহলো রূপা। রূপা কোন ভাবে জানলে তার এতদিনের লালিত সগৌরব মডেস্ট ব্যাক্তিত্ব আর প্রায় পারফেক্ট সংসার সব ভেস্তে যাবে। তবুও নিতুর মুখোমুখি হবার সিদ্ধান্ত নেয় সে। ভাবে কাল রাতের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবে নিতুর কাছ থেকে। আদৌ কি নিতু ক্ষমা করবে তাকে?? এত এত অপরাধ বোধে একটা বার ও রাকিবের মনে হয় নি, নিতুকে সে ভালবেসেছে বলেই নিজের স্বপ্রতিভ গৌরবে নিতুকে মহিমান্বিত করেছে, আর নিতুও তাকে গ্রহন করেছে ভালবেসে।

নিতুও আজ নিজেকে প্রস্তুত করেছে রাকিবের জন্য। রাকিবের প্রিয় লাল শাড়ি, চোখে কাজল আর খোলা চুল। রান্নাও করেছে রাকিবের মন মতো। নিতু মুখোমুখি দাঁড়াবে আজ তার প্রেমিকের, এতদিন যে ছিল কেবলই বন্ধু। গতকালই সে বুঝেছে কী তীব্র ভাবেই না সে চাইছিল রাকিব কে। রাকিবই তার আরাধ্য পুরুষ। নিজের সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে সে আজ কেবল অপেক্ষা করছে রাকিবের।

অফিস থেকে বেরিয়ে রাকিব কি মনে করে আজ শাড়ীর দোকানে ঢোকে, অনমনষ্ক ভাবেই হাত দিয়ে ছুয়ে দেখে কয়েকটি শাড়ি। তারপর একটা নীল জামদানি কিনে সে। শাড়িটাতে রূপাকে খুব সুন্দর লাগবে, ভেবেই চমকে উঠলো রাকিব!! শাড়িটা তো সে কিনেছিল নিতুর জন্য তবে রূপার কথা মনে হলো কেন?? আবারো দ্বিধায় পড়ে গেলো সে, ভাবলো পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে নিজে পছন্দ করে কখনই সে রূপাকে কিছু দেয় নাই, রূপার সাথে তার পছন্দ মিলবে না বলেই দ্বিধায় কখনো কিছু দেয়া হয় নাই। কি ভেবে আজ তাই বাসার দিকেই রওনা দিল রাকিব। একবার ভাবলো নিতুর সাথে ফোনেই কথা বলে নিবে কিনা! ফোন টা অন করতেই আজ এক সাথে অনেক অনেক এস এম এস এসে ভর করলো। রূপার টেক্সটাই আগে পড়লো সে-  আজ আমি ছুটি নিয়েছি, তুমি ফিরলে এক সাথে খাবো।

রাকিব দেখলো নিতুর কোন টেক্সট নেই। ধরেই নিল সে নিতু রেগে আছে তার সাথে। আর তাই আবারো ফোন অফ করে, কাল অফিসে যাওয়ার পথেই নিতুর সাথে দেখা করার সিধান্ত নিল। পান্থপথ সিগনালে এক নাছোড়বান্দা ছোট মেয়ের কাছ থেকে কিনলো কতগুলো দোলন চাপা। গাড়ি ছুটে চললো গন্তব্যে।

বাড়ি পৌছে অবাক হয়ে গেলো রাকিব, এত মানুষ কেন!! ধাতস্থ হতেই বুঝতে পারলো বাসায় কোন এক পার্টি হচ্ছে। রাকিবের শ্বশুর ‘ হ্যাপি এনিভার্সারি’ বলাতে তার মনে পড়লো আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী। সাধারনত এসব দিবস সে মোবাইলে রিমাইণ্ডার দিয়ে রাখে, পারিবারিক কোন অশান্তি চায় না বলে। আজ ফোন সারাদিন বন্ধ ছিল বলে আর মনে ছিল না। রাকিবের মা ও এসেছেন, সে কিছুই জানেন। শুকনো হাসি দিয়ে তার কেনা শাড়িটা সে রূপার হাতে তুলে দেয় সাথে দেয় দোলন চাপা গুলো ও। ফ্রেশ হয়ে রূপার কেনা পাঞ্জাবী পড়ে হাসি মুখেই পার্টি এটেন করে সে। দাওয়াত, মেহমান এসবের ব্যাস্ততায় ভুলেই যায় সে নিতুর কথা। ছোট্ট রোদসীকে নিয়ে মেতে পড়ে সে। পার্টি শেষ হয় বেশ রাতে, ক্লান্ত রোদসী আজ ঘুমিয়ে পড়ে দাদির ঘরেই।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে, বালিশের পাশে রাকিবের প্রিয় সুনীল কবিতা সমগ্র ০১- ০৫ দেখে খুব পুলকিত হয় সে। রূপা কী মনে করে আজ রাকিবের দেয়া শাড়িটা পরলো, রাকিব ভীষন অবাক হলো দেখে যা ভেবেছিল তার চেয়েও সুন্দর লাগছে তার বউকে। রাকিব স্মিত হেসে বলল- ‘সুন্দর লাগছে রূপা’। রূপাও থ্যাংক ইউ বলে। রূপা একটা ইনভেলপ ধরিয়ে দেয় রাকিবের হাতে- রাকিব জানতে চাইল কী? রূপা তাকে খুলে দেখতে বলে, রাকিব দেখে নেপাল, ভুটানে ৭ দিনের ট্যুর প্যাকেজ। অফিসের ছুটির অজুহাত দিতে যাচ্ছিল রাকিব, তার আগেই রূপা জানালো তোমার বস ‘আতি্ক আংকেলের সাথে কথা হয়েছে আমার’। বিব্রত রাকিবের মনে হলো তার বস আতিক সাহেব রূপার বাবার খুব কাছের একজন। তাই কোন অজুহাত দেয়ার ই আর সময় পেলো না। পরদিন দুপুরের ফ্লাইটে রাকিব, রূপা আর রোদসী উড়াল দিল নেপালের উদ্দেশ্যে। নিতুর সাথে যোগাযোগের কথা আর মনেই রইলো না রাকিবের। এমনকি তাদের ট্যুরের ব্যাপারেও জানানো হলো না নিতুকে। রাকিব বরং মনে মনে কে ধরনের স্বস্তি পেল, নিতুর মুখোমুখি হবার সময় পেছানো তে।

রাকিব যে সেদিন বিকালে আসেনি, নিতু যেন বিশ্বাসই করতে পারছেনা। নিজেকে রিক্ত আর ক্লান্ত মনে হচ্ছে ভীষন। মনে হচ্ছে তার জ্বর আরো বেড়েছে। রাকিবের নাম্বারে আবার ডায়াল করলো সে, আন রিচেবল। তবে কী মানুষ চিনতে ভুল হলো তার, ইচ্ছে করছে রাকিবের বাসায় গিয়ে রাকিব কে নিয়ে আসতে তার কাছে, অনেক কষ্টে নিজেকে দমালো সে। পরক্ষনেই মনে হলো রাকিবের কোন সমস্যা হয় নি তো, রূপা কোন ভাবে কিছু জেনে যায়নি তো। গত ৬ মাস ধরে চেনা রাকিব কে সে কী তাহলে ভুল বুঝছিল!!। গর ৬ মাসে রাকিবের সাথে দেখা হওয়া প্রতিটা দিন, টেক্সট , কবিতা সে বারেবার বিশ্লেষন করতে লাগলো, কোনভাবেই সে রাকিবকে খারাপ বা লম্পট ভাবতে পারছেনা। নিতুর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে রাকিব ঠিক তার মতই অস্থির হয়ে আছে তার কাছে আসার জন্য, যতটা ব্যাকুল সে। কেবল রাকিব পারছেনা তার বাস্তবতার জন্য। কিন্তু নিতুর জ্বর আরো বাড়ছে। এক সময় জ্ঞান হারায় সে। জ্ঞান ফিরে দেখতে পায় সে তার বিছানায়, শফিকের উদবিগ্ন মুখ। সেদিন রান্নার খালা বাসায় এসে অনেকবার দরজা নক করে সাড়া না পেয়ে, দারোয়ানের সাহাযে দরজার ভেঙ্গে নিতুকে অচেতন অবস্থায় পায়, গা পুড়ে যাচ্ছিল জ্বরে। প্রাথমিক ভাবে এলাকার ওষুধের দোকানের ডাক্তারকে কে ডেকে আনা হয়। খবর পেয়ে বাসার সবাই আসে। ডাক্তার বলেন পর্যাপ্ত খাবার আর পানির অভাব সাথে জ্বরের তীব্রতায় জ্ঞান হারিয়েছিল নিতু। খবর পেয়ে সাথে সাথে ঢাকায় ফিরে শফিক। শফিক কে দেখে চোখ বুজে ফেলে নিতু।

শফিকের কাছ থেকেই জানতে পারে নিতু যে রাকিব তার স্ত্রীর সাথে নেপালে গেছে ১০ দিনের ট্যুরে। কী অপরিসীম গ্লানি বোধ করে নিতু। নিজের প্রতি ঘৃণা আর লজ্জায় শফিকের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে চায় নিতু। এম্নিতেই চুপচাপ নিতু, আরো চুপচাপ হয়ে যায়। শফিকের বাবা এক রকম জোর করেই নিতুকে শফিকের সাথে তার কর্মস্থলে পাঠিয়ে দেয়। শফিক বেশ কয়েকবার নিতুকে চিয়ার আপ করার ট্রাই করে, কিন্তু কেমন যেন আরো ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে নিতু। শফিক নিজের অনুশোচনা প্রকাশ করে নিতুকে। স্বল্পভাষী শফিক নিতুকে তার অতিরিক্ত ব্যাস্ততা আর এম্বিশনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। নিতু শুধু জানায়- ঠিক আছে, রাগ নেই তোমার প্রতি, অভিমান ছিল এখন শুধুই নির্লিপ্ততা আছে। কুমিল্লার নতিন পরিবেশে প্রায় সন্ধায় ই তারা ঘুরতে বের হয়। ইদানিং শফিক অনেক উৎসাহী আর স্বতঃস্ফুর্ততা দেখায় নিতুকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে, ঢাকা তে অর্ডার করিয়ে বই আনায়। বই পড়তে আর ভাল লাগেনা নিতুর। রাকিবের আচরন টা সে মেনে নিতে পারেনি এখনো।

নেপাল ট্যূরে রূপাকে নতুন করে আবিষ্কার করে রাকিব। আজীবন সিদ্ধান্থীনতায় ভোগা রাকিব অবাক হয় রূপাকে দেখে, কী সুন্দর সব ম্যানেজ করে চলেছে রূপা, ট্রান্সপোর্ট, ট্রাঞ্জিট, শপিং, ফুড সব ব্যাপারেই অসম্ভব দক্ষ আর পরিকল্পনা মাফিক তার চলাফেরা। রাকিবের কোন কিছু নিয়েই আর টেনশান করা লাগছে না। সে কেবল ঘুরছে ফিরছে খাচ্ছে দাচ্ছে। মাঝে মাঝে যে নিতুর ব্যাপার টায় অপরাধবোধে ভুছেনা তা না। কিন্তু রূপার প্রবল ব্যাক্তিত্ব, রোদসির সাথে খুনসুটি আর বেড়ানোর ব্যাস্ততা নিতুর ব্যাপারটা প্রায় চাপাই পড়ে যাচ্ছে। ১০ দিনের নেপাল-ভুটান ট্যূর থেকে পরিতৃপ্তি নিয়ে ফেরে রাকিব-রুপা। বাসায় ফিরে রাকিবের মন টা ই খারাপ হয়ে যায়, রাকিবের মা ভীষন অসুস্থ, তারা ট্যুরে ছিল বলে সে তাদের বিরক্ত করেনি। তবে রূপার বাবা- মা ঠিকই খবর নিয়েছে, তাকে হাসপাতালে নেয়া সব ব্যাপারেই তারা হেল্প করেছে। রাকিবের মায়ের অসুস্থতা দীর্ঘ ট্যুরের ক্লান্তি অনেকটাই নিতুকে ভুলিয়ে রাখলো রাকিবকে। একটা ফোন করার সময় ও সে পেলো না। আসলে হয়তো সে নিজেও নিতুর মুখোমুখি দাড়ানোর ভয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে চাইছিল যোগাযোগের ব্যাপারগুলো।

নিতু, শফিকের সাথে কুমিল্লায় আসার পর থেকে শফিক পুরাতন ভুল ত্রুটি ভুলে নতুন করে শুরুর একটা চেষ্টা করছে, প্রায়ই সে বিকালে স্ত্রীকে নিয়ে বের হতে চায়। দুই একদিন নিতু যায় কিন্তু বেশির ভাগ দিনই কেন যেন বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছা করেনা নিতুর। নিতু ও ইদানিং হাঁপিয়ে উঠে নৈরাশ্য অ্যার হতাশার গ্লানিতে। একটু একটু করে সংসারি হবার জন্য মানিসিক ভাবে প্রস্তুত হয় সে। যদিও শারিরীক অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো সে। রাকিবের ব্যাপারটা একটা এক্সিডেন্ট বলেই এক সময় ভাবতে শুরু করে নিতু। সিদ্ধান্ত নেয়, নতুন করে সব শুরুর। শফিকের কোয়ার্টারের পাশের খালি জায়গায় সবজি বাগান করবে ভাবে। এক সকালে বহুদিন পর হাসিমুখে সে শফিককে ঘুম থেকে ডেকে তোলে আর বলে তার সবজি বাগান প্ল্যানের কথা। শফিক মন্ত্র মুগ্ধ হইয়ে অসুস্থ স্ত্রীর কথা শোনে, আজ কত বছর পর নিতু তার সাথে এমন হাসি মুখে কথা বলছে, শফিকের মনে পড়ে যায় তাদের প্রেমের প্রথম দিক কার দিন গুলো। সে ভাবে আল্লাহ চাইলে সে অবশ্যই নিতুর সব শখ পূরণ করবে। তার চোখ ভেসে উঠে অশ্রুজলে। মনে হতে থাকে মেঘ কেটে যাচ্ছে। নিতু অবাক হয়ে শফিকের চোখে অশ্রু দেখে, আর জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে? শফিক হাসিমুখে জানায় কিছু না, এমনি। শফিক আর নিতুর সম্পর্ক যখন খুব আস্তে আস্তে ভাল হওয়ার দিকে, এক সকালে নিতু আবিষ্কার করে সে প্রেগন্যান্ট!! রাকিবের সাথে সে রাতের অন্তরংগতার এই বিশেষ ফলাফলের সম্ভাবনা সে ভুলেই গিয়েছিল।

 

নিজেকে প্রেগ্ন্যান্ট আবিষ্কার করে ভীষন ভেঙ্গে পড়ে নিতু। রাকিবের সাথে ঘনিষ্টতার পর থেকে আজ পর্যন্ত শফিকের সাথে এক রুমে থাকা হয় নি তার, তাই আর অন্য কোন সম্ভাবনার কথা ভাবতেও পারছেনা। নিতুর মনে হচ্ছে তার পৃথিবী দুলছে। একটি সন্তানের কী তীব্র আকাংখাই না ছিল তার মনে , অথচ আজ সে কাংখিত সন্তান তার মাঝে একটু একটু করে বড় হচ্ছে। রাকিবের সাথে আবেগতাড়িত হয়ে কাটানো কিছুটা সময় তাকে এমন দ্বিধার মধ্যে ফেলবে কে জানতো। নিতু ভাবতেই পারছেনা কী করবে!! রাকিবের মুখোমুখি দাঁড়াবে না শফিকের কাছে কনফেস করবে নিতু এই দ্বন্দে আরো অসুস্থ বোধ করে সে।

রাকিবের জীবন চলছিল রুটিন মাফিক। বার কয়েক যে নিতুর ভাবনা মনে উঁকি দেয়নি তা নয়। কিন্তু ব্যাস্ততা আর বাস্তবতার অজুহাতে সে সময় নিচ্ছিলো। যাচ্ছি, যাবো করেও আর নিতুদের ওখানে যাওয়া হয় না। নিতুর সাথে কাটানো চমৎকার সময়গুলো, কবিতার মত ছন্দময় নিতুকে তার খুব মনে পড়তে লাগলো। নিজের কাছে এত অপরাধ বোধ হচ্ছে ইদানীং তার, নিতু নিশ্চয়ই তাকে খুব খারাপ মানুষ ভাবছে, লম্পট ভাবছে। কিন্তু রাকিব সত্যি নিতুকে ভালবাসে, নিতু যে তার মনের মত। তবে সেদিন ভালবাসার বহিঃপ্রকাশটা হয়তো খুব বেশি মোটা দাগের হয়ে গেছে। নিতু ঠিক তার মনের মত একটা মেয়ে। রাকিবের জীবনে আগে কখনো প্রেম তেমন ভাবে আসেনি, নিতুর জন্য সত্যই সে প্রেম অনুভব করতো, আচ্ছা সত্যি যদি প্রেম বোধ থাকে তবে সেদিনের অন্তরঙ্গতার পর পালালো কেন সে? কেনই বা মুখোমুখি হবার ভয় পেলো সে নিতুর! নিতু যদি রাগ করেই থাকে তবে তো সেদিন তাকে ওমন ভাবে গ্রহন করতো না। আসলে আজ নিজের আয়নায় নিজেকে খুব বেশি ছোট আর কাপুরুষ লাগছে রাকিবের। চোখ বুঝে রাকিবের নিতুর হাসি মুখ টা বারেবার মনে পড়তে লাগলো। রূপা তার সুযোগ্য স্ত্রী সত্য কিন্তু ভালবাসা সে শিখেছে নিতুর কাছেই। বলতে গেলে নিতুই তার প্রথম প্রেম আর সে নিতুকে সে কিনা এমন ভাবে এড়িয়ে গেছে, আচ্ছা নিতুই বা তাকে খোঁজে নি কেন? হলো ই বা নিতু তো একটা মেয়ে কিছুটা সঙ্কোচ তার থাকবেই। নিতুর জন্য অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে আজ রাকিবের। নিজের ভীরুতা, সিধান্তহীনতা আর অর্থহীন আবেগের ফল কেন নিতু বয়ে বেড়াবে। নিতুর কাছে যাওয়া আজ যে খুব বেশি প্রয়োজন তার। বন্ধু, বন্ধু পত্নী আর নিজের সংসার সব অংক গুলো সে নিজেই প্যাচ লাগিয়ে ফেলেছে। নিজের ভালবাসাও সে ঠিক মতো প্রকাশ আর অসংকোচে ঘোষনা করতে পারেনি বরং ভীরু কাপুরুষের মত সব দ্বিধা ঝেড়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় নিতুর সাথে দেখা করার। নিজের অবস্থান সুদৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করবে বলে ঠিক করে। প্রথমে ভেবেছিল ফোন করে নিতুকে বাইরে কোথাও ডাকবে, পরক্ষনেই সেই চিন্তা ঝেড়ে শফিকদের বাসায় যাওয়ার সিধান্ত নেয়।

শফিকদের বাসায় পৌছে রাকিব আজ বড়সড় ধাক্কা খায়, সে এক বারো ভাবেনি নিতু বাসায় থাকবেনা। বরং শফিকের সাথে গত কয়েক সপ্তাহ সে কুমিল্লায় থাকছে শুনে ভীষন ঈর্ষা বোধ করে সে, অভিমান হয় তার নিতুর উপর। নিজের নির্লজ্জ কাপুরুষতা আর পালিয়ে যাওয়া ভুলেই সে ভাবতে থাকে নিতু তার সাথে অন্যায় করে স্বামীর কাছে ফিরে গেছে। তবুও কি মনে করে জানি, নিতুর নাম্বারে ফোন করে সে। ফোন টি ধরে শফিক। খুব ঠান্ডা গলায় রাকিব কে কুমিল্লায় আসার আহবান জানায়। রাকিবের মেরুদন্ড বেয়ে এক শীতল স্রোত নেমে আসে, সে ভাবে শফিক সব জেনে গেছে। তবু ভাবে সে একবার যাবে। শফিক খুব দ্রুতই যেতে বলে। সে জানায় নিতু খুব অসুস্থ। রাকিব ভীষন অনুশোচনায় ভুগতে শুরু করে। ডিসিশান নেয় কুমিল্লা গিয়ে নিতুর সাথে দেখা করার। 

প্রেগন্যান্ট জানার পর নিতুর শরীর মন দুইটাই আরো ভেংগে পড়তে থাকে। সে বুঝতে পারে কী ভীষন গোলমেলে একটা অবস্থায় সে পড়ে গেছে। কিন্তু সে এই সন্তান কে ধারন করতে চায়, জন্ম দিতে চায় বড় করতে চায় নিজের মত করে। হতে পারে কোন এক ভুল থেকে তার শুরু, কিন্তু তার ভালবাসা টা মিথ্যা বা ভুল ছিল না। রাকিব ও তাকে ভালবেসেই স্পর্ষ করেছে বলে সে বিশ্বাস করে। নিতু সিধান্ত নেয় সে শফিক কে সব বলে ডিভোর্স নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। লড়াইয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিতু। এদিকে শফিক ভাবছিল নিতুকে নিয়ে চেইঞ্জে যাবার কথা। সে একটা প্ল্যান করে মনে মনে। তার পি এইচ ডির ডেজারররটেশানের জন্য তাকে যেতে হবে নেদারল্যান্ডে, সে নিতুকে কিছু না জানিয়েই নিতুর ভিসার জন্য এপ্লাই করে। ভাবে কয়েকমাস ইউরোপ ঘুরে আসলে হয়তো সেরে উঠবে নিতু।। 

নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়ার পর শফিককে সব জানিয়ে দিবে বলে ডিসিশান নেয় নিতু। ঠিক সেদিনই কাকতালীয় ভাবে নিতুর ভিসা হবার খবর পায় শফিক, খুব আনন্দিত মনে সে নিতুকে খবর দিবে বলে নিতুর জন্য ফুল আর চকলেট কেনে। বাসায় পৌঁছে নিতুকে আজ বহুদিন পর জড়িয়ে ধরে নিতুকে। নিতু ছাড়িয়ে নিতে চায়, কিন্তু আজ শফিক অনেক বেশি ছেলেমানুষ, কেন জানিনা আজ তার খুব খুব খুশি লাগছে। নিতু শফিক কে বলে- আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে, শফিক হাসতে হাসতে বলে ‘আজ তুমি শুধু আমার কথা শুনবে আমি তোমার কোন কথা আজ শুনবো না।‘ শফিক আজ খুব সপ্রতিভ। নিতুকে কিছু না বলে নিতুর হাতে পাসপোর্ট তুলে দিয়ে বলে- ‘আমরা ইউরোপ যাচ্ছি, শুধু তুমি আর আমি’। নিতু ভ্রু কুচকে বলে- শফিক তুমি আগে আমার কথাটা আগে শোন। শফিক অসহিষ্ণূ গলায় বলে- উফফ, আজকেই তোমার সব বলতে হবে? শোন, তুমি কিছু বলার আগে আমি বলছি- আমার অন্যায় তোমার জন্য এত বেশি কী ছিল যে তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবেনা? নিতু আমি কিছু ভুল করে ফেলেছি, ক্যারিয়ার আর পড়াশোনার চাপে আমি তোমাকে সময় দেই নি, আমাদের নিয়ে না ভেবে আমি শুধু আমাকে নিয়ে ভেবেছি, আমি ভুল শুধরানোর চেষ্টা করবো নিতু তুমি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো। নিতু আমাকে একটু সুযোগ দাও। আল্লাহ চাইলে আমাদের ঘরে অবশ্যই শিশু আসবে। তুমি দেখো আমি কত ভাল বাবা হবো। নিতু আমি সব কিছু নতুন করে শুরু করতে চাই, আর আমার মনে হয় এই নতুন শুরুর জন্য ইউরোপ ট্যুর টা খুব ভাল হবে, নিতু প্লিজ আমরা নতুন করে শুরু করি?

নিতু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে – শফিক আমার মনে হয় আমাদের আর নতুন করে শুরু করার অপশান নেই শফিক। আমি প্রেগন্যান্ট। আর বুঝতেই পারছো, সে সন্তানের বাবা তুমি নও। 

শফিক উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় নিতুর দিকে, আমি আসলে…

শফিককে থামিয়ে দিয়ে নিতু বলতে শুরু করে, শফিক আমাদের সুর বহু আগেই কেটে গিয়েছিল, সে তুমি টের পেয়েছিলে কবে আমি জানিনা, তবে আমি কিছু একটা নিয়ে বাঁচতে চাইছিলাম। এর মাঝেই রাকিবের সাথে আমার বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব ছাপিয়ে কোন এই দূর্বল মুহুর্তের প্রেমের বহিঃপ্রকাশ যে অন্তরঙ্গতা প্রকাশ পায়, তার ফলাফল আমি বয়ে চলেছি। তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি আমার পদস্খলনের জন্য, তোমাকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। আসলে সেই মুহুর্তের আগেও আমি বুঝতে পারিনি, রাকিব কে আসলেই আমি কতখানি ভালবেসেছিলাম বা আদৌ ভালবাসি কিনা। কিন্তু সেদিনের সে রাত্রি টা আমার নিজেকে আবিষ্কারের রাত ছিল, ভালবাসার জন্য কারো তীব্র প্রেমের জন্য আমি কত টা বুভুক্ষ ছিলাম, সে আমি বুঝতে পেরেছি। যদিও তোমার বন্ধুর কাছে সে রাত হয়ত নিছকই একটা আবেগ তাড়িত এক্সিডেন্ট, আর তাই আমার তাকে কোন প্রয়োজন ই আমার আর নেই। তার প্রতি এক রাশ ঘৃণা আর নিজের প্রতি অপরিসীম করুণা ছাড়া আর কোন জাগতিক অনুভূতি আমার নাই। ও হ্যা ইদানিং আরেকটা অনুভূতি আমি টের পাচ্ছি আর তা হলো, আমার অনাগত সন্তানের জন্য তীব্র ভালবাসা আর অপেক্ষা। আর তাই আমি সিধান্ত নিয়েছি, তোমাকে আমি মুক্তি দিব। আমার অন্যায়ের বোঝা কিংবা আমার অনাগত সন্তানের দায় নিয়ে আমি যত দ্রুত সম্ভব চলে যাবো। তুমি বরং নতুন করে অন্য কারো সাথে জীবন শুরু করো।

শফিক তার হতভম্বতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কিছুতেই। সে দৌড়ে বাইরে চলে যায়, নিতু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিজের ব্যাগ গোছাতে বসে। আপাতত তার প্ল্যান তার চাচার বাসায় কিছুদিন ওঠা, পরেরটা সে পরে ভেবে নিবে। শফিক কে বলতে পেরে খুব হাল্কা লাগছে তার। রাকিবের জন্য কী নিদারূন ঘৃণাই না সে বহন করছে! সে ঠিক করে আজ রাত টা এই বাসায় কাটিয়ে কাল খুব ভোরেই সে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে। তার ধারনা শফিক আর আসবেনা আজ। সে হয়ত বা কোন বন্ধুর বাসায় কিংবা ঢাকায় ই চলে গেছে। ঘৃণিত নিতুকে দেখতে সে আর ফিরে আসবেনা এটা স্বাভাবিক।

কিন্তু ঘন্টা দুয়েক পর নিজের সাথে যুদ্ধ শেষে বাসায় ফিরে ফিরে শফিক। নিতুকে ডেকে বলে, শোন আমি আসলে প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি জোক করছ, পরক্ষনে যখন বুঝলাম তুমি আসলেই সত্য বলছ, তখন আমার কারো প্রতি যদি ঘৃণা হয়, সে আমি। কেন? বলছি- দেখো একজন হাসব্যান্ড হিসাবে আমার দায়িত্ব ছিল তোমার সব ধরনের প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখা, আমাদের সম্পর্ক টাকে যত্ন করা, যা করতে আমি ব্যার্থ হয়েছি। আমার সৃষ্টি করার শূন্যতার বেড়াজালে আমি নিজেই আটকে পড়ে রাকিবের মত কাউকে সুযোগ করে দিয়েছি তোমার দূর্বলতার সুযোগ নিতে। নিতু এই মুহুর্তে সব চেয়ে জরুরি কী জানো তোমার অনাগত সন্তানের যত্ন নেয়া, সাথে তোমারো। দ্যাখো সবাই যে ঔরসধারি বাবা হবে তা তো না, আমি নাহয় তোমার সন্তানকে আমার হৃদয়ে ধারন করে বাবা হলাম। জন্মদাতা তো কতোই হয়, কয়জন অ্যার বাবা হয় বলো!! আমাকে একটা সুযোগ দাও না, বাবা হবার!!

অবাক বিস্ময়ে শোনে নিতু, তারপর চোখের জল মুছে বলে- আমাকে করুণা করছো শফিক। শফিক এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে নিতুকে। ঠিক সে সময় গেটে কারো নক করার শব্দ পাওয়া যায়, শফিক দরজা খুলে দেখে রাকিব। খুব এক গাল হাসি হাসে আজ শফিক, আরে দোস্ত ঠিক সময়ে এসেছিস, এই মাত্রই খবর পেলাম আমরা- তোর ভাবি তো প্রেগন্যান্ট। খুব ভাল লাগছেরে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে রাকিব, নিজেকে এত অসহায় অ্যার কখনোই লাগেনি, কেন যেন তীব্র গ্লানি অনুভূত হয় তার। আর নিতু??

বহুদিন পর আজ আনন্দ অশ্রুতে ভাসতে ভাসতে, রাকিব কে বলে, রাকিব সাহেব সবসময় কি আপনি ভুল সময়েই আসবেন!!!

সমাপ্ত

 


Comments

Popular posts from this blog

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১৬ (সমাপ্তি)

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ০১ ও ০২

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১৪ ও ১৫