Posts

ধারাবাহিক থ্রিলার (নিয়তি) ৫ম পর্ব জয়ার মা সব শুনেও কেন জানি খুব সাহসী আচরণ শুরু করলেন। জয়াকে দ্রুত ডাক্তারের চেকআপের মাঝে রাখলেন। নিজের সমস্ত লিংক ব্যবহার করে হাসানের খোঁজ করার জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করলেন। এদিকে জয়া সিদ্ধান্ত নিল হাসানের মায়ের সাথে দেখা করবে, সম্ভব হলে তাকে সবকিছু খুলে বলবে। হাসানের মায়ের কাছে যাওয়ার আগে কী ভেবে যেন সে হাসানের বাসায় যায় আবার। কেন যেন বাসায় ঢোকার আগে খুব ভয় লাগছিল, অথচ এই বাসাটা তার নিজের হাতে গোছানো। আলমারির তাকে তার কাপড়, এমনকি বেসিনের ওপর তার ব্যবহৃত টুথব্রাশ— সবই যেন নীরব সাক্ষী দিচ্ছে তার আর হাসানের সুখময় দাম্পত্যের। রিনিকে হাসান বিয়ে করেছে, এটা জয়া একেবারেই মানতে পারছে না। জয়ার ধারণা, হাসানকে গভীর কোনো ষড়যন্ত্রে ফেলা হয়েছে, সেটা কী জয়াকে খুঁজে বের করতেই হবে! কিন্তু কীভাবে করবে, কোনো ধারণা করতে পারে না সে। অনেকদিন আগের পড়া প্রিয় এক থ্রিলারের কথা মনে পড়ল— "যখন তুমি কানা গলিতে আটকে যাবে, থামো! ভাবো ঠিক কীভাবে কীভাবে তুমি কানা গলিতে এলে। অবশ্যই কোনো পথ ফেলে এসেই কানা গলিতে আটকে গেছ। যদি একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে বের করতে পারো কানাগলিতে ঢোকার পথটা কোথায় ছিল, তাহলে অবশ্যই তুমি সঠিক পথে যাওয়ার বা এখান থেকে বের হওয়ার পথ পাবে।" জয়া ভাবলো, একটা দিন সে এই বাসায় কাটাবে, নিজেকে কিছুক্ষণ সময় দেওয়া দরকার। হাসানের ফ্ল্যাটের একটা এক্সট্রা চাবি সবসময় থাকে বাড়িওয়ালার কাছে। জয়া আজ বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে শুনলো পুলিশ নাকি এক্সট্রা চাবিটা নিয়ে গেছে। কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকালো জয়া। ভাবলো, ডিআইজি আঙ্কেলের কাছ থেকে জানতে হবে ব্যাপারটা। সে ছাদে উঠে, কী ভেবে যেন ছাদের দরজাটা বন্ধ করে দিল। আজকের দিনটা সে শুধুই একা কাটাবে, দুপুরে ফুড পান্ডায় কিছু অর্ডার করে নেবে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো জয়া। কী সুন্দর ছিমছাম তাদের ঘর! চোখের কোণে মুক্তো বিন্দুর মতো টলটল করছে জল তার। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার কপালের কয়েকটি অব্যবহৃত টিপ এখনো আয়নায় আটকে আছে। আহা! কত সুখস্মৃতি তার এই আয়নার সামনে! হাসানের একটা অভ্যাস ছিল, জয়া আয়নার সামনে দাঁড়ালেই, পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরবে। হাসানের কথা ইদানীং ভাবলেই অসহ্য কষ্ট হয় জয়ার। কোথায় কেমন আছে কে জানে! খেতে ভীষণ ভালোবাসতো তার হাসান, আর কত হাসিখুশি মানুষটা। ছোটবেলা থেকে সে হাসানকে ছাড়া কিছুই ভাবেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা কাগজ-কলম নিয়ে বসলো জয়া বিছানায়। পুরো জিনিসটা প্রথম থেকে ভাবা শুরু করলো সে— ‘হাসান আর সে ছোটবেলার বন্ধু। হাসানের স্কুল জীবনের প্রেম ছিল কান্তার সাথে। কান্তার সাথে ব্রেকআপের পর হাসানের সাথে তার সম্পর্ক, যেটা প্রেম থেকে দাম্পত্যে গড়ায় গত ২ বছর আগে। হাসানের কোনো গোপন বিষয়ই ছিল না যা জয়া জানত না। এমন কি হাসান কখনোই তাকে মিথ্যা বলেনি। হাসানের বন্ধুরা অনেকেই তাকে ভাবী ডাকে। হাসান সবসময়ই তাকে সবার কাছে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছে, এমনকি পরীক্ষার পর হাসানের মায়ের কাছেও ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার কথা। হাসানের মা কয়েক মাস আগে খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল, ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তিও ছিল, কিন্তু হাসান একবারও তাদের বাসায় মাকে আনার কথা বলেনি। তার মানে সে চায়নি মা এই বাসায় আসুক। যদি সে চাইতো, অবশ্যই মাকে এই বাসায় নিয়ে আসতে পারতো। সেই সময়টা হাসানের অনেক টাকার দরকার ছিল। জয়া বাবার কাছে হাসানের জন্য কিছু টাকা ধারও চেয়েছে, বাবা কঠিন গলায় না করে দিয়েছিলেন। হাসান অনেক কষ্টে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে সামান্য টাকা জোগাড় করেছিল, বাকি টাকা তার মামা দিয়েছে বলে শুনেছে। হাসানের নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন আগেও জয়া সারাদিন ওর কাছে ছিল। পরীক্ষার পড়ার সময়টাতে ওর আরও দুই দিনের রান্না করে দিয়েছিল জয়া। ফ্রিজ খুললে এখনো হয়তো সেই তরকারির অবশিষ্ট পাওয়া যাবে। ফ্রিজের খাবার নষ্ট হয়ে মনে হয় পচে গলে যাচ্ছে, ভেবে বিছানা থেকে নেমে ফ্রিজ খুললো জয়া। ফ্রিজের ভেতর বরফ জমে আছে। কোনো খাবারের বক্স চোখে পড়ল না। তাহলে কি হাসান সব খাবার খেয়ে শেষ করেছিল! ফ্রিজের ভেতরের দিকে একটা প্যাকেটে কিছু দেখা যাচ্ছে, সসেজ টাইপের। জয়া ভাবলো পচে যাচ্ছে ফেলে দেবে। প্যাকেটটা টান দিতে ভয়ে জমে গেল জয়া! মানুষের হাতের আঙ্গুল! প্যাকেটের ওপরে মার্কার দিয়ে কিছু একটা লেখা: QXMRN-2058। জয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, মাথাও ঘুরাচ্ছে, কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে। মে মাসের সাত তারিখে হাসান নিখোঁজ হয়। তার আগে ৫ তারিখে সে শেষ এই ফ্রিজ খুলেছে। ৪টা আলাদা বক্সে ৩ দিনের খাবার রেখেছিল। প্রতি বক্সে সকালের নাস্তা বাদে প্রতি বেলার খাবার রাখা ছিল। সে হিসাবে মাত্র দুই বক্স খাবার শেষ হওয়ার কথা, আরও দুই বক্স তরকারি থাকার কথা। ৫ তারিখের রাতের খাবার বাইরে বের করে রেখে সে গিয়েছিল বাসায়। তার মানে হাসানের নিখোঁজ হওয়ার পরেও কেউ একজন এই বাড়িতে এসেছে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে। এমন কেউ যার কাছে বাসার চাবি আছে। এবং সে তাকে এবং হাসানকে বিপদে ফেলার জন্য কোনো ভয়ংকর পরিকল্পনা (পরিকলপনা) করেছে। অথবা? না, সেই সম্ভাবনা ভুলেও মাথায় আনতে চায় না জয়া। তার হাসান অবশ্যই কোনো অপরাধের (ক্রাইমের) সাথে যুক্ত হতে পারে না। জয়ার প্রচণ্ড তৃষ্ণা পাচ্ছে, সে ব্যাগের ভেতর থেকে বোতল বের করতে গেল। বোতলের সাথে জড়িয়ে এলো একজোড়া নূপুর। নূপুর জোড়া দেখে কান্না পেলো জয়ার, ওর গত জন্মদিনে দেওয়া হাসানের উপহার। রুপার নূপুরের গায়ে কিছু অক্ষর, এলোমেলো অক্ষর। হাসান বলেছিল, এখানে একটা কোড আছে, জয়াকে ডিকোড করতে হবে। যদি পারে, তবে জয়াকে একটা গোপন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে। জয়া তখন পারেনি। হাসানকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল, হাসান শুধু হেসেছিল। বলেছিল— জয়া অবশ্যই পারবে। যেদিন পারবে, সেদিন সে জানবে হাসানকে বুঝে নিবে জয়া। অক্ষরগুলো ছিল: YBIFBSBLKJB3। জয়া হাসানের এইসব ছেলেমানুষির সাথে ছোটবেলা থেকেই তাই আর মাথা ঘামায়নি। হাসান খুব ভালোবাসতো ধাঁধা (রিডল), কোডিং। একবার তো ড্যান ব্রাউনের 'ভিঞ্চি কোড' পড়ে ক্রিপ্টেক্স আর অন্যান্য সব কোডিং, ডিকোডিং নিয়ে রাত-দিন পড়ে থাকত। বন্ধুদের জন্মদিনে নানারকম ধাঁধা দিয়ে মজা দিত। একবার ওদের এক বন্ধু আবিদের জন্মদিনে আবিদকে একটা ধাঁধা দিয়েছিল— তিনটা বক্স দিয়েছিল সে আবিদকে, যার মধ্যে যেকোনো একটা বক্সে আবিদের গিফটটা আছে। হাসানের ধাঁধাটা সলভ করলে আবিদ গিফটটা পাবে, নয়তো আবিদ সবাইকে ট্রিট দেবে। তিনটা বক্স তিনটা আলাদা রঙের গিফট র‍্যাপে মোড়া ছিল— একটা ছিল লাল র‍্যাপে মোড়া, একটা ছিল নীল র‍্যাপে মোড়া আরেকটা ছিল হলুদ র‍্যাপে মোড়া। হাসান আবিদকে তিনটা ক্লু দিয়েছিল, যেখান থেকে সঠিক উত্তরটা খুঁজে বের করতে হবে। প্রথম ক্লু ছিল— 'গিফটটা লাল বক্সে আছে'। দ্বিতীয় ক্লু হচ্ছে— 'নীল র‍্যাপের বক্সে গিফটটা নেই'। তৃতীয় ক্লুটা লেখা ছিল হলুদ বক্সে— 'গিফটটা আছে লাল বক্সে'। হাসান বলেছিল এই তিনটা ক্লু-এর মধ্যে যেকোনো একটা সত্য, বাকিগুলো মিথ্যা। আবিদকে সত্যটা খুঁজে বের করে গিফটটা নিতে হবে। আবিদ আর হাসানের এই ক্লু নিয়ে সে কী খুনসুটি! মনে পড়েই নিজের অজান্তেই হেসে উঠলো জয়া। কিছুক্ষণ আগের ফ্রিজের মাঝে পাওয়া ফ্রোজেন আঙ্গুলের কথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেল সে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কেমন যেন চোখ বুজে আসলো জয়ার। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখছিল জয়া, এক অতলান্তিক কূপে (কুয়ায়) পড়ে যাচ্ছে জয়া। কী ঘুটঘুটে অন্ধকার! আর কেমন শেওলা ধরা গন্ধ! ঘুমের মাঝেই যেন গন্ধ পাচ্ছিল। এর মাঝেই টের পেল তার সাথে বাঁধা তার সন্তান চিৎকার করছে আর ক্রমাগত লাথি দিচ্ছে তাকে। অসহ্য পরিস্থিতি। এর মাঝে সে হঠাৎ দেখতে পেল কেউ একজন চিৎকার করে নাম ধরে ডাকছে— 'জয়া, জয়া, জয়া'। কণ্ঠটা পরিচিত, সে মনে করতে পারলো না। জয়ার ঘুম ভাঙলো মোবাইল ফোনের ভাইব্রেশনে। ফোন বাজছে তার। আর ফোনের রিংটোনে মায়ের গলায় তার নাম সেভ করা, সেটাই ঘুমের ঘোরে শুনছিল সে। কোনো একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। জয়া ক্লান্ত গলায় ফোনটা রিসিভ করে রীতিমতো ভিড়মি খেলো। আপনা-আপনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো— কী! সত্যি!

http://dlvr.it/TNv7QP

ধারাবাহিক থ্রিলার (নিয়তি) ৩য় পর্ব হাসান নিখোঁজ হওয়ার পনের দিন প্রায় পার হয়ে গেছে, জয়ার জীবন কাটছে ভয়াবহ দুর্ভাবনায়। এদিকে নিজের মাঝে একটু একটু করে বড় হওয়া হাসানের সন্তান, এখনো কাউকে বলতেই পারেনি। মাকে বললে কী হতে পারে ভেবে জয়া অস্থির হয়ে যাচ্ছে। বাবার হঠাৎ মৃত্যুটা জয়ার মা একদমই মেনে নিতে পারেননি, খাওয়া-দাওয়া বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছেন। হাসানের মামা ঢাকায় পাগলের মতো থানা-পুলিশ করে বেড়াচ্ছেন। কোনো লাভ হয়নি, এখন পর্যন্ত কোনো সূত্র (ক্লু) পাওয়া যায়নি। এর মাঝে জয়া নিজের প্রেগন্যান্সি, তাও আবার হাসানের নিখোঁজ অবস্থায়, কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছে না কিছুতেই। এদিকে হাই লেভেলের চাপে জয়ার বাবার কিছু সম্ভাব্য খুনি বের করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। যদিও মিডিয়া সোচ্চার এসব অপপ্রচারের জন্য। ধারণা করা হচ্ছে কিছু হাই প্রোফাইল সিক্রেট রিপোর্টিংয়ের কারণে তাকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। পূলক সেনের এক কলিগের কাছ থেকে জানা গেছে, 'হিউম্যান অরগ্যান ট্রান্সপ্ল্যান্টের' একটা সিক্রেট র‍্যাকেটের সাথে জড়িয়ে থাকা কিছু হাই প্রোফাইল ব্যবসায়ী আর পলিটিশিয়ানদের জড়িত থাকার একটা সূত্রের (ক্লু-এর) উপর ভিত্তি করে একটা রিপোর্ট নিয়ে কাজ করছিলেন পূলক সেন। জয়া আজ ক্যাম্পাসে যাবে ঠিক করেছে, হাসানের কোনো সূত্র খুঁজে পায় কিনা দেখা যাক। একটা অসহ্য আতঙ্ক অবশ্য আছে, বাবার লাশ পাওয়া যাবার জায়গাটা দেখার এক বিরাট ভয়ংকর কষ্ট হয়তো তার হবে। কিন্তু জয়াকে শক্ত হতেই হবে, হাসানকে খুঁজে বের করতেই হবে। দিনে দুপুরে এমন করে তার মানুষটা হারিয়ে যাবে! জয়াকে অবাক করে দিয়ে আজ কান্তা এসে হাজির জয়ার বাসায়। জয়াকে ওর বাবার মৃত্যুতে সান্ত্বনা জানায়। হাসানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। জয়া কান্তাকে দেখে ভেঙে পড়ে। অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে কাঁদে, এক সময় না পেরে সে তার প্রেগন্যান্সির খবর দেয় ছোটবেলার বেস্ট ফ্রেন্ড কান্তাকে। কান্তা স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। কান্তা আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছে, সাথে যাচ্ছে ওর হাসবেন্ড। কান্তা কবে বিয়ে করল! অবাক হলো জয়া। ‘এই তো গত সপ্তাহেই। এই কারণেই আসতে পারিনি রে তোর খবর নিতে,’ বলল কান্তা। ‘আচ্ছা শোন, হাসানের কোনো খবর পেলে আমাকে জানাস প্লিজ। যোগাযোগ রাখিস।’ জয়ার কাছে খুব অবাক লাগে কান্তার হঠাৎ বিয়ের খবর, কেউই তাকে জানালো না। ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে হাসানের ফ্ল্যাটে গেল সে। গেট খুলে খুব অবাক হলো, মনে হচ্ছে কেউ একজন থাকছে এখানে, কারণ অদ্ভুত পরিষ্কার তার ঘর। পুলিশ এসে সার্চ করে গেছে শুনেছে সে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে। আরেক বিপদ হলো, বাড়িওয়ালা বাড়ি ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছে এক মাসের মধ্যে। সে অবশ্য তিন মাস সময় চেয়েছে। কী করবে ভাবছে জয়া। সব মিলিয়ে জট পাকিয়ে যাচ্ছে মাথা। কী মনে করে যেন হাসানের টেবিলের ড্রয়ার খুলল জয়া। খুব সাজানো-গোছানো মানুষ ছিল হাসান। ড্রয়ারে হাসানের ওয়ালেট আর ঘড়ি দেখে একটু অবাক হলো জয়া—পরীক্ষার হলে কী তাহলে সে ঘড়ি ছাড়া গিয়েছিল! আর ওয়ালেটই বা এখানে কেন? ওয়ালেট ভুলে ফেলে যাবার মানুষ সে না। কী ভেবে ওয়ালেটটা খুলল সে। ওয়ালেটের ভেতরে তার একটা ছবি দেখে জয়ার বুকটা হু হু করে উঠলো। এত ভালোবাসা ছেড়ে হাসান কোথায় চলে গেলো! ওয়ালেটের ভেতরে এক হাজার টাকার দুটো নোট, কিছু খুচরা দশ-বিশ টাকার নোট আর একটা ছোট গোল প্লাস্টিকের পয়সার মতো দেখতে কিছু। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখল জয়া, কোনো কূল-কিনারা করতে পারলো না। নিজের ছবিটা বের করলো। পেছনে একটা নাম্বার লেখা: RBK5.30PL3RI2VCT-2807। কিসের নম্বর কে জানে! ছাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো জয়া, কিছু গাছ লাগিয়েছিল হাসান। জয়া ভাবলো পানি দিয়ে যাবে। গাছগুলো বেশ সজীব আছে এখনও, অন্য ফ্ল্যাটের কেউ হয়তো ছাদে এসেছিল। যদিও তারা থাকতে উপরে ছাদে কেউ আসতো না। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ালো জয়া। চোখের পানি আর আটকাতে পারছে না কিছুতেই। ভীষণ মনে পড়ছে তার হাসানকে। হাসানের সিগারেট খাওয়াটা সে দু’চোখে দেখতে পারতো না, এখন কেন যেন হাসানের সিগারেটের গন্ধটাও সে খুব মিস করছে। মনে হচ্ছে বেনসনের গন্ধ সে এখনো পাচ্ছে। ভেবেই চমকে উঠলো সে, তার মনে হলো কেউ একজন তার পেছন থেকে দ্রুত সরে গেল। চমকে পেছন ফিরে কাউকেই দেখতে পেলো না, কিন্তু সিঁড়ি ভেঙে কাউকে নামতে শুনলো। জয়া দ্রুত সিঁড়ির কাছে গেল, কেউ নেই কিন্তু খুব পরিচিত একটা গন্ধ। জয়ার আর কিছুই ভালো লাগছে না, সে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রিকশা নিল। ক্যাম্পাসের জমজমাট পরিবেশটা এক দুপুরে কিছুটা স্তিমিত। জয়া সূর্যসেন হলের কাছে গিয়ে, হাসানের বন্ধু আবিদকে কল দিল। ওদের স্কুল ফ্রেন্ড আবিদের রোল নাম্বার হাসানের পরেই। আবিদ জয়াকে একটা অদ্ভুত তথ্য দিল—হাসান নাকি পরীক্ষার মাঝেখানে প্রায় ২০ মিনিট ছিল না, মানে ওয়াশ রুমে ছিল। তারপর পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে গেছে সবার আগে। জয়া কী মনে করে যেন আবিদকে কান্তার কথা জিজ্ঞেস করলো। আবিদ জানেই না কান্তার বিয়ের খবর, অথচ আবিদের গ্রামের বাড়ির দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিল কান্তা। আর কিছু চিন্তা করার মতো ধৈর্য নেই জয়ার আজ। খুব ক্লান্ত লাগছে জয়ার। দ্রুত বাসায় ফিরল জয়া। ড্রয়িং রুমে খুব সুন্দর একটা মেয়ে বসে আছে। জয়ার খুব চেনা লাগলো মেয়েটাকে কিন্তু মনে করতে পারলো না। বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকেই এখন বাসায় আসছে। জয়ার মা জানালো, ও হাসানের মামাতো বোন রিনি। জয়ার খুব অবাক লাগলো রিনিকে দেখে, অনেক ছোটবেলায় একবার হাসানের বাসায় দেখেছিল, এত সুন্দর হয়েছে সে! রিনির চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, ঘুম হয়নি মনে হচ্ছে। হাসানের ৩ বছরের ছোট মামাতো বোন রিনি, হাসানের খুব ন্যাওটা ছিল ছোটবেলায়। রিনি জানালো হাসানের মা খুব অসুস্থ, চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসেছেন, হোটেলে উঠেছেন, হাসানের বাসার চাবির জন্য জয়ার কাছে এসেছে রিনি। রিনির হাসিটা খুব সুন্দর, জয়া ভাবলো। এত ঝামেলার মাঝেও জয়া রিনিকে বলতে বাধ্য হলো—‘রিনি তুমি তো খুবই সুন্দর হয়েছ, আগে তো ছোট ছিলে, মনে নেই?’ ‘দিদি, ওর কোনো খবর পাচ্ছিনা, ফুপুরও শরীর খুব খারাপ।’ জয়ার একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো, হাসান যে ঢাকায় একা বাসা নিয়ে থাকে, এটা তো ওর মা, মামা বা রিনির জানার কথা না, তাহলে কীভাবে রিনিরা জানলো? ‘রিনি, হাসানের বাসার চাবি আমার কাছে কে বলল?’ ‘দিদি আমরা তো জানতাম ও হলে থাকে, কিন্তু কয়দিন আগে টিভি দেখে জানলাম, ও বাসা নিয়েছিল। আর ফুপুর শরীর খুব খারাপ আমরা যখন ঢাকায় রওনা দিচ্ছিলাম, আব্বাকে ফোন করে ওর এক বন্ধু ফুপুর খবর নেওয়ার সময় বলল, আপনার কাছে চাবি আছে আর ওর বাসায় চাইলে আমরা থাকতে পারি।’ ‘আর কিছু বলেনি?’ জানতে চাইল জয়া? ‘না বলেনি।’ জয়া দ্বিধায় (দোটানায়) পড়ে গেল রিনিকে চাবি দেবে কিনা, আসলেই দেওয়া ঠিক হবে কিনা। জয়া, হাসানের মায়ের ফোন নম্বরটা চাইল। রিনি ফোন নাম্বারটা দিল, ফোনটা সুইচড অফ বলছে। রিনির মুখের দিকে তাকালো জয়া, ফোন অফ। ‘দেখো রিনি, আমি বুঝতে পারছি তোমাদের ব্যাপারটা, কিন্তু হাসানকে না বলে আমি কীভাবে ওর বাসার চাবি তোমার হাতে দেই বলতো?’ ‘হাসানের বাসার চাবি আপনি হাসানের স্ত্রীর (ওয়াইফের) কাছে দিতে পারবেন না?’ ‘হাসানের স্ত্রী মানে, হাসানের স্ত্রী কে?’ ‘কেন, মাস তিনেক আগে হাসানের সাথে বিয়ে হয়েছে আমার!’ ‘কী আজেবাজে বলছ!’ ‘আপনি ফোন করে ফুপুকে জিজ্ঞেস করতে পারেন?’ জয়ার কেমন যেন গা গোলাচ্ছিল, সারাদিনের ক্লান্তিতে এমনিতেই নিজের শরীর জানিয়ে দিচ্ছে হাসানের সত্তা। তার উপর এইসব চাপে পাগল হয়ে যাবে জয়া মনে হচ্ছে। কিছু বোঝার আগেই জ্ঞান হারালো জয়া।

http://dlvr.it/TNv6XZ

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১৬ (সমাপ্তি)

Image
  ডিবি অফিস, মিন্টো রোড — দুপুর ১টা ১০। বাইরে মৃদু বৃষ্টি। অফিসে আজ অন্যরকম হাওয়া। করিডোরে পুলিশ অফিসাররা ধীর গলায় কথা বলছে, কেউ কেউ তাকাচ্ছে সাদাবের দিকে — এমনভাবে, যেন সে এখন আর নিজের জায়গায় নেই।  তোমার রুমে একটা কাগজের ফাইলে তার মাঝে একট অফিসিয়াল চিঠি। — “ Case Transfer: Pulok Sen Murder / Hassan Missing – Handover to General Police. ” সাদাব টেবিলে বসে ছিল, মুখে নিরাসক্ত হাসি। এই কাগজটার মানে সে ভালো করেই জানে — এখন থেকে এই কেসে তার কোনো অফিসিয়াল অনুমতি নেই। কিন্তু ফাইলের ভেতরে এখনও তার ছোঁয়া আছে — রিপোর্টগুলো, ল্যাপটপের স্ক্রিনশট, আর জয়ার পেনড্রাইভে পাওয়া “ EchoMask ” ফোল্ডার। সবই এখন প্রমাণ — যা কেউ স্পর্শ করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজে চায়। ঠিক তখন তার এক পুরানো বন্ধু সামনে এসে দাঁড়াল ফারজানা, সাইবার ইউনিটের ইনচার্জ। তারা একসাথে ট্রেনিং করেই পুলিশে জয়েন করেছে। সাইবার ইউনিটে কাজ করার জন্য বিভিন্ন কেইসে সাদাব কে প্রায় ই ফারজানার হেল্প নিতে হয়। তাই আরো জমে উঠেছে এই বন্ধুত্ব। ১৫ দিনের ট্রানিং শেষে গত কাল ই চায়না থেকে ফিরেছে ফারজানা। আজ অফিসে জয়েন করেই সাদাবের অফিসিয়াল...

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১৪ ও ১৫

Image
  চতুর্দশ পর্ব দিল্লির এক বেসরকারি ক্লিনিক। জয়া তার সন্তানকে নিয়ে অপেক্ষায়। ভেতরে একটি কেবিনে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ফিরে আসা হাসান শুয়ে আছে। জয়া এক মুহূর্তে দ্বিধায় পড়েছিল — সে কি সত্যি সত্যি প্রতিশোধ নিতে দিল্লি এসেছে, নাকি তার ভালোবাসাকে বাঁচাতে? হাসানকে এমন ভয়ঙ্কর অবস্থায় দেখে প্রতিশোধের আগুন যেন সামান্য স্তিমিত হয়ে এসেছে। এই দুইয়ের মাঝে জয়া সেন বা নন্দিতা ব্যানার্জী হিসেবে তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। সে এখন শুধুমাত্র একজন মা এবং তার সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের রক্ষাকর্ত্রী। হাসান এখন স্থিতিশীল, কিন্তু তার ডান চোখে ব্যান্ডেজ, আর বাম চোখটাও ফ্যাকাশে। জয়া ঢুকতেই হাসান ফিসফিস করে বলল, “ জয়া, তুমি ভুল পথে যাচ্ছো … এই খেলা অনেক বড়। ” তার কণ্ঠে অনুশোচনা নেই, আছে এক শীতল সতর্কতা। ডিবি সদর দপ্তর: T.R. এবং ডিজিটাল মুখোশ ঘড়িতে ১টা ৪২। ডিবি সদর দপ্তরের আলো নিভে গেছে, কেবল সাদাবের রুমটা জ্বলছে। টেবিলে তিনটি জিনিস — জয়ার রুমে পাওয়া পেনড্রাইভ, এক কাপ ঠান্ডা কফি, আর পুরনো ফাইল যার ওপরে লেখা “ Pulok Sen (Deceased) ” । বাইরে হালকা ঝড়, জানালার কাঁচে বৃষ্টির ছাপ নেই, কিন্তু বাতাসে বারুদের মতো গন্ধ।...

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১২ ও ১৩

Image
  দ্বাদশ পর্বঃ ডিবির এএসপি সাদাব মোহাম্মদের কাছে কেসটা খুবই জটিল আর আকর্ষণীয় লাগছে। ডিবি পুলিশের এই তরুণ অফিসার কেসটা ভিন্ন আঙ্গিক থেকে সূত্র খোঁজার চেষ্টা করছেন। তার অতীব আগ্রহের আরেকটা কারণ — হাসান ছেলেটি তার ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র। সাদাব জয়ার ফোন কলগুলো ট্র্যাক করতে গিয়ে দেখলেন, হাসানের নিখোঁজ হবার কিছুক্ষণ আগেও তার একটা নাম্বারে প্রায় ৩৫ মিনিট কথা হয়েছে, আর সেই নম্বরটি অতি আশ্চর্যজনকভাবে হাসানের এক্স গার্লফ্রেন্ড কান্তার। সাদাব দ্রুত কান্তাকে ট্রেস করার চেষ্টা করতে লাগলেন। কাকতালীয়ভাবে আজ সন্ধ্যায়ই কান্তার ফ্লাইট। সাদাব তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা আর স্পেশাল কিছু অনুমতির মাধ্যমে এয়ারপোর্ট থেকেই কান্তাকে আটক করলেন। কান্তাকে ইমিগ্রেশন থেকে বের করে এনে চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের রুমে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। কান্তা আকাশ থেকে পড়লো যেন — “ আমার সাথে অবশ্যই জয়ার সেদিন কোনো কথা হয়নি। ” “ কিন্তু আপনার নাম্বারে জয়ার সাথে আপনার কথা হয়েছে, এই দেখুন আপনার কল লিস্ট, ” বলে একটা লম্বা স্লিপের মতো কাগজ এগিয়ে দিল সাদাব। কান্তা বিরক্তি নিয়ে কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল — “ এই নাম্বার আমি ইউজ ক...