ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ০৬ ও ০৭

 


গ্রীন আমব্রেলা ইন্সিওরেন্স কোম্পানির জি এম(ক্লেইম সেটেলমেন্ট) সুলতান হোসাইন জয়াকে জানালেন, তার বাবার ৫ কোটি টাকার লাইফ ইন্সুরেন্স ছিল, আর সেটার নমিনি জয়া। তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ক্লেইম এর অর্থ নিজের একাউন্টে নিতে পারবে। শর্তের অন্যতম হলো জয়া এই টাকার ২০% অবশ্যই  তার মায়ের একাউন্টে ট্রান্সফার করবে এবং জয়া অবিবাহিত থাকলেই কেবল মাত্র এই টাকা জয়া পাবে। নয়তো সম্পূর্ণ টাকা পূলক সেন ট্রাস্টের মাধ্যমে জনহিতকর কাজে খরচ করা হবে। এই অদ্ভুত শর্ত পূলক সেন নাকি মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেই ইন্সুরেন্সের উইলে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। জয়ার এত অবাক লাগছিল বাবার শর্তে। বিছানা ছেড়ে নামতে গেল জয়া হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিল খাটের পাশে রাখা বুক শেলফ ধরে। জয়ার ঝাঁকুনিতে তাদের সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট থেকে কেনা বুক শেলফ খুব জোরে ঝাঁকুনি খেল। শেলফের উপর থেকে একটা খাম এসে পড়লো জয়ার সামনে, বেশ ময়লা ধুলোয় ভরা খাম হাতে তুলে নিল জয়া। ভিতরে একটা ফর্ম, কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের সম্মতিপত্র। ‘আশার আলো’ নামে এক প্রতিষ্ঠানে কিডনি ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের জন্য আনা হয়েছে এই ফর্ম। বেশ কয়েক মাস আগে। জয়া অবাক হল, কে এনেছে এই ফর্ম!! হাসানের সাথে তার কখনোই এইসব নিয়ে কোন কথা হয়নি, তবে!! জয়া একটা ছোট টুল এনে শেলফের উপরে চোখ রাখলো, নাহ আর কিছুই নেই। কী ভেবে যেন সে খাম টা ব্যাগে ভরে নিলো। এবার সে রওনা দিল হাসানের মায়ের সাথে দেখা করবে ভেবে। 

গোল্ডেন আই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে জয়া ওড়না দিয়ে মুখ মুছল জয়া। তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে হাসানের মায়ের সামনে দাঁড়ালো। হাসানের মা ছোটবেলায় দেখেছেন জয়াকে। কাছে ডেকে নিলেন। জয়া হাসানের মায়ের শরীরের খবর নিল। তারপর বলল- “হাসান একটা ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন আন্টি সত্যি, কিন্তু পুলিশ ঐ বাসা অব্জারভেশানে রেখেছে, এখন আপনারা সেই বাসায় উঠলে কিছু ঝামেলা সৃষ্টি হতেই পারে, পুলিশ নাকি এসে চাবি ও নিয়ে গেছে”। ‘আপনি বরং চাইলে আমাদের বাসায় এসে থাকতে পারেন, আমার আর মায়ের ভাল ই লাগবে আপনি থাকলে”

‘নারে, মা এটা হয় না, তুমি বরং চাবি টা দিয়ে যাও হাসানের বাসার”

“আন্টি আপনাকে তো বললাম ই যে পুলিশ ঐ বাসা অবজারভেশানে রেখেছে, ঐ বাসার চাবি আমি আপনাকে দিতে পারছিনা। আর আরেক টা কথা আপনার জানা উচিৎ ঐ বাসা কিন্তু হাসানের একার না। আমারো’।

‘কী, এসব কী বলছ তুমি, আজ আমার ছেলে সামনে নেই বলে যা খুশি বলে যাচ্ছ!!”

হাসানের মায়ের সামনে দাঁড়ানো রিনি তখন বসে পড়লো হাসানের মায়ের পাশে, খাটে।

জয়া দিদি, আপনি কী বলছেন, আমি ওর বিবাহিত স্ত্রী,ঐ বাসা আপনার কিভাবে হলো!! আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছিনা’

জয়া এবার শক্ত গলায় জানালো- প্রথম কথা হচ্ছে, হাসানের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেক বেশি পুরানো আর গভীর। হাসান কেন সেটা আপনাদের জানায়নি সেটা আমি বুঝতে পারছিনা। সম্ভবতঃ আপনারা তাকে ব্ল্যাক মেইল করে বিয়ে করতে বাধ্য করেছেন বা এমন কিছু!

‘চুপ করো মেয়ে তুমি!”

এবার অপ্রকৃতিস্থের মত হেসে উঠল জয়া-‘ আপনারা ভ্রমের রাজ্যে আছেন, আমার গর্ভে হাসানের সন্তান। আপনার চাইলে ডি এন এ টেস্ট করাতে পারেন’ ‘আপনাদের ভোলাভালা হাসান আর আমার বিয়ে হয়েছে আরো ৩ বছর আগে”।

এবার কেদে উঠল রিনি। রিনির ফুপিয়ে কেঁদে ওঠার শব্দে হচকিত অবস্থা থেকে সম্বিত পাওয়ার আগেই জয়া হাসানের মা কে প্রণাম করে বলল-‘ মা, আপনার ছেলে না থাকলেও আপনার দায়িত্ব আমি খুব ভাল্ভাবেই সামলাতে পারব, অন্যের আশ্রয়ে না থেকে আপনার ছেলের বউয়ের কাছে চলে আসবেন আশা করি’। 

‘ও, হ্যাঁ, আর রিনির সাথে বিয়ের ব্যাপার নিয়ে বেশি জল ঘোলা করলে আমি থানা পুলিশ করতে বাধ্য হব, জানেন ই তো যে স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে অপরাধ’

বলে ক্রুর হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো জয়া।

হোটেল থেকে বেরিয়ে তার আর হাসানের প্রিয় রেস্টুরেন্ট ‘ENIGMA’ তে বসলো। খুব অদ্ভুত এই রেস্টুরেণ্ট প্রতিটা খাবারের নাম একেক্টা ধাঁধাঁ যেন। নরমাল চিকেন ফ্রাই লিখবে না এরা লিখবে Curry/ Fry of that, what is common to eat before it’s born and after it’s dead?

জয়ার এসব জিনিস খুব ই বিরক্ত লাগতো মাঝে মাঝে, কিন্তু হাসানের এই রেস্টুরেন্টের রিডল সল্ভিং ব্যাপারটা খুব ভাল লাগতো। একবার দোকানের মালিককে হাসান তাক লাগয়ে দিয়েছিল একটা কোডিং জিজ্ঞেস করে। হাসানের হেয়ালি মনে করে খুব হাসল জয়া। কী ভেবে যেন নূপুর টা বের করলো সে, খাবার আসার ফাঁকে সে টেবিলের উপরে রাখা টিস্যুর মধ্যে কলম দিয়ে অক্ষরগুলা আবার লিখলো। Y-B-I-F-B-S-B-L-K-J-B-3

জয়া ভাবতে লাগলো Y এর আগের বর্ন যদি হয় X, B এর A, I এর H এমন করলে পুরো কথাটা দাঁড়ায়- XAHEARAK শেষে আবার থ্রি। নাহ কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না জয়ার। আজ লাঞ্চে দেরি হয়ে গেলো জয়ার, খুব টায়ার্ড লাগছে। সে তবুও মাকে কিছু জানানোর আগেই সে ইন্সুরেন্সের অফিসে একবার ঢুঁ মারার সিধান্ত নিল। আজ সারাদিন সে বাসার গাড়ী টা নিয়ে এসেছিল, এখন ড্রাইভার কে বিদায় দিয়ে একটা রিক্সা ডাকলো।

হাসান আর জয়ার বিয়ের খবরে রিনি খুবই মুষড়ে পড়েছে। সে ভাবতেই পারছেনা, হাসান জয়াকে বিয়ে করেছে। আজ জয়ার কথায় বুঝলো তার পায়ের নিচে আসলেই মাটি নেই। এদিকে তার ফুপু মানে হাসানের আম্মা আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রিনি জানে হাসানের সাথে জয়ার বিয়ের খবর বাবাকে জানালে তার বাবা হৈ চৈ করে তুলকালাম কান্ড বাঁধাবে। এমন ও হতে পারে সে হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। খুব দ্রুত সিধান্ত নিল সে, ‘ফুপু, হাসানের সাথে জয়া দিদির বিয়ের কওন কথা বাবাকে বলার দরকার নাই, প্লিজ। আমরা হাসান ভাই ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো’, আর হ্যাঁ এতদিন আমি চুপ করে বসে ছিলাম ঠিকই এবার আমি হাসান ভাইয়ে খোঁজার চেষ্টা অবশ্যই নিজের মত করে করব। আমার ধারনা এই জয়া দিদি হাসান ভাইয়ের খবর জানে’, আপনি শুধু কথা দেন বাবা কে কিছু বলবেন না।‘ বলে শক্ত করে হাত চেপে ধরলো ফুপু। দু’ফোটা চোখের জল ফেলে মাথা ঝাকালেন হাসানের মা।

জয়া ইন্সুরেন্স কোম্পানির জি এম এর অফিসে বসে আছে। অত্যন্ত ধুরন্ধর দেখতে এই জি এম সুলতান সহজে তার হাত গলিয়ে ক্লেইম পাওয়া অসম্ভব, কিন্তু তার সামনে বসে আছে জয়া সেন- সদ্য খুন হওয়া জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক পূলক সেনের মেয়ে। কেইস টা খুব ই সেনসিটইভ। উপরের লেভেল থেকে চাপ আসবে একটু কিছু হলেই। এমনকি মন্ত্রীদের অনেকেরই বন্ধু ছিলেন পূলক সেন। এমন জাদরেল একজন ব্যাক্তিত্বের মানুষের মেয়ে এমন সাদামাটা ভাবতেই তার কিছুটা অবাক লাগলো। হ্যাঁ, জয়া মোটামুটি সুন্দরী। উজ্জ্বল শ্যামলা, গড়পড়তা বাঙ্গালী মেয়ের মাঝে তাকে আলাদা করে চোখে পড়বেনা। মাঝারি গড়নের হাইট। লম্বা চুল। তবে হ্যাঁ, এইকথা বলতেই হবে তার চোখ গুলো বেশ সুন্দর। জয়া বেশ জোর দিয়ে কথা বলে, যা তার ব্যাক্তিত্ত্বকে কিছুটা কঠিন করেছে বলে ভাবলেন সুলতান সাহেব। স্মিত হেসে বললেন- ‘মিস সেন, আসলে পূলক সাহেবের ব্যাপারে আমাদের খুব বেশি কোয়ারি নেই, আপনি আপনার ন্যাশনাল আইডি কার্ড, ডেথ সার্টিফিকেট আর আপনার পরিবার থেকে আপনি যে বিবাহিত নন সে মর্মে একটা এন ও সি ধরনের কাগজ লাগবে, যেটা আপনার মা দিলেও হবে’।

‘ঠিক আছে, আমি কালকের মাঝেই পেপার ওয়ার্কগুলো সেরে ফেলব, কিন্তু আমাকে একটু বলবেন কি, টাকাটা আমার একাউন্টে আসতে আসলে কয়দিন লাগবে, বাবার কিছু লায়াবেলিটিস আর ঋন ছিল সেগুলো আমি দ্রুতই শোধ করতে চাই’ আন্দাজে ঢিল ছুড়লো জয়া।

‘ আমাদের ম্যাক্সিমাম সেটেল্মেন্ট টাইম ১ মাস, তার উপর উনার এমাউন্ট টাও বেশ বেশি, আমার মনে হয় এক মাসের মাঝেই আপনারা টাকাটা পেয়ে যাবেন’

‘মেইক ইট ফিফটিন ওয়ার্কিং ডেইজ মিঃ সুলতান, আশা করছি আমাকে কাউকে দিয়ে ফোন দেয়াতে হবে না। এনিওয়ে জামিল কাকু কী অফিসে আছেন!!’

জামিল এমদাদ, গ্রীন আম্ব্রেলা ইন্সুরেন্সের এম ডি, নাম টা রুমে ঢোকার আগেই জয়া খেয়াল করেছে, কিন্তু আসলে তার সাথে ব্যাক্তিগত কোন পরিচয় তার বাবার ছিল কিনা তা সে জানেনা। তবে একটা জিনিস বুঝেছে এই মুহুর্তে কাজ বাগাতে হলে এতটুকু গেইসগেম তাকে খেলতেই হবে। জামিল এমদাদের নাম শুনেই গলা শুকিয়ে গেলো সুলতান সাহেবের, জামিল এমদাদ খুব ই বদমেজাজী ধরনের লোক আর একদমই উটকো ঝামেলা পছন্দ করেন না, এখন পূলক সেনের মেয়ে গিয়ে যদি তার নামে উলটাপালটা কিছু বলে তবে তার হয়ত চাকরি নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে। জিহবা দিয়ে ঠোট চেটে সুলতান সাহেব বলল- ‘স্যার সম্ভবত অফিসে নেই, আমি ১৫ দিনের মাঝে টাকা আপনার একাউন্টে ট্রানফারের ব্যাবস্থা করব। ‘

‘ থ্যাংক ইউ সুলতান সাহেব, আপনি স্মার্ট, আমি আপনাকে মনে রাখব’ বলে উঠে দাঁড়ালো সে।

সুলতান সাহেব বেশ বিগলিত হাসি দিয়ে উঠে গিয়ে রুমের দরজার খুলে সাহায্য করলো জয়াকে।

জয়া এখান থেকে সোজা চলে গেল বাসায়, ভীষন টায়ার্ড লাগছে তার।

রিনি ফুপুকে নিষেধ করে বেশ একটু রিল্যাক্স বোধ করছে। এবার সে ভেবে রেখেছে হাসানের ভার্সিটি বন্ধুদের খোঁজ করবে। ফুপুর কাছ থেকে হাসানের বন্ধু আবিদ আর ফাইয়াজের নাম্বার নিল সে। স্ত্রীর পরিচয় গোপন করে সে কাজিনের পরিচয়ে ফোন করলো আবিদ কে। আবিদ পরীক্ষা হলের ঘটনা যা সে জয়াকেও বলেছিল, পুলিশকেও বলেছে তা-ই বললো। জয়া আবিদের কাছে জিজ্ঞেস করছিল হাসানের শার্টের রঙ, প্যান্টের কালার। আবিদ বলল।

এবার সে ফোন করলো ফাইয়াজ কে। ফাইয়াজ, হাসানের নিখোঁজ হবার পর থেকে ক্যাম্পাসে আসেনা খুব একটু। সে একটু ভীতু কিসিমের। তাই এসব ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। তবু পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ এ তার নাম ও ছিল। রিনির কাছে সে ও আবিদের মত ই ঘটনার বর্ননা করলো। রিনি চুপ করে শুনলো। এবার জানতে চাইলো ঘটনার দিনে হাসানের পড়া শার্ট প্যান্টেড় কালার। ফাইয়াজের উত্তরে রিনি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এবার সে বুঝলো তার খটকা তাহলে ঠিক ই আছে। ফাইয়াজ জানালো নীল চেক শার্ট এর সাথে নীল ডেনিম পড়ে এসেছিল হাসান পরীক্ষা হলে। আর আবিদ বলেছিল লাল পলো শার্ট সাথে স্কাই ব্লু ডেনিমের কথা।

কিডনি কামাল দূর থেকে কয়দিন ধরে নজর রাখছে ২৪/২ নম্বর বাসার সামনে। এই বাসায় নাকি পূলক সেনের মেয়ে নিয়মিত আস যাওয়া করে। এই সব নজরদারির কাজ তার না, কিন্তু পূলক সেনের সাথে তার একটা খুনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তির ভিডিওটা কে যেন করে রাখছে, আর এখন ঐ ভিডিওটা দেখিয়ে ব্ল্যাক্মেইলিং করছে। কারন যে ছেলেটারে মারার কথা সেই ছেলেটা সে কিডন্যাপ করার াগেই  নিখোঁজ। সাংবাদিক পূলক সেন মরে তারে ফেলে দিছে বিরাট বিপদে। পূলক সেন খুন হবার কয়দিন আগে, কিডনি কামালরে একটা ছেলেকে খুনের জন্য একটা দেখা করেছিলেন। একটা চেক ও দিয়েছিলেন এডভান্স হিসাবে, যেদিন ছেলেটাকে ঢাকা ভার্সিটি থেকে তুলে আনার কথা ছিল, আর যেসময়ে তুলে নেয়ার কথা ছিল সেদিনই ক্যম্পাস এলাকায় খুন হলো পূলক সেন। ক্যম্পাসে তুলকালাম অবস্থা, এরমধ্যে একটা জলজ্যান্ত ছেলেকে কিডন্যাপ করা সহজ কথা না। কামালে কাছে পূলক সেন লোকটাকেই অতি ধূরন্ধর লেগেছে। হাসতে হাসতে ভয়ংকর সব কথা বলে সে। পূলক সেন মারা যাবার পর কামাল গিয়েছিল চেক টা ক্যাশ করাতে, পারেনি। সরকার নাকি তার একাউন্ট গুলো ফ্রিজ করে রেখেছে। কামাল পূলক সেনের কাহিনী কিছুই বুঝতে পারছেনা। যে ছেলেকে তার তুলে আনার কথা সেই ছেলে ঐ দিন থেকে ক্যাম্পয়াসেই নাকি নিখোঁজ। সে তো কিডন্যাপ করেই নাই সেদিন ক্যাম্পাসে ঢোকার সাহস ও সে করেনাই। ৪২ টা খুন করে তার নাম হয়েছে কিডনি কালাম। তার খুনের একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে, সে কিডন্যাপ করে খুনের আগে কিডনি দুটো বিক্রি করে দেয় উচ্চ মুল্যে। তার বেশির ভাগ ক্রেতাই দেশি। বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সাম্প্রতিক কালে তাদের এই অরগান ট্রান্সপ্লয়ান্টের চেইন টা সম্পর্কে কাজ করছিল, তার মাধ্যমেই কামালের সাথে পরিচয় পূলক সেনের। পুলক সেন লোকটা এম্নিতে দুই হাতে পয়সা খরচ করে। ভাবা যায়, এই লোক কোন কারন ছাড়াই তার কাছ থেকে কিডনি কেনার জন্য কিছু টাকা দিয়ে রাখছিল, কামাল জিজ্ঞেস করেছিল কার জন্য। হাসতে হাসতে পূলক সেন বলেছিল উনার নিজের জন্যই নাকি। কামালের অবশ্য কিডনির ব্যাবসা দীর্ঘদিনের, স্বেচ্ছায় অনেকে কিডনি বিক্রি করে, সেখানে খুব কম টাকায় কিডনি পাওইয়া যায়। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নাম সর্বস্ব ক্লিনিকের সাইনবোর্ড লাগিয়ে তারা এই ব্যাবসা করে।

গত শুক্রবার রাতে সে একটা অদ্ভুত কল পেয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে তার এই বাসার দিকে চোখ রাখা। এই লোক ফোন করে জানিয়েছে এই বাসার সামনে তার ডিউটি অবশ্যই ২৪ ঘ্ন্টার, পূলক সেনের মেয়েকে সব রকমের হেল্প যেন সে করে। পূলক সেনের মেয়েকে অবশ্য কামাল আগে চিনতো না, সিকিউরিটির কারনে কোন মিডিয়াতেই পূলক সেনের মেয়ে জয়া সেনের ছবি আসেনি। শুক্রবার রাতে তার সিক্রেট চ্যাটে যে মেয়ের ছবি এসেছে সে তো অস্মভব সুন্দরি। পুলক সেন দেখতে ছোট খাটো মানুষ হলে কি হবে, মেয়েটা তার বড়ই সুন্দর। ভাবতেই জহবা দিইয়ে ঠোঁট চ্যাটে সে। জয়া সেন এই বাসায় এই বুড়ির কাছে আসে বলে তার ধারনা। প্রায়ই বারান্দায় এক বুড়িকে নিয়ে দাঁড়ায়। যে তাকে কল করছিল সে অবশ্য তার জন্য অনেকগুলো টাকা পাঠিয়েছে, তার এভারেজ খুনের রেটের চেয়ে বেশি। ভয় এবং টাকা দুই কারনেই নজরদারির মত তুচ্ছ এক এক কাজ সে করছে। অবশ্য ভালই হয়েছে, এখন তো বয়স বাড়ছে, রাস্তা থেকে তুলে এনে খুন খারাবির মত কাজ দিনে দিনে কঠিন হয়ে যাচ্ছে, এম্নিতেই গত বছর তার এক সহযোগির ভুলে বুঝতে না পেরে এক এম পির শালাকে খুন করে ফেলেছিল, সেই কেইস এখনো তাদের মাথার উপর ঝুলছে। এইজন্য গত এক বছরে খুব একটা ব্যাবসা করতে পারেনি তার গ্রুপের ছেলেরা। টাকা পয়সার টান্টানি যাচ্ছে এম্নিতেই। দুই একটা কেইস খেলে এম্নিতেই পানির মত পয়সা বেড়ীয়ে যায়।  সে একটা সিগারেট ধরিয়ে অপেক্ষা করছে। হলুদ কালারের একটা শাড়ী পড়ে বাড়ীটা থেকে বেরিয়ে আসছে পূলক সেনের মেয়ে জয়া। আহারে কী সুন্দর একটা মেয়ে, বুকের ভেতর টা ছলাৎ করে উঠে। সে বাইকে উঠে বসে। মেয়েটা গলির মুখ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে রিক্সা নেয়। কামাল বুঝেনা, এত টাকা যে মেয়ের বাপের, সে রিক্সায় ঘুরে ক্যান।

সে রিক্সার সাথে নিরাপদ দূরত্ব রেখে বাইক টান দেয়, এইটা খুবই বিরক্তির কাজ তার জন্য, রিক্সার পেছনে কি আর নাইক চালানো যায়!! ধূর। মেয়েটা ইউনিভার্সিটি এলককায় যাচ্ছে। আচ্ছা। ভালই হলো, অনেকদিন কলা ভবনের সামনে থেকে ভেল পুরি খায় না কামাল। পুরির মধ্যে কুচি করে কাটা শসা, টমেটো আর ঘুঘ্নি, সাথে ঝাল আর টকের অদ্ভুত কম্বিনেশান। কামালের কাছে একদম বেহেশতি খাবার মনে হয়। মেয়েটা কলা ভবন ক্রস করে রেজিস্ট্রার বিলিডিং এর দিকে যাচ্ছে। রেজিস্ট্রার বিলডিং এর বাইরে বাইক থামালো কামাল। রেজিস্ট্রার বিল্ডিং এর বাইরে ডাব বিক্রি হচ্ছে। কামাল ভেতরে শাস দেয়া একটা ডাব নিল। আয়েশ করে দুটা টান দিতেই তার ফোন ভাইব্রেট হতে থাকলো। ফোন তুলেই এক অপরিচিত নাম্বারের ফোনের ওপাশ থেকেই সেই কন্ঠস্বর-’ কোথায় তুমি?’

‘আমি তো রেজিস্ট্রার বিল্ডিং এর সামনে’

‘মেয়েটা কই?

‘মেয়েটা ভেতরে ঢুকেছে, আমি বাইরে তাকে পাহারা দিচ্ছি’

‘গাধা, মেয়েটা ভেতরে ঢুকেছে আর তুমি বাইরে কী করছ! তোমাকে না বলেছি এই মেয়েকে কখনোই চোখের আড়াল করা যাবেনা!’

‘এখন কী আমি ঢুকে খুঁজে দেখব?’

‘হ্যাঁ, দ্যাখো, তবে মেয়েটা যেন চোখের আড়াল না হয়ে যায়!!’

কামাল ফোন রেখে ডাব টাতে আরেকটা চুমুক দিয়ে রেজিস্টার বিল্ডিং এর ভেতর ঢুকে যায়, কিন্তু তার কাছে গোলক ধাধার মত লাগে। কিছুতেই সে আর খুঁজে পায়না মেয়েটাকে। দৌড়ে গেটের কাছে আসে, মেয়েটাকে খুজেই পায় না আর। কী করবে ভেবে পায়না। আসে পাশে কিছু চক্কর দিয়ে আবারো ওই বিলডিং এর সামনে দাঁড়ায়। একজন মধ্য বয়ষ্ক লোককে দেখা যাচ্ছে এখন ঐ ফ্ল্যাটের বারান্দায়, সিগারেট খাচ্ছে। উনাদের কোন আত্মীয় হবে হয়ত। সেই নাম্বারে আবার কল ব্যাক করলো মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলেছে এটা জানানোর জন্য। নাহ, নাম্বারটা বন্ধ। এই অপরিচিত ফোনটা একেকবার একেক নাম্বার থেকে আসে, আর কখনোই কল ব্যাক করা যায় না।

*****

জয়া কয়দিন ধরেই বাসায়, শরীর টা ভাল যায় না, প্রেগ্ন্যান্সির নানান ধরনের উপসর্গ তাকে অস্থির করে তুলছে। হাসান, রিনিকে বিয়ে করেছিল এই অসহ্য সত্য টা জয়া একবারের জন্যো মেনে নিতে পারেনা। হাসান শুধুই তার। স্কুলের মাঠে হাসান যখন ক্রিকেট খেলতো, জয়া দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখতো, বেশিরভাগ দিনই সে কাছে যাওয়ার আগেই দেখা যাত এক গাদা বন্ধু আর কান্তা দ্বারা পরিবেষ্টিত হাসান। সে সবসময় হাসানের সব চেয়ে প্রিয় মানুষ হতে চেয়ছে, কিন্তু হাসান কেন যে কান্তার জন্য এত পাগল ছিল আজো হিসাব মেলেনা জয়ার। কানাত খুবই ঠোঁটকাটা স্বভাবের মেয়ে বরাবরই। হাসান ছাড়া কেউ ই অহঙ্গকারি কান্তাকে তার ওমন স্ট্রেট ফরোয়ার্ড স্বভাবের জন্য ভালবাসতও না। হাসানের বাবা মারা যাওয়ার সময় টাতে জয়ার সব চেয়ে অসহ্য লেগেছিল কান্তাকে। অসহায় হাসানের কাছে যেতে চাইতো না কান্তা, তার নাকি হাশিখুশি হাসানের করুন মুখটা সহ্য হয় না। একদিন বন্ধুদের সাথে সিগারেট খেয়েছিল হাসান কৌতুহল বশতঃ[তহনো সিগারেটের নেশা পায় নি হাসান কে, হাসান বরাবর ই যে কোন নেশা বিরোধী] জয়া ইনিয়ে বিনিয়ে কানাতকে ব্যাপারটা জানাতেই কান্তা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে, জয়া তখন আগুনে ঘি ঢেলে দেয় এই কথা বলে যে, ‘জানিস হাসানরা নাকি বাড়ী ভাড়া দিতে পারছেনা’ কান্তার অহংকারি জবাব- ‘সিগারেট তো ঠিকই খেতে পারছে’ জইয়া হাল্কা বোঝানোর ট্রাই করেছিল- ‘দ্যাখ হাসান খারাপ একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে’

জয়ার এক কথা- ‘ তার মানে এই না যে সে নষট হয়ে যাবে’

কলেজের টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারেনি বাবা মারা যাওয়ার আর সেইসময়ে মা খুব অসুস্থ ছিল বলে। হাসান খবর টা জানাতে পারেনি কান্তাকে। জয়া হাসানের বাসায় গিয়ে ব্যাপারটা জেনেছিল এবং খুব ভাল ান্ধবীর মত কান্তাকে জানাতে বলেছিল। নানান ধরনের ঝামেলায় জর্জরিত হাসান কিছুটা উষ্মাতেই বলেছি, আমার কী আর প্রেম ভালবাসার সময় আছে?’

জয়ার ও খবর টা কান্তা কে দিতে দেরি হয় নি- জানিয়েছিল কান্তার সাথে সম্পর্ক টাকে নাকি ভোলার চেষটা করছে হাসান। কান্তার মাঝে একটু একটু করে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল হাসান কে ঘিরে। এর মাঝে জয়ার মায়ের কাছ তেক হাসানের মা হাজার দশেক টাকা ধার করেছিল, যদিও সময় অনুযায়ী ফেরত ও দিয়েছিল। জয়া কান্তাকে এই তথ্য দিতেও ভুল করেনি। কী ভেবে জানি জয়া কান্তাকে কিছুটা খোঁচা মেরেই বলেছিল- ‘তোর হাসানের মা তো ইদানীং টাকা ধার নেয়ার জন্য আমাদের বাসায় এসে বসে থাকে, কাল হাসান এসে দশ হাজার টাকার নিল। কে জানে আদৌ দিতে পারবে কিনা!! আমি অবশ্য মা কে বলেছি কতই তো দান দক্ষিণা কর। হাসান্ রা যখন বিপদে সাহায্য না হয় করলে!!’

বলেই কান্তার রক্তম মুখের দিকে তাকিয়ে অলক্ষ্যে হেসেছিল জয়া। পরে অবশ্য জেনেছিল, কান্তা হাসান কে অনেক বার টাকা দিয়ে হেল্প করতে চেয়েছে কিন্তু হাসান নাকি নেয় নি। তখন নাকি হাসান কে বেশ অপমানিত হতেও হয়েছে কান্তার সাথে, এসন কথ হাসানের কাছ থেকেই শোনা হাসানের। জয়া মাঝে মাঝে ভাবে কান্তার কাছ থেকে হাসান কে কি ছিনিয়ে এনেছিল সে!! হলে হব, মুখ টিপে হেসে নিজের মনেই বলে- ‘everything is fair in love and war. কিন্তু হাসান কে কী হারিয়ে ফেলল সে!! কোথায় হারালো তার হাসান, তার একলার হাসান। কান্তার মত উন্নাসীক সুন্দরীর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা তার প্রথম এবং একার পুরুষ হাসান।

রিনির ফোনে সম্বিত ফিরে পেল জয়া। রিনি তাকে কেন ফোন করেছে! আচ্ছা নাছোড়বান্দা তো এই মফস্বলের মেয়ে!। সে যথাসম্ভব হাল্কা গলায় ফোন ধরে বলল- ‘হ্যাঁ রিনি বলো!’

‘জয়া দিদি, আপনি কি জানেন হাসান তো পরীক্ষাই দেয় নি!! তার এটেন্ডেন্স শীটে অন্য কেউ হয়ত সাইন করেছে। তার খাতা খুঁজে পাওয়া যায় নি। এবং সে ফেইল করেছে পরীক্ষায়’;।

‘কী বলছো তুমি!! কিভাবে জানলে’

‘দিদি আজ ওদের রেজাল্ট বেরিয়েছে এবং হাসান এর রেজাল্ট খাতা না পাওয়ার কারনে উইথেল্ড, বাবা মাত্র ভার্সিটি থেকে খবর নিয়ে আসলো!!

জয়ার গলা শুকিয়ে আসছে, তাহলে আবিদ সবাইকে কেন মিথ্যা বলল???



Comments

Popular posts from this blog

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১৬ (সমাপ্তি)

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ০১ ও ০২

ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ১৪ ও ১৫