ধারাবাহিক উপন্যাস নিয়তি/ পর্ব ০৮ ও ৯ম
রিনি মনে মনে
ঠিক করেছে, হাসান ভাইয়ের নিখোঁজ রহস্য সে বের করবেই। জয়া যত কথাই বলুক, সে হাসানের
মুখ থেকে সব সত্য জানতে চায়, হাসান যদি তাকে ভাল নাই বাসে, তবে সে শুধু শুধু
হাসানকে আটকে রাখবেনা। শুধু সত্যিগুলো সে জানতে চায়। তার বাবার এক ছোটবেলার বন্ধু
মাহিন কাকা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করেন, বাবাকে অনেক বলে কয়ে তার সাথে দেখা
করেছে রিনি গতকাল। মাহিন কাকাই জানালো হাসানের খাতা নাকি খুঁজে পাওয়া যায় নি,
এটেন্ডেন্স খাতায় ও আসলে তার নামের পাশে অপরিচিত সাক্ষর বলে সনাক্ত করেছেন শিক্ষক।
আর কোন এক অজানা কারনে হাসানের নিখোঁজ হবার কেইস টা নিয়ে যে পরিমান হৈ চৈ হবার কথা
ছিল তা হয়নি।
মাহিন কাকাকে
অনেক অনুরোধ করল রিনি যেন ওর ক্লাসে অন্য কারো কাছ থেকে জানার ব্যাবস্থা করা যায়
যে হাসান আসলেই কি পরীক্ষ দেয় নি নাকি শুধু তার খাতাটাই গায়েব। রিনি জয়ার সাথে
দেখা করবে ভাবলো, রিনির ধারনা জয়ার কাছে হয়ত ওর আরো ফ্রেন্ডদের নাম্বার থাকতে
পারে। সে জয়াকে ফোন দিয়ে সব জানানোর পর জয়া বলল যে সে দেখছে। রিনি জয়ার বাসায় যাবে
বলে ঠিক করলো।
কলিং বেলের
শব্দে সচকিত হয়ে দরজা খুলল জয়া, ভ্রু কুচকে ফেলল, ‘রিনি। কী ব্যাপার রিনি, তুমি
হঠাৎ’।
‘আমার কিছু
কথা ছিল আপনার সাথে, তাই খবর না দিয়ে চলে আসলাম’
‘আমি একটু
বেরোব, রিনি। তুমি কী অন্যদিন আসবে?
‘দিদি, আমি
যাস্ট ১০ মিনিট বসব’
নাছোড়বান্দা
রিনিকে ড্রইয়িং রুমে বসালো জয়া, ড্রইয়িং রুমে একজন কালো সানগ্লাস পড়া লোক বসে ছিল,
জয়া ঢুকেই বলল ওকে তাহলে আপনি আজ আসুন। লোকটা রোবটের মত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাহলে
কবেকার টিকেট বুক করবো ম্যাডাম?। জয়া কিছুটা বিরক্ত হয়ে জানালো- আমি আপনাকে পরে
জানাবো।
লোকটার
যাওইয়ার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রিনি বলল- ‘কোথাও যাচ্ছেন নাকি দিদি?’
‘ও হ্যাঁ
মায়ের শরীর টা ভাল না, মাকে চেক আপের জন্য ইন্ডিয়া নিয়ে যেতে চাচ্ছি। চেইঞ্জ ও হবে
কিছুটা, আমারো চেইঞ্জ দরকার।’
রিনির একটু
খটকা লাগলো মনে, হাসানের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। এর মধ্যে জয়া ইন্ডিয়া যাবে
বেড়াতে!
‘তুমি যেন
কী বলতে চাচ্ছিলে”
‘ও হ্যাঁ,
দিদি, হাসানের অন্য কোন ফ্রেন্ডের নাম্বার কী আপনার কাছে আছে? বা আপনি কি যোগাযোগ
করতে পেরেছেন? আমি আবিদ আর ফাইয়াজ ভাই দুইজনের নাম্বার টাই বন্ধ পাচ্ছি। আমি আসলে
জানতে চাচ্ছিলাম, সে কী আসলেই পরীক্ষা দেয় নাই, তাহলে হলের অন্য কী কিছু বলল না
কেন?
‘দ্যাখো
পরীক্ষার আগের দিন লাস্ট কথা হয়েছে আমার ওর সাথে, আমি যতদূর জানি ওর যে পেপারের
পরীক্ষা ছিল, সেটা ওর ইমপ্রুভমেন্ট, আত হয়তো সেভাবে কেউ খেয়লা করেনাই।’
’হুম’ বলে
অনেক্ষন চুপ করে থাকলো রিনি, ওর মাথায় এখন রাজ্যের প্রশ্ন। ঠিক আছে আমি তাহলে উঠি।
রিনি যখন
গেটে দিয়ে বের হচ্ছিল, এই বাসায় তখন নজর রাখছিল কিডনি কামাল।রিনি বের হয়ে একটা
রিক্সা ডাকলো। কী ভেবে যেন একটু এগিয়েই রিক্সা থেকে নেমে কাছের একটা বাড়ীতে ডুকে
পড়লো। কিছুক্ষ্ণের মধ্যেই ...............।।
৯ম পর্ব
জয়াকে মোটামুটি
ঠেলে ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে গেট লাগিয়ে দিল আগন্তুক। জয়া ছাড়াবার চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছেনা।
আগন্তুকের হাত যখন আলগা হলো জয়া হাফ ছেড়ে বাচল। ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক হলো জয়া, আবিদ, হাসানের
বেস্ট ফ্রেন্ড। অনেকটা ভয় ও পেয়ে গেলো জয়া। এখানে এভাবে বদ্ধ দরজার মাঝে আবিদ। তবু
যথা সম্ভব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো-
‘কি ব্যাপার
তুমি এখানে?’
‘জয়া, অনেক হয়েছে।
আমি আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছিনা। আমার এডমিশান হয়ে গেছে তুমি কথামতো টাকার ব্যাবস্থা
করে দাও। তোমাকে ফোনেও পাচ্ছিলাম না।দুইদিনের মাঝে টিউশান ফী না পাঠালে আমার ইউনিভার্সিটি
এডমিশান ক্যান্সেল করে দিবে। আর তাছাড়া ডীন স্যার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, আমি অসুস্থতার
অজুহাতে এড়িয়ে গেছি। দ্যাখো, এইসব সাক্ষী সাক্ষী খেলা আমি আর খেলতে পারবো না। কবে টাকা
দিবে বলো??’
‘উফফ, তুমি
তো আচ্ছা ছোটলোক, টাকার জন্য বন্ধুর অন্তঃসত্তা স্ত্রীকে কেউ এভাবে ভয় পাওয়ায়!! টাকা
পেয়ে যাবে, এত অধৈর্য কেন তুমি!!’
‘অনেক ধ্যানাই
প্যানাই হয়েছে। আর শোন হাসান কে বলবে আমার সাথে যেন কন্টাক্ট করে। ওর ইংল্যান্ডের নাম্বার
টা আমাকে দাও’
বাইরে দাঁড়িয়ে
আড়ি পেতে শুনছিলো রিনি। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওর ধারনা প্রায় সঠিক, জয়া হাসানের
ব্যাপারে সবই জানে। জয়ার কাছ থেকে সব খবর বের করতে হলে অবশ্যই ওকে বুদ্ধি দিয়ে কৌশলে
আগাতে হবে। রিনির কেন যেন মনে হচ্ছে অতিধূর্ত জয়া হাসানকে কোন না কোন ঝামেলায় ফেলেছে।
‘জয়া, তুমি কালকের
মধ্যে অবশ্যই আমাকে টাকা দিবে, নয়তো আসল সত্যি আমি ডীন স্যারকে জানাবো। তোমার বাবার
ক্ষমতার ভয় ও আমাকে আটকাতে পারবেনা’
হঠাৎ ই অপ্রকৃতস্থের
মত হাসলো জয়া।
‘কী বলছো,
তার কোন ধারনাই নেই তোমার আবিদ। একবার যখন হুমকি দেয়া শুরু করেছ, তার মানে তুমি প্রায়ই
আমাকে হুমকি দিবে’ তো তোমাকে টাকা দিলেও দিবে, না দিলেও দিবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি
টাকাটা আমি তোমাকে দিব না’
এবার রাগে অস্থির
হয়ে জয়ার গলা টিপ দিয়ে ধরতে গেলো আবিদ। সচকিত জয়া সরে আসলো কয়েক পা। আবিদ ব্যালেন্স
হারালো। জয়া এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল-
‘আবিদ আমি চাইলে
এই মুহুর্তে তোমাকে লাশ বানিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু এইঘর আমার আর হাসানের পবিত্র সম্পর্কের
স্মৃতি ভন করছে, এখানে আমি তোমাকে মারবো না। তুমি যা খুশি করো।’
হতবিহবল আবিদ
এবার চিৎকার করে বলতে লাগ্লো-’তুমি একটা ডাইনি। কখনওই তোমার আর হাসানের বিয়ে হয়
নাই, তোমাদের সন্তান অবৈধ। তুমি একটা ডাইনী। আমি পুলিশকে সব বলে দিব।’
ক্রুর হাসিতে
জানালো জয়া-"আবিদ, তুমি আসলে সবসময়ই আমাকে আন্ডারেস্টিমেট করেছ, যাও পুলিশ
কিংবা ডীন যাকে খুশি জানাও"
"ইউ বিচ" বলে দাতেঁ দাতঁ
চেপে আবিদ দরজা খুললো, চমকে দ্রুত অন্যপাশে সরে গেলও রিনি।
দ্রুতগতিতে আবিদ
নেমে যাবার সাথে সাথেই কাকে যেন ফোন করলো জয়া, খুন আস্তে কথা বলায় তেমন কিছু শুনতে
পেলো না, শুধু বুঝলো কাউকে কিছুর নির্দেশ দিল জয়া।
জয়া এবার গুনগুনিয়ে
একটা গান গাইতে গাইতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচঁড়াতে লাগলো। দূর থেকে আয়নার
দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠল রিনি। ব্যাবহৃত টিপ দিয়ে লেখা একটা বাংলা শব্দ- "ডাইনী"।
নানান আকৃতির
টিপের মাঝে এমন একটা প্যাটার্ণে লেখা যা কিনা কেবল দূর থেকে চোখে পড়বে। হাসান আর জয়া
ছাড়া এই ফ্ল্যাটের খবর কেউ জানতো না, তাহলে হাসান লিখলো ডাইনি! কাকে? জয়াকে? হাসান
কী কোন ম্যাসেজ দেয়ার ট্রাই করছিল। আচ্ছা কোনভাবে কি হাসানের ফোনটা ট্র্যাক করা যায়
না? তার লাস্ট লোকেশান কোথায় ছিল যদি জানা যেত!
জয়া এবার বিছানায়
বসে একটা কাগজের মাঝে হাসানের দেয়া নূপুরের কোড মিলানোর ট্রাই করছিল।
জয়া নেড়েচেড়ে
দেখলও, কতগুলো এলফাবেট ছাড়াও একটা সংখ্যা তিন। কান্তা বলেছিল, এই পদ্ধতিতে সংখ্যার
একটা ভূমিকা আছে। এ সংখ্যার উল্লেখ থাকবে, সেই পরিমান স্পেস ইউজ করতে হবে। এখানে ৩.
মানে কী ৩ স্পেস। জয়া এলফাবেট ছক তৈরি করে নিল। এবার কাপাঁ হাতে নূপুরের অক্ষর গুলো
মিলাতে লাগলো। ৩ স্পেস মানে A=D, B=E.
তাহলে,YBIFBSBLKJB3” এর অর্থ দাঁড়ায় Believe on me. হাসান তাহলে তাকে তার উপর বিশ্বাস রাখতে বলছে!
এবার ডুকরে কেদেঁ উঠল জয়া।
রিনি অবাক হয়ে
জয়ার কান্না দেখতে লাগলো। একটু হলেও রিনির খারাপ লাগছে জয়ার জন্য। হাজার হোক, সন্তান
সম্ভাব্য মেয়ে, স্বামীর খোজঁ নেই, বাবাকেও হারিয়েছে।
সন্ধ্যা প্রায়
হয়ে আসছে জয়া বাসায় যাওয়ার জন্য উঠল। যাবার আগে ছাদের গাছ গুলোতে পানি দিবে ভেবে ছোট
একটা বালতি করে পানি নিয়ে আসলো।
ঠিক এই সময় তীক্ষ্ণ
শব্দে রিনির মোবাইল বেজে উঠল, রিনি দ্রুত ব্যাগ খুলে ফোন টা বন্ধ করতে যাবার সময়ই সামনে
এসে দাঁড়ায় জয়া। ঠোঁটের কোণে বিশ্রী হাসি।
"তাহলে তুই
ই আমাকে ফলো করছিলি!"
তুই সম্বোধনে
বিব্রত রিনি, "দেখুন জয়া দি, হাসান কে...
" চুপ তোর
মুখে আমি হাসানের নাম ও শুনতে চাই না, তোর জন্যই আমি হাসানকে হারিয়ে ফেলেছি। হাসানের
মৃত্যুর জন্য তুই দায়ী" জ্বলন্ত চোখে জয়া রিনিকে চিৎকার করে বললো।
"হাসান মারা
গেছে মানে? আপনি কিভাবে জানলেন!"
বিস্মিত রিনি
প্রায় কেদেঁ ফেলল। বিস্মিত রিনি প্রায় কেদেঁ ফেলল।
নিজেকে সামলে
নিল জয়া, এবার একটু নরম গলায়- "না মানে এমনি, সবময় তো আগে খারাপ সম্ভাবনার
কথাই মাথায় আসে এইজন্যই বললাম। তুমি ই বা এখানে আমাকে অনুসরন করছ কেন?"
"এমনি দিদি,
আপনি আমাকে অপছন্দ করছেন, আমি বুঝতে পারছি, আপনার জায়গায় থাকলে আমিও করতাম। কিন্তু
আসলে যা ঘটে গেছে তার উপর আমাদের কারো হাত নেই, এটাই অমোঘ সত্যি। আপনি স্বীকার না করলেও
হাসানের স্ত্রী আমি, ঠিক যেমন আপনি"
"আবার
ও এইসব কথা বলে আমার মন মেজাজ দুটোর কন্ট্রোলই নষ্ট করছ, হাসান শুধুই আমার ছিল"
"আপনি কিন্তু
আবারো পাস্ট টেন্সে কথা বলছেন জয়া দি!”
কেমন যেন খ্যাপাটে
শোনাচ্ছিল জয়ার কন্ঠস্বর। রিনি বুঝতে পারছিল জয়াকে না রাগিয়ে কথা বের করতে হবে তার
কোনভাবে। ধুর্ততার সাথে তাই জবাব দিল-‘ আমি শেষ করতে পারিনি দিদি, আসলে হাসানের
মনের মানুষ তো আপনি ই, তার প্রমাণ তো আপনি আপনার মাঝে বহন করেই চলেছেন, আমি বলতে চাচ্ছিলাম,
ঘটোনা চক্রে যদিও আমার সাথে ওর বিয়ের প্রক্রিয়া হয়েছে, সেটা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য
ও তো ওকে প্রয়োজন। তাই আপনি যদি সাহায্য করতেন।”
“আমার সাথে চালাকি
করোনা রিনি, হাসানের খবর আমার জানার কথা না। আমার সাথে শেষ দেখা হবার আরো দুইদিন পর
সে নিখোঁজ হয়েছে। তবুও তোমাকে আমি খবর পেলে জানাবো। আমার পিছে আর অনুসরন করোনা।”
রিনি পরিস্থিতি
সামলে নেয়ার জন্য বলল- ‘দিদি আমার অন্যায় হয়েছে, আসলে ফুপু ও তো সন্তানের জন্য দিশেহারা।
আমিও নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে আপনাকে অনুসরন করে ফেলেছি, ক্ষমা করবেন আমাকে।’
মন গললো কিছুটা
জয়ার। ঠিক আছে আজ তুমি এসো। আমি ও কিছুক্ষনের মাঝে বের হবো। তখন সন্ধ্যা প্রায় বাসার
দিকে পা বাড়ালো রিনি।
জয়া খুব যত্নের
সাথে ছাদ বাগানের গাছ গুলোতে পানি দিল আজ, বিশেষ করে, বাড়ী ওয়ালার পরিত্যাক্ত বাথ টাবের
উপর একটা ডাটা শাকের বেড তৈরি করছিল হাসান। কি সুন্দর তরতাজা হয়ে উঠছে শাক গুলো। নিজের
অজান্তেই চোখে কোনে জল। দ্রুৎ ফ্রেশ হয়ে বাড়ীর পথে পা বাড়ালো জয়া, ছাদের গেট পর্যন্ত
গিয়েই আরেকটা কোডের কথা মনে পড়লো। ফ্রিজে রাখা সেই ছোট প্যাকেটটা। কি ভেবে যেন আবার
ব্যাক করলো সে।
দ্রুতই রাত নেমে
আসছে এই শহরে। আর স্তম্ভিত জয়া বসে আছে হাতের আঙ্গুলের প্যাকেট টা নিয়ে। যার উপরে লেখা MRILH-2058. যেহেতু কোন সিঙ্গেল ডিজিট নাই তাই এক ডিজিটে স্পেস
দিয়ে আসে- স্পেসে সিজার সিফার করলে দাঁড়ায়- PULOK. মানে কি? বাবার
নাম? নাকি অন্য কোন পূলক! আর নাম্বার টা? সেটা কি? এই আঙ্গুল কী বাবার? নাম্বারটা বারেবার
দেখলো। ২০৫৮। আচ্ছা এটা কোন তারিখ নয়তো! এটা ২০২০ সাল! বাবার লাশ পাওয়া গেলো মে মাসের
৭ তারিখে, মে মাস মানে বছরের পঞ্চম মাস, 58 মানে কি মে মাসের ৮ তারিখ নাকি? তা কি করে
হয়! বাবার পোস্ট মোর্টেমে কোথাও তো হাতের আঙ্গুল কাটার কথা বলা হয় নাই! তাহলে কী পোস্টমোর্টেমের
পরে সযতনে কেউ কেটে নিয়েছিল আঙ্গুল, সৎকারের আগেই?
সকালের পত্রিকা
হাতে চমকে উঠলো রিনি, প্রথম পাতায় গতকাল জয়ার বাসায় দেখা আবিদের ছবি। গত সন্ধ্যায় দ্রুতগামী
এক প্রাইভেট কারের নিচে পড়ে ঘটনাস্থলে পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে আবিদের। শিরদাড়া
বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে চলল রিনির, এটা কি একসিডেন্ট নাকি হত্যা!! গতকাল জয়ার বাসায়, জয়া
রীতিমতো থ্রেট করছিল আবিদকে। আবিদের মৃত্যুর পেছনে জয়ার কোন হাত নেই তো, ভাবতে ভাবতে
বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, রাস্তার উলটো ধারে একজন লোক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের বাসার
দিকে। বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছে সে। কিন্তু তাকে বা তাদের বাসায় কে ফলো করবে, কেন
ই বা করবে?
রিনির একটা অদ্ভুত
শখ ছিল ছোটবেলায়, সে চুলের ক্লিপ দিয়ে তালা খুলতে পারতো। আজ সে বিদ্যা কাজে লাগানোর
সময় এসেছে। রিনির মন বলছে, হাসানের বাসায় ই সেই রহস্য লুকিয়ে আছে যা সে এতদিন ধরে খুঁজছে।
হাসানকে খুঁজে বের করা তারকাছে এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই লোক যদি সত্যি তাকে
ফলো করে থাকে, তাহলে কিভাবে সে বের হবে। সে একটা বুদ্ধি বের করলো ফুপুর বোরকা পড়ে বেরিয়ে
গেলো আজ সে, কোন রিকসা না সে সে একটা সি এন জি নিল। তার প্ল্যান হাসানের বাসার বেশ
দুরেই সে আজ সি এন জি থেকে নেমে আসবে। তারপর একটু ঘুরে হেঁটে এলাকাটাও দেখবে, আস্তে
ধীরে ঐ বাসায় ঢুকবে।
রিনি আজকে কিছু
বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করেছে, তার বাবার একটা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পড়ে নিয়েছে, আর
চুল গুলো ঢাকতে বেধেছে পাগড়ি, তার উপর বোরকা। আজ সে ভীষন রকম উত্তেজিত, তার মন বলছে
হাসানের বাসায় লুকিয়ে থাকা কোন একটা রহস্যের সীমানা সে উদ্ধার করতে পারবেই। বের হবার
আগে সে একটা অটো জেনারেটেড ফেইসবুক পোস্ট শিডিউল করে গেলো, ২ ঘন্টা পরের, যদি এই সময়ের
মাঝে ফেরত না আসে তবে পাব্লিকলি হেপ পোস্ট হিসাবে সার্কুলেটেড হবে। এর এক ঘন্টা পর
হাসানের মৃত্যুর ব্যাপারে তার থিওরিটা পাব্লিশ হবে।
রিনি খুব সাবধানে
ছাদে উঠে আসলো, তার আগে অবশ্য দারোয়ান তাকে আটকেছিল, সে বুদ্ধি করে তিনি তলার বকুলদের
বাসায় যাবার কথা বলেছে। দিন কয়েক আগে, বের হবার সময় নিচে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক কে বকুল
বকুল বলে ডাকতে শুনেছে। পরে আড় চোখে তাকিয়ে ৩ তলায় অল্প বয়সী এক মেয়েকে হাত নাড়তে দেখেছ,
আজ এই বকুল নাম টা সে কাজে লাগিয়ে খুব সতর্ক ভাবে ছাদে উঠে আসলো, ছাদের দরজায় তালা
নেই, সে আস্তে করে খুলল। তারপর ভেতরে ঢুকে ছিটকিনি টেনে দিল।
কেমন যেন গা ছমছমে
এক টা অনুভুতি হচ্ছে রিনির। একসাথে ভয়, টেনশান, আর হাসানের জন্য তীব্র আবেগ সব একসাথে
মিলে মিষে কেমন যেন শিরশিরে একটা অনুভূতি হচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে সামনে আগালো, ছোটবেলার
চর্চিত বিদ্যা চুলের ক্লিপ দিয়ে তালা খোলার ট্রাই করতে লাগলো। বার কয়েকের চেষ্টায় গেট
টা খুলতে পারল রিনি। খুব সন্তর্পনে রুমে ঢুকে বোরকা খুলে ফেলল। চুপ করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে
চারদিকে চোখ বুলাল, ছিমছাম সাজানো একটা ঘর, হাসান আর জয়ার খুব চমৎকার একটা হাসিমুখের
ছবি, ছবিটার দিকে চোখ পড়ে বিষন্ন হয়ে গেলো রিনি। হাসানের দুর্বল ব্যাক্তিত্ব তার নিজের
ও তো অবশ্যই জয়া আর রিনির জীবনটাকে একটা গভীর জটিলতার মুখে ফেলে দিয়েছে। রিনি চুপচাপ
ঘরটাকে দেখলো, পুলিশ এসেছিল শুনেছে সে,কিন্তু পুলিশ কী সার্চ করেনি? সে আলমারি টা খোলার
চেষ্টা করলো, নব ঘোরালো ক্লিপে চাপ দিয়ে তালা খোলার ট্রাই করল। উহু খুলল না। বার কয়েক
চেষ্টা করেও খুলল না, ভাল করে কাবার দেখলো রিনি, দরজার উপরের দিকে একটা নাম্বারিং লক।
ইশ, এই নাম্বারিং লক কিভাবে খুলবে!! কিছুক্ষনের হতবিহবলতা কাটিয়ে ভাবতে লাগলো রিনি,
দেখা যাক কতটা চেনে সে হাসান কে, আচ্ছা কিন্তু যদি জয়ার দেয়া নাম্বারিং কি হয়ে থাকে!!
সেই সম্ভাবনা ঝেড়ে ফেলেই রিনি চেষ্টা করতে বসলো।
জয়ার ফ্লাইট আজ
রাতে, খুব সন্তর্পনে দেশ ছাড়ছে জয়া সেন সাথে তার মা, কেউ জানলোই না কত ভয়াবহ চাল খাটিয়েছে
জয়া সেন, মনে মনে হাসলো জয়া। আজীবন বন্ধু মহলে ডাম্ব হিসাবে পরিচিত জয়া কী সুনিপুন
এক চালে জীবনের সব সমস্যার এক ক্রুড় সমাধান টেনেছে, ভেবেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল
জয়ার। এয়ারপোর্টে প্লেন এ উঠে তার ডি আই জি কাকা কে ফোন করে হাসানের খুনের তথ্য টি
জানাবে বলে ঠিক করে রেখেছে জয়া। হ্যাঁ, হাসান খুন হয়েছে। যে হাসান তার না, সে হাসান
কারোর না। রিনিকে বিয়ে করেছিল সে জানতে পেরেছিল, হাসানের কাছে আসা একটা টেক্সট ম্যাসেজ
থেকে, যেদিন ম্যাসেজ টা সে পেয়েছিল ঠিক সেদিন ই কাকতালীয় ভাবে জেনেছিল গর্ভের সন্তানের
কথা। হাসান কে জিজ্ঞেস করলে সে অস্বীকার করে। সে খুব সন্তর্পনে খোঁজ নিয়েছিল আবিদ কে
দিয়ে, নিম্ন মধ্যবিত্ত আবিদের টাকার অসীম চাহিদা ছিল। সেটা জেনে মোটা অংকের টাকার বিনিময়
করেছিল হাসানের প্রকৃত সত্য উদঘাটন করেছিল ধুর্ততার সাথে। শুধু একটা সত্য নয়, ব্যাপার
টির সাথে তার সব কিছু জড়িয়ে গিয়েছিল, তার মাত্র কয়দিন আগেই জয়া জানতে পেরেছিল, তার
গর্ভে হাসানের সন্তান। হাসান তাকে না জানিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে এটা সে মেনে নিতে পারেনি।
হাসানের নির্লজ্জ মিথ্যার মুখোমুখি দাড়ানোর আগে তাকে দাড়াতে হয়েছিল তার বাবা পূলক সেনের।
পূলক সেন, কামাল নামক এক পেশাদার খুনিকে লাগিয়েছিল হাসানের পেছনে। প্ল্যান ছিল হাসানকে
তুলে নিয়ে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া। তারপর জয়া কে সহ সব গুটিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়া।
জয়ার এবরশন করিয়ে জয়ার জীবন নতুন করে শুরু করার। জয়া এক রাতে বাবার সাথে কথা কাটাকাটি
হয়েছিল হাসান কে নিয়ে। বাবা কোন কালেই হাসান কে পছন্দ করেনি। তার উপর ধর্মীয় ভিন্নতা
তো আছে। বাবা জানতে চেয়েছিলেন হাসানের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে কিনা, স্পষ্টবাদী
জয়ার এক মুহুর্ত ও দেরি হয়নাই উত্তর দিতে, সাবলীল ভাবেই জানিয়েছিল হাসান কে সে ভালবাসে,
তাকেই বিয়ে করবে। পূলক সেন যুক্তি দেখিয়েছিল হাজার টা, কারন সে জানে তার মেয়েকে বস
করতে হলে কেবল যুক্তিতেই হাড় মানাতে হবে। কোন যুক্তিতে না পেরে আন্দাজে ঢিল ছুড়েছিলেন
পূলক সেন- ‘গিয়ে দ্যখো হাসান মায়ের কথায় অবশ্যই কোন মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করবে’। শিরদাড়া
বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিল জয়ার। জয়ার সুতীব্র বয় আর ঘৃণা জেগে উঠেছিল হাসানের প্রতি
সে রাতে। কি ভেবে বাবাকে জড়ীয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল সে, সেই ছোট্ট বেলার মত।
পূলক সেন স্তম্ভিত হয়ে যান। ভীষন শক্ত তার মেয়ে জয়া। ছোট বেলায় পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেলেও
কাদতো না। জয়া শুধু কাদতো ভয়ে, ব্যাথা পেয়ে খুব কমই কেদেছে জয়া। পূলক সেন বুঝতে পারেন
মেয়ের মনের কোন অজানা ভয়ে তিনি হাত দিয়ে ফেলেছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে লাগলেন মেয়ের। জয়াও
আজ যেন সেই ছোট্ট বেলার জয়া হয়ে বাবার কাধে মুখ ঘষতে ঘষতে হাসানের রিনিকে বিয়ে করার
ব্যাপার টা জানায়। সারাজীবন নিপাট ভদ্রলোক হয়ে থাকা পূলক সেন আজ হাসানের উপর তীব্র
ক্ষোভ আর রাগ অনুভব করছেন। ইচ্ছে করছে হাসান কে কুচি কুচি করে কেটে ফেলতে। মেয়ের চোখের
জলে নিজের চোখে জল আর ধরে রাখতে পারলেন না পূলক সেন। মেয়েকে নরম গলায় বললেন- ‘মা,
আমি প্রমিজ করছি হাসানকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিব, ওকে ওর কর্মফল ভোগ করতেই হবে’। মুখ
তুলে জয়া বলল- ‘বাবা কি করবে ওকে তুমি! আমি ওকে ছাড়া বাচব না’
‘এটা ভুল কথা
মা, কারোর জন্য কেউ মরে যায় না, হাসান তোমার বিশ্বাস নিয়ে খেলেছে, আমার মনে হয় না একে
তোমার আর কোনভাবে সুযোগ দেয়া উচিৎ’
‘বাবা, আমি হাসানের
সাথে কথা বলে সব জানতে চাই’
‘আমি খবর নিব
সব, তুমি ভেবো না। হাসান ছাড়াও তুমি ভাল থাকবে’
বাবার এই কথায়
ঘাবড়ে গিয়েছিল জয়া। ভীত দৃষ্টিতে জানতে চেয়েছিল বাবার প্ল্যান। উত্তরে কেবল মাত্র হেসেছিলেন
পূলক সেন। নিজের রুমে গিয়েও আবার বাবার কাছে ফিরে আসছিল জয়া, তখন ই শুনতে পেরেছিল বাবার
প্ল্যান। জয়া জানে তার কোন অনুরোধ ই এখন আর বাবা শুনবেন না, কিন্তু সে তো চাইলেই পারে
হাসান কে সতর্ক করতে। জয়া ভাবে সে নিজেই ফেইস করবে হাসান কে পূলক সেনের আগেই।
রিনি হাসানের
ধাঁধাঁ প্রিয়তার কথা খুব ভাল্ভাবেই জানে। তাই সে ভাবতে থাকে হাসান ভাই হলে কি নাম্বারিং
লক দিতো। হাসানের ফোনের লাস্ট ৪ ডিজিট হতে পারে কি? উহু না কাজ করলো না, সে জয়ার এমনকি
হাসানের মায়ের ফোনের লাস্ট ৪ ডিজিট দিয়েও ট্রাই করলো। হলো না। জন্ম তারিখ কি? অবশ্যই
জন্ম তারিখ দিবে না, তাহলে এমন কোন দিন যা সে কখনো ভুলবে না, সে কি তাহলে বাবার মৃত্যুর
দিন। হাসানের বাবার মৃত্যু হয়েছে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। তাহল কি ৪২১৬। ট্রাই করে
দেখলো রিনি। হ্যাঁ খুলে গেলো দরজার পাল্লা। ভারী একটা কিছু গড়ীয়ে পড়লো। অজান্তেই চিৎকার
করে উঠলো রিনি.

Comments
Post a Comment