অসলো থেকে বার্গেন (দুনিয়ার অন্যতম সেরা ট্রেন যাত্রা)
২৫ আগস্ট সকালে Bergen ছেড়ে বিমানে চড়লাম Oslo-র উদ্দেশ্যে। প্লেনের জানালার বাইরে সাদা তুলোর মতো মেঘ ভেসে যাচ্ছিল। অথচ আমার ভেতরের আকাশ তখনো অন্ধকার। কিছুদিন আগেই বাবাকে হারিয়েছি। সেই শোক, প্রচন্ড শরীরের অসুস্থতা আর মানসিক অস্থিরতা আমাকে ভীষণ ক্লান্ত করে তুলেছিল।
তবুও যাত্রা থেমে থাকে না। এবার বের হয়েছি কিছু কাজ সারতে আর কিছু রিফ্রেশমেন্টের জন্য।
Oslo Gardermoen Airport-এ নেমে উঠলাম Flytoget Express Train-এ। ট্রেনটা যেন ছুটে চলা তীর, মাত্র ২০ মিনিটেই আমাকে নামিয়ে দিল Oslo Central Station-এ।
Oslo S শুধু একটা রেলস্টেশন নয়, পুরো শহরের প্রাণকেন্দ্র। ভেতরে ঢুকেই মনে হলো যেন আমি কোনো জীবন্ত ক্যানভাসে ঢুকে পড়েছি—ডিজিটাল বোর্ডে ট্রেনের নাম সারি সারি ঝলমল করছে, মানুষ দৌড়াচ্ছে এদিক-ওদিক, কফিশপে লম্বা লাইন, দোকানের কোলাহল। একটা কথা বলতেই হবে অসলো স্টেশান আমার দেখা সবচেয়ে বিলাসবহুল আর আধুনিক স্টেশান।
স্টেশন থেকে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম Opera House-এর সামনে। ভবনটা দেখতে যেন বিশাল বরফের টুকরো পানির ওপর ভাসছে। এর ছাদে উঠে দাঁড়ালে পুরো শহর আর Oslo Fjord চোখের সামনে ধরা দেয়।
আমি প্রায় দুই ঘণ্টা সেখানে কাটালাম। চারপাশে মানুষের ভিড়, ছবি তোলা, হাসি, আড্ডা। অথচ আমার ভেতরে তখনো বাবাকে হারানোর ফাঁকা জায়গা। রোদ ঝলমল করছিল পানির ওপর, আর আমি তাকিয়ে ছিলাম শূন্যতায়। প্রকৃতি একদিকে উজ্জ্বল, আর আমি ভেতরে ভেঙে যাচ্ছিলাম।
ক্ষুধা তখন চাড়া দিয়েছে। গেলাম Pajab Indian Tandoori-তে। ভেতরে ঢুকতেই ঝাল-মশলার গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। গরম ভাত, চিকেন কারি আর নরম নান। এক কামড় খেতেই মনে হলো আমি সামান্য সময়ের জন্য হলেও ঘরে ফিরে এসেছি। খাওয়ার সময়টা আমাকে কিছুটা শান্তি।
দুপুর শেষে ছোট্ট ট্রেনযাত্রায় পৌঁছালাম Lillestrøm। Oslo থেকে মাত্র ১২ মিনিটের পথ, কিন্তু যেন অন্য জগৎ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছোট্ট শহর, শান্ত পরিবেশ।
এখানেই জুয়েলের সারপ্রাইজ—Scandic Lillestrøm Hotel। তাঁর যত্নশীল আয়োজন আমার বুকের ভেতর ছুঁয়ে গেল। সন্ধ্যায় বের হলাম Nitelva নদীর ধারে হাঁটতে। ছোট্ট নদীটা শহর কেটে গেছে, তার ধারে হাঁটার পথ। সূর্য তখন ডুবে যাচ্ছিল। পানির ওপর সোনালি আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল। বাতাসে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি।আচ্ছা আব্বু দেখলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন।
পরদিন দুপুরে কিছু কাজ সেরে গেলাম Nobel Peace Center-এ। ভেতরে শান্তি আর মানবতার গল্প সাজানো। নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাস যেন প্রতিটি দেয়ালে খোদাই করা। আব্বুর কথা মনে হচ্ছিল—তিনি সবসময় বলতে নরওয়ে নোবেল peace প্রাইজের দেশ।মনে হলো তাঁর স্বপ্নের ছায়াতেই দাঁড়িয়ে আছি।
তারপর গেলাম Aker Brygge-তে। আগে ছিল শিপইয়ার্ড, এখন রঙিন রেস্টুরেন্ট আর ক্যাফেতে ভরা প্রাণবন্ত ওয়াটারফ্রন্ট। গ্রীষ্মের রোদে মানুষ ফিয়র্ডপাড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ আইসক্রিম খাচ্ছে, কেউ স্রেফ সূর্যের উষ্ণতা উপভোগ করছে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম পানির ধারে। ঢেউয়ের শব্দ শুনে মনে হলো—জীবন যতই ভাঙা হোক, চলতে থাকে।
লাঞ্চের জন্য ঢুঁ মারলাম Azadi Restaurant-এ। পরিচিত মশলার ঝাঁঝ, নান আর নরম চিকেনের স্বাদ আমাকে মুহূর্তের জন্য হলেও দূরের ঘরে ফিরিয়ে নিল। শোক হয়তো যায় না, কিন্তু খাবার মানুষকে অদ্ভুত এক সান্ত্বনা দেয়।
Oslo থেকে Bergen:
২৭ আগস্ট সকাল ১১টা ৪২। Oslo S-এর প্ল্যাটফর্ম ১২-তে দাঁড়িয়ে ট্রেনে উঠলাম। বুকটা তখনো ভারী, কিন্তু ভেতরে একটা প্রত্যাশা ছিল—পাহাড় সবসময়ই আমার প্রিয়। পাহাড়ের কোলে হয়তো আবার শান্তি পাব।
প্রথমে Oslo শহর মিলিয়ে গেল। লাল রঙের কাঠের ঘর, আঙিনায় খেলা করছে বাচ্চারা, ছোট্ট বাগান—সবই যেন এক পোস্টকার্ডের ছবি। তারপর এলো নদী, সেতু, আর ঝকঝকে পানি।
ঘন পাইন বন, নীল হ্রদ, আকাশের প্রতিফলন—সবকিছু মিলিয়ে দৃশ্যটা আরও গভীর হয়ে উঠল। কোথাও নদীর ধারে মাছ ধরছে কেউ, কোথাও আবার ছোট্ট নৌকা ভেসে আছে।
ট্রেন তখন উঠছে পাহাড়ি পথে। একের পর এক টানেল। অন্ধকার কেটে বেরোলেই সামনে নতুন ছবি। কোথাও সবুজ উপত্যকা, কোথাও বরফে ঢাকা পাহাড়।
এবার এল যাত্রার সবচেয়ে অবিশ্বাস্য অংশ—Hardangervidda। ১২০০ মিটার উচ্চতায় বিস্তীর্ণ সমভূমি। চারপাশে বরফ, জমাট হ্রদ, তুষার। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি।
Finse স্টেশনে ট্রেন থামল। নরওয়ের সবচেয়ে উঁচু স্টেশন, ১,২২২ মিটার ওপরে। চারপাশে কেবল বরফ আর হাওয়া। মনে হচ্ছিল আমি কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমার ভেতরে আছি। এত অপার্থিব সৌন্দর্য! মনে হচ্ছিল স্রষ্টা কত মেহেরবান আমাকে এই সৌন্দর্য দেখার তৌফিক দিয়েছেন।
Finse পেরোতেই দৃশ্য পাল্টে গেল। বরফ গলছে, পানি ঝর্ণা হয়ে নামছে। উপত্যকায় আবার সবুজ ফিরে এসেছে। ছোট্ট গ্রাম, কাঠের ঘর, নদীর স্রোত—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমি আবার জীবনের স্রোতে ফিরে যাচ্ছি।
Voss-এর পথে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার গর্জন শুনলাম। শহরটা পাহাড় আর হ্রদের কোলে বসে আছে। দূরে প্যারাগ্লাইডাররা আকাশে উড়ছে। কিন্তু আমার কাছে সেই ঝর্ণার শব্দই ছিল জীবনের নতুন গান।
শেষের পথে এলো ফিয়র্ড। পানির ধারে রঙিন গ্রাম, সবুজ পাহাড়, ছোট্ট নৌকা। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আলো পানির ওপর প্রতিফলিত হচ্ছিল।
অবশেষে পৌঁছালাম Bergen। Bryggen-এর রঙিন কাঠের ঘরবাড়ি, সমুদ্রের গন্ধ, পাহাড়ের ছায়া—সবকিছু মিলিয়ে শহরটা আমাকে যেন আলিঙ্গন করল। মনে হলো, শোক থাকলেও জীবন আবারও আলো দেখায়।
Comments
Post a Comment