প্রথম প্রেম শেষ ভালবাসা
বত্রিশ বছরে এসে জীবনে কোন মেয়ের প্রেমে পড়লাম। প্রথম প্রেম। খুব অদ্ভূত শোনালেও কথাটা খুব সত্যি। আমি অয়ন মাহমুদ, পেশায় ব্যাবসায়ী । গড়পড়তা বাঙ্গালী ছেলেদের তুলনায় আমি লম্বা এবং সুদর্শন। ব্যাবসায়ী হওয়াটা আমার চয়েস ছিল না, হতেই হতো কেননা ব্যাবসায়ী বাবার একমাত্র সন্তান আমি। আমার প্রিয় বিষয় কোয়ান্টাম ফিজিক্স। আমার বিয়ে বাবার ইচ্ছেতেই, তার নির্ধারিত পাত্রীর সাথে। স্ত্রীর সাথে আমার সম্পর্ক?? ‘ভাল’। সুখী দাম্পত্য জীবন আমাদের। আমার স্ত্রী আমাকে ভালবাসেন বলেই বাবার ধারনা ছিল। আমার?? সে গল্পে আসছি ...............
আমার জন্মের সময় মারা যান আমার মা বলে আমি শুনেছি , আমার বিরাট ব্যাবসায়ী বাবা আর কখনোই বিয়ে করেন নি। বলা যায়, বিয়ের সময় পান নাই। তার গার্মেন্টস এর ব্যাবসা, ভীষন ব্যাস্ততা। তার ফাঁকের সবটা সময় আমার জন্য নির্ধারিত। এমন ও হয়েছে, বাবার ফিরতে লেইট নাইট হবে বলে স্কুল শেষে বাবা আমাকে সোজা অফিসে নিয়ে গেছেন, বাবার অফিসে আমার একটা পারসোনাল রুম ছিল, যেটা আমার জন্য ছিল স্টাডি কাম বেডরুম। বাবার ব্যাস্ততার ফাঁকে তিনি আমার জন্য সর্বোচ্চ কেয়ারের ব্যাবস্থা করেছিলেন। আমার জন্য একজন কেয়ারটেকার রাখা ছিল, যাকে আমি ডাকতাম হাসেম মামা। বাবা আর হাসেম মামাকে নিয়েই আমার শৈশব। স্কুলে আনা নেয়া আমার খাওয়ানো সবই করতো হাসেম মামা। হাসেম মামার ফ্যামিলী আমাদের বিল্ডিং এর নিচ তলাতেই থাকতো, উনার একটা ছেলে ছিল আমার সমবয়সী। বাবা কোন কারনে চাইতেন না, আমি হাসেম মামার ছেলে সাব্বিরের সাথে খেলি। আমার খুব ইচ্ছা করতো সাব্বিরের সাথে খেলি, আমাকে ছাদে দেখলে সাব্বিরের মা কেন জানি সাব্বিরকে ডেকে নিয়ে যেত, সাব্বির যেতে না চাইলে এমনকি জোর করে মেরেও নিয়ে যেত। আমি হাসেম মামাকে এই ব্যপারে জিজ্ঞেস করলেও সে সবসময় চুপ থাকতো। আমি হাসেম মামাকে, মামা ডাকলেও উনি বাবার নির্দেশে আমাকে ছোট স্যার ই ডাকতেন। হাসেম মামা ফ্যামিলি সহ আমাদের বিল্ডিং এ থাকলেও রাতে তিনি আমার পাশের রুমেই ঘুমাতেন, আমি কোন রাতেই তাকে বাসায় যেতে দেখিনি। হাসেম মামার স্ত্রী কখনোই আমার সাথে কথা বলেন নি। বাবার নির্দেশেই উনি কথা বলতেন না বলে আমার ধারনা।
বাবা চাইতেন আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ হই, কিন্তু উনি নিজের তৈরি দুনিয়াতে আমাকে উনার ছাঁচে বড় করছিলেন। এমনকি আমার স্কুলের বন্ধু বান্ধবদের ব্যাপারেও উনার খুব খুঁতখুঁতানি ছিল। আমার সাথে কারো ফ্রেন্ডশিপ হয়েছে বা আমি কয়েকদিন নির্দিষ্ট কারো সাথে বসেছি বা কথা বলেছি শুনলে উনি সেই ছেলে বা মেয়ের ফ্যামিলির ব্যাপারে খোঁজ নিতেন, তাদের মোটামুটি ইন্টারভিউ করে নির্ধারন করতেন আমি তাদের সাথে মিশবো কিনা। বাবার মধ্যবিত্তদের প্রতি অপরিসীম ক্ষোভ ছিল, যার কোন কারন আমি বুঝতাম না। যেহেতু আমি বেশ দামী একটা স্কুলে পড়তাম, খুব কমই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে মেয়ে আমাদের স্কুলে পড়তে আসতো, তবুও বাবার নিজস্ব পরীক্ষা পদ্ধতিতে পাশ করেই আমার বন্ধু হতে হতো।
ও আরেকটি ব্যাপার বলা হয় নি, আমার মায়ের পরিবারের কারো সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বাবা বলতেন, তাদেরকে তোমার দরকার নেই। আমি অনেক জোরাজুরি করে হাসেম মামার কাছ থেকে জেনেছি আমার নানা নানী আর এক খালা আছেন। কিন্তু তারা কোথায় আছে তা তিনি জানেন না, যদিও আমার ধারনা তিনি তা জানেন। আমার মায়ের এক মাত্র ছবি আমাদের বাসার দেয়ালে টাঙ্গানো আছে, যেটা বাবা নিজেই পোট্রেট করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। আমার বাবা চারুকলার ছাত্র ছিলেন, খুব সুন্দর ছবি আকতেন বাবা। আমি আসলে আমার বাবা- মায়ের ব্যাপারে খুব একটা কিছু জানিনা। তারপর ও কল্পনা করে নিতে ইচ্ছা করে, আমার বাবা- মায়ে খুব প্রেম ছিল, মায়ের স্মৃতি ভুলতে পারেনি বলেই বাবা আর বিয়ে করেন নি। আমাকে খুব বেশি ভালবাসতেন আমার স্বল্পভাষী বাবা। আমি আর বাবা বছরে একবার দেশের বাইরে ট্যুরে যেতাম। ঐ সাতদিন বাবা খুব বদলে যেতেন, রংচঙ্গা শার্ট পড়ে বাবা আর আমি খুব ঘুরতাম ছেলে মানুষের মত, অনেক অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে আমরা দুইজন ফিরতাম। এসেই আমার বাবা আবার গম্ভীর হয়ে যেতেন, তখন বড্ড এক ঘেয়ে লাগতো আমার, মনে হতো এই বাবাকে আমি চিনিনা। আমি সারা বছর অপেক্ষা করতাম ঐ সাতদিনের জন্য। আমার খুব ইচ্ছা ছিল এ লেভেল শেষ করে দেশের বাইরে পড়তে যাবার। আমার বেশিরভাগ বন্ধুরাও বিভিন্ন দেশে পড়তে চলে গেলো। বাবা হয়ত চাননি আমি তার কাছ ছাড়া হই, আর তাই, আমি বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশবিদ্যালয়ে। আমার বাবার সব ডিসিশানই ছিল অদ্ভুত, কৈশোর পর্যন্ত আমাকে নিয়ন্ত্রিত জীবনের মাঝে রেখে হঠাৎ ই আমাকে ভর্তি করে দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে এসে নানান ধরনের সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা ছেলে মেয়েদের মধ্যে আমি কেমন যেন নিজেকে এলিয়েন বোধ করতে লাগলাম। ফার্স্ট ইয়ারে ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা মনে হলেও আমার খুব অসহায় লাগত। কেন যেন ফার্স্ট ইয়ার শেষেও আমার কোন বন্ধু হলো না, কিভাবে যেন ফার্স্ট ইয়ার পরীক্ষা শেষে আমি ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে গেলাম। যেদিন রেজাল্ট পাব্লিশ হলো, পুরো ক্লাসের এটেনশান একবারে আমার দিকে। আমি যে ক্লাসে ছিলাম সেই প্রথম যেন সবাই জানলো। আমার খুব লজ্জা লাগতে লাগলো। ক্লাসের টিচার রাও আমাকে ডেকে নিয়ে আলাদা করে কথা বললেন। এরপর আস্তে আস্তে ক্লাসের দুই একজন আমার সাথে কথা বলতে শুরু করলো। আমি বাবার ভয়েই হয়ত কিছুটা প্রাণ খুলে মিশতে পারতাম না। কিন্তু এইবার বাবা আর হাসেম মামা কিংবা অন্য কারো মাধ্যমে আমার বন্ধুদের উপর গোয়েন্দা গিরি করতে পাঠালেন না। কেন পাঠালেন না, সেই রহস্য উদ্ধার করতে আমার কেটে গেলো আমার আরো অনেকগুলো বছর।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জীবনে সত্যিকারের এক বন্ধু হলো আসিফ। আসিফ গ্রাম থেকে আসা এক কৃষকের সন্তান। সে নাকি এমন গ্রাম থেকে এসেছে যেখানে সে-ই প্রথম কলেজ গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রায় দুপুরেই দেখতাম আসিফ ঝাল মুড়ী বা ভেল পুরি খাচ্ছে এবং সেটা লাঞ্চ হিসাবে। আজীবন বিত্ত বৈভবের মধ্যে বড় হওয়া আমার কাছে এটা রীতিমতো একটা বড় আবিষ্কার যে আসিফের কাছে আসলে প্রোপারলি লাঞ্চ করার মতো টাকা নাই। ক্যাম্পাসে তখন ১৬ কিংবা ১৮ টাকায় বেশ ভাল লাঞ্চ করা যায়। যদিও প্রায় দিন ই হাসেম মামা আমার জন্য লাঞ্চ দেয়ার চেষ্টা করে, তবুও আমার কেন জানি ডাক্সুর ১৬ টাকার খিচুড়ি বা টি এস স্যার ১৮ টাকা ভাত, মুরগি বা আলু ভর্তার প্যাকেজ লাঞ্চ করতে খুব ভাল লাগতো। আসিফ কে আমি প্রায়ই টানাটানি করতাম লাঞ্চ করানোর জন্য, প্রবল আত্মসম্মান বোধ থাকায় বেশিরভাগ দিন ই সে আমার সাথে লাঞ্চ করতে রাজি হত না। আসিফ খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতো। সেকেন্ডে ইয়ারে উঠেও হলে ভাল সিট ম্যানেজ করতে পারলো না আসিফ। অনেক টা বাধ্য হয়েই সে রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে সিটে উঠল। আসিফ ছাড়াও আমার আরো কিছু বন্ধু হয়েছিল, কিন্তু আসিফ আমার সব চেয়ে প্রিয়। এত সরল মানুষ কিভাবে হয় আমি খুব অবাক হতাম। সেবার বাবা আমাকে নিয়ে ইউরোপ ট্যুরে যাবে। আমি আসিফ কে বলতেই সে এত অবাক হলো, সে আমাকে বললো দোস্ত ইউরোপ ট্যুর দিতে কত টাকা লাগে রে? আমি তাকে আন্দাজে কমিয়ে কমিয়ে একটা টাকার এমাউন্টের কথা বললাম। আসিফ সবিস্ময়ে মুখ ফুটে বলেই ফেলল- এত টাকা!! এত টাকা থাকলে আমার বোনের বিয়ে হয়ে যেত!!আমি আরো অনেক প্রশ্ন করলাম, কিছুতেই সে এর বেশি আর কথা বাড়ালো না। আমি আসিফের অনেক গল্প ই হাসেম মামাকে বলতাম। হাসিম মামা আমাকে অনেকবার বলেছেন বাবাকে আসিফের কথা বলতে, যেন বাবা তাকে সাহায্য করতে পারে। আমি আসিফকে চিনতাম খুব ভাল আর তাই জানতাম কিছুতেই এবং কোনভাবে ই সে আমার কিংবা কারোর ই সাহায্য নিবেনা। আসিফ দুইটা টিউশানি করতো, টিউশানির টাকায় সে নিজে চলত এবং বাবাকে পাঠাতো। থার্ড ইয়ার পর্যন্ত আমি আসিফে দুইটার বেশি শার্ট দেখিনি, ও হ্যা তার একটা পাঞ্জাবী ও ছিল, সেটা আমি তাকে কে ঈদে গিফট করেছিলাম, কোন ভাল জায়গায় গেলে সে ঐ পাঞ্জাবী পড়েই যেত। ঐ একটি পাঞ্জাবী ই আমি তাকে গিফট করতে পেরেছিলাম। কারন যে ঈদে আমি তার জন্য পাঞ্জাবী কিনেছিলা, সেই ঈদেই সে তার টিইশানির টাকা দিকে আমার জন্য ক্যাটস আই থেকে টি-শার্ট কিনেছিল। আসলে তাকে আমি কিছুই গিফট করতে পারতাম না, কারন তীব্র আত্মসম্মান বোধে সে অবশ্যই আমাকে আমার পছন্দের জিনিস গিফট করতে চাইতো। এমন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন হাসি-খুশি আসিফ তার এক ছাত্রীর প্রেমে পড়ে গেলো ভয়াবহ ভাবে। ক্লাস নাইনে পড়ুয়া আসিফের ছাত্রী আদ্রিতা ছিল পুলিশের ডি আই জির মেয়ে। টিউশানি টা পেয়েছিল আসিফ তার স্কুলের হেড মাস্টারের রেফারেন্সে। তুখোড় মেধাবী আসিফ কে ডি আই জি সাহেব যতটা না মেয়ের প্রাইভেট টিউটর হিসাবে সম্মান করতো তার চেয়ে অনেক বেশি করুণা করতো দারিদ্রতার জন্য। আসিফ বুঝতো না তা না, কিন্তু তার হেড মাস্টারের রেফারেন্সে পাওয়া বলে কিছুটা সহ্য করে যাচ্ছিল। আসিফ আদ্রিতার প্রেমে পড়লেও আদ্রিতার রেস্পন্সটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। আসিফ রোকেয়া হলের সামনে থেকে এক ঝুড়ি কাচের চুড়ি গিফট করে প্রপোজ করেছিল আদ্রিজাকে। আদ্রিজা হ্যা কিংবা না কোনটাই বলেনি। তবে মাঝে মাঝে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পাসে আসতো, আসিফ তাকেই প্রেম বলে ভাবতে শুরু করলো। আমি কোন প্রশ্ন করলেই সে আমাকে এবং নিজেকে বোঝাতো আদ্রিজার বয়স অল্প তাই হয়তো ঐভাবে প্রকাশ করতে পারেনা। লেখার হাত খুব ভাল ছিল আসিফের, আদ্রিজাকে দীর্ঘ সব চিঠি লিখতো সে, যদিও আমি কখনই আদ্রিতাকে কোন চিঠি লিখতে দেখিনাই। আমাদের ফোর্থ ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার আগে আমার পড়াশোনার ব্যাস্ততা বেড়ে গেলো, আমার রিডিং পার্টনার আসিফ তখন চারটা টিউশানি আর আদ্রিতাকে নিয়ে ডুবে আছে, ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে সে বি সি এসের প্রিপারেশান নিচ্ছিল। আর আমার সাথে বাড়ছিল দূরত্ব। আমাদের ক্লাসের আর জুনিয়র অনেক মেয়েরই ক্রাশ ছিলাম আমি, সে আমি বুঝতাম কিন্তু আমি যে আমার নিজেকে বড় বেশি ভাল জানতাম আর তাই মেয়েদের এড়িয়ে চলাটাই আমার জন্য সব চেয়ে ভাল ছিল।
পরীক্ষার বাকি আর অল্প কয়দিন, আমি পাগলের মত ১৭/১৮ ঘন্টা পড়ছি, আসিফের সাথে দেখা হয় না অনেকদিন। ওর যেহেতু মোবাইল নেই আমি কল করেও খোঁজ খবর নিতে পারিনি, ওর রুম মেট আমাদের ক্লাস মেট জাহিদকে জিজ্ঞেস করে জানলাম আসিফ অনেক রাত্রে হলে ফিরে আর কখন যে বেরিয়ে যায় ঠিক নেই। আমি ভাবলাম পরীক্ষার হলে তো দেখা হবেই। কিন্তু পরীক্ষার আর দুইদিন আগে আসিফ তার হলের রুমে সুইসাইড করে। আমার জীবনের জঘন্যতম একটা দিন সেটা যখন আসিফের লাশ দেখতে আমি হলে যাই আর ওর সেই ভয়ংকর নীল হয়ে যাওয়া চেহারাটা আমার আজো দুঃস্বপ্নের মাঝে ভেসে উঠে। আসিফ তার সুইসাইড নোটে লিখেছিল- আদ্রিতা আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম। আসিফের চিঠি আদ্রিতার হাতে পড়লে আদ্রিতার বাবা ডি আই জি মনসুর সাহেব আদ্রিতার কাছে সব জানতে চান, আদ্রিতা প্রেম ভালবাসা সব অস্বীকার তো করেই, আরো মিথ্যে অভিযোগ করে আসিফ তাকে মোলেস্ট করার চেষ্টাও করতো নিয়মিত। মনসুর সাহেব আসিফ কে ডেকে নিয়ে ভদ্র ভয়াবহ অপমান করে, কেস করার কথা বলে এমনকি তার হেড মাস্টারকে সব জানাবেন বলেন। লজ্জায় অপমানে ঘৃণায় আসিফ সুইসাইড করল আমার প্রিয় বন্ধু আসিফ আর আমি?? ট্রমাতে পড়ে সে বছর আর পরীক্ষাই দিতে পারলাম না। বাবা আমাকে অনেক সাইক্রিয়াটিস্ট দেখালেন, দেশের বাইরে নিয়ে গেলেন তবুও আমি আগের মত আর নরমাল হতে পারলাম না। অনেক কষ্টে কোনরকমে আমি অনার্স পাশ করলাম। বাবা আর সহ্য করতে পারলেন না, আমাকে পাঠিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডে। কিন্তু মাত্র মাস ছয়েকের মাঝে, আমাকে দূরে পাঠিয়েই কিনা জানিনা হার্ট এটাক করলেন, আমাদের ব্যাবসা আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যেতে থাকলো। মাস্টার্স শেষ না করেই দেশে ফিরলাম আমি।
…
দেশে ফিরলাম আমি ৬ মাস ১৯ দিন পর। গত ছয়মাস আমার জীবন ছিল নিস্তরঙ্গ বন্ধুহীন। আমার স্কুল জীবনের কিছু বন্ধুদের খুঁজে বের করার কথা আমি অনেকবার ভেবেছি। কিন্তু এক আজীবন বয়ে বেড়ানো ভয় আর সংকোচ আমাকে সে পথে যেতে দিল না। এর মাঝে মার্গারেট নামে আমার এক শিক্ষিকার সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়, মার্গারেট কে দেখলেই কেন যেন আমার মনে হত আমার মা হয়ত এমন ই ছিলেন। মার্গারেটের বয়স ৫০ এর আশে পাশে। নীল চোখ আর ব্লন্ড চুলের মার্গারেটের হাসিটা ছিল আমার মায়ের পোট্রেটের মত, আমি কী আমার মায়ের জন্য বুভুক্ষ ছিলাম। আমার বিষয় ছিল ‘ ম্যাগ্নেটিক রিসোনেন্স এন্ড হাইপার পোলারাইজেশান’ আর মার্গারেট ছিলেন আমাদের একডেমিক কাউন্সেলর, তার বিষয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজী, আমি কারনে অকারনে তার চেম্বারে যেতাম, একটা সময় সে ও বুঝে ফেলল আমি নিছক গল্প করতেই তার কাছে যাই।
মার্গারেট আমার শৈশব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতো, একদিন সে আমাকে বলে- ‘আচ্ছা, তোমার মা কিভাবে মারা গেলেন?’ আমি বাবার বুলি যেন আওড়ে গেলাম আমার মুখ দিয়ে- আমার জন্মের পর পর মায়ের ইন্টারনাল বিল্ডিং হতে থাকে, মায়ের রক্তের গ্রুপ খুব রেয়ার ছিল, এনাফ পরিমান রক্ত ও দেয়া যায় নাই, আরো কিছু জটিলতায় মারা যান মা’ মার্গারেট অনেক্ষণ চুপ থেকে বললেন- আচ্ছা অয়ন, তুমি তোমার মায়ের গ্রেভে গেছ কখনো? আমি বললাম না, বাবা চাইতেন না আমি মায়ের কবরে যাই, আমি হাসেম মামা কে অনেকবার বলেছি, উনি বরাবর ই এড়িয়ে গেছেন। মার্গারেট বলল- অয়ন এখন তো তুমি অনেক বড়ো হয়েছ, এবার দেশে গিয়ে তোমার মায়ের কবর খুঁজে বের করে কিছুক্ষণ পাশে বসো তো, আমার মনে হয় তুমি শান্তি পাবে। মার্গারেটের এই কথা শোনার পর, আমার তক্ষুনি ইচ্ছা করছিল, মায়ের কবর খুঁজে বের করে কিছুক্ষণ পাশে বসতে, নিজেকে এত ছোট মনে হচ্ছিল, আসিফ মারা যাবার পর আমি প্রায়ই তার কবরের পাশে বসে কেঁদেছি, আল্লাহর কাছে দোয়া ও করেছি, মায়ের কবর না খোজার জন্য কখনো চেষ্টা করলাম না কেন।
আমি যখন ছোট, বাবা বাসায় এক মৌলভী রেখেছিলেন কোরআন শিক্ষার জন্য, আমাকে ভীষন স্নেহ করতেন মৌলভী চাচা। আমার মা ছিল না বলে আমার জন্য তার প্রগাড় সমবেদনা ছিল, উনি আমাকে মহানবী (সঃ) এর জীবনী শোনাতেন, বলতেন বাবা আমাদের নবী(সঃ) এর ও তো মা ছিল না। তুমি মন খারাপ করো না, আমি উনাকে যতই বলতাম যে আমার মন খারাপ না, উনি ভাবতেন আমি মিথ্যা বলছি। উনি আমাকে অনেক দোয়া শেখাতেন মায়ের জন্য। আমাকে উনি বললেন আমি যেন মায়ের কবরের পাশে বসে ইয়াসীন সুরা নিয়মিত পড়ি। আমি বাবাকে এই কথা বলার পর বাবা গম্ভীর গলায় বলেছিলেন তুমি বাসায় বসেই পড়ো, তোমার মা হয়ত শান্তি পাবেন। আমি মায়ের কবর দেখার জন্য কিছুদিন বাবার সাথে ঘ্যান ঘ্যান করলাম, বাব শুনেও না শোনার ভাল করে রইলেন। এর কিছুদিন পর ই বাবা আর মৌলভী চাচাকে বাসায় আসতে না করে দেন।
মার্গারেট আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, পঁচিশ বছর বয়সেও আমি কেন সিঙ্গেল! আমি হেসে বললাম, মেয়েরা আমাকে পছন্দ করে না হয়তো। মার্গারেট আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, আসলেই কি তাই, নাকি তোমার ই মেয়েদের কে পছন্দ করার সাহস নাই। আমি কিছুটা হাসার ভান করে বললাম, নো ওয়ে মার্গারেট, আমার বাবার পছন্দের মেয়েকেই আমার হয়ত বেছে নিতে হবে। মার্গারেট বলল, আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করে তোমার মত হ্যান্ডসামকে কে পায়, আমিও মার্গারেট কে বললাম- আমি তোমাকে আগেই ছবি পাঠাবো। সেদিন ই বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে, খুব দ্রুত সব গুছিয়ে আমাকে চলে আসতে হয়।
দেশে ফিরলাম আমি, আমাকে হতবাক করে দিয়ে আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসলো সাব্বির। সাব্বির আর আমি একই বিল্ডিং এ বড় হয়েছি, বলা যায় একই খাবার খেয়ে বড় হয়েছি, এমনকি অনেকেই বলেন আমরা দেখতেও নাকি অনেক টা এক রকম, সেই সাব্বিরের সাথে আমার কোন রকম মানসিক যোগাযোগ কখনো গড়ে উঠেনি, অথচ ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হওইয়াটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ছিল। আমার চেয়ে মাস দুইয়েকের বড় সাব্বির, আমার চেয়ে লম্বায় ইঞ্চি খানেক ছোটই হবে। অত্যন্ত সুপুরুষ সে, আমার সৌন্দর্যের কমনীয়তাটা তার মাঝে নাই একদম, গ্রীক যুবকদের মত কিছুটতা তোবড়ানো গাল পেয়েছে সে মায়ের কাছ থেকে, আর হাল ফ্যাশানের খোঁচাখোঁচা দাড়িতে তাকে অপূর্ব লাগছিল, সে আমাকে কখনোই কিছু বলে সম্মোধন করেনি। ছোটবেলায় অনেকবার আমাকে ভাইয়া ডাকার ট্রাই করে বেদম মার খেয়েছে সে হাসেম মামার কাছে। হাসেম মামার মতো মাঝারি গড়নের কিছুই সে পায় নি, বরং তার মায়ের চোখ ঝলসানো রঙ সে পেয়েছে। সাব্বিরকে যথেষ্ট স্নেহ করতো আমার বাবা, আমার বাবার নাক উচু স্বভাব সত্ত্বেও সাব্বিরকে সে ভাল স্কুল কলেজেও পড়িয়েছে। সাব্বিরের রেজাল্ট যথেষ্ট ভাল থাকার পরেও কোন এক বিচিত্র কারনে তার লেখা পড়া আর বেশিদূর আগায় নি, শুনেছি কোন এক কলেজ থেকে সে পাস কোর্সে বি এ পাস করেছে।
সাব্বিরকে আমার সাথে মিশতে না দিলেও সাব্বির আমার বাবাকে ডাকতো বড় বাবা, খুব ছোট বেলায় বাবা এই ডাকটা পছন্দ করতো না, রাগ হয়ে যেত স্যার বলতে ফোর্স করত। তারপর কিভাবে যেন অদৃশ্য বলে মেনে ও নিল বাবা। সাব্বির কে বাবা চাইলেই আমাদের অফিসে চাকরি দিতে পারতো কিন্তু তা না করে তাকে দোকান দিয়ে দিয়েছিল বলে আমি শুনেছি। আজ দেখছি বাবার পার্সোনাল গাড়ি ড্রাইভ করছে সাব্বির। বাবা কী তাহলে তাকে ড্রাইভার হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে?? আমি হাসিমুখে সাব্বিরের দিকে এগিয়ে গেলাম, সাব্বির এগিয়ে এসে আমার লাগেজ গাড়িতে তুলল। আমি ড্রাইভিং সিটের পাশে বসতে চাইলে সাব্বির বলল, স্যার আপনি পেছনে বসেন, বড় বাবা রাগ করবেন। আমি অনিচ্ছা স্বত্তেও পেছনের সিটে বসলাম। পুরো রাস্তায় আমি বাবার অনেক কথা খুঁটিয়ে জানতে চাইলাম সাব্বিরের কাছে, কিন্তু সাব্বির রোবটিক ভাবে হ্যাঁ, না জাতীয় উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল। বাসায় ফিরে দেখলাম বাবা ঘুমাচ্ছে, হাসেম মামা আমার রুম রেডি করে রেখেছিলেন, আমি শাওয়ার নিয়ে লাঞ্চ করলাম, বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমে দু’চোখ বুজে আসলো।
দীর্ঘ ১৮ ঘন্টার নির্ঘুম যাত্রায় ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।
আমার যখন ঘুম ভাংলো তখন বাংলাদেশ সময় রাত প্রায় দশ টা। আমি ফ্রেশ হয়ে বাবার ঘরে উঁকি দিলাম, দেখলাম বাবা রাতের খাবার খাচ্ছেন বিছানায় বসে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাব্বিরের মা রেহানা আন্টি। খুবই আনিউজুয়াল একটা দৃশ্য, আমার সদা কেতা দুরস্থ বাবা ডাইনিং ছাড়া কখনো খান না আজ এভাবে বেড রুমে খাচ্ছেন, তার অর্থ হয়ত বাবা খুব বেশি অসুস্থ। আর বড় হবার পর এই প্রথম আমাদের ফ্ল্যাটে রেহানা আন্টির উপস্থিতি আমার খুব ই খাপ ছাড়া লাগলো। কিন্তু বাবাকে দেখলাম খুব স্বাভাবিক। বাবা আমাকে দেখে হাসার চেষ্টা করলেন, চেহারা দেখেই তার অসুস্থতার তীব্রতা আন্দাজ করতে পারলাম, দ্রুত পায়ে কাছে গেলাম আমি। বাবা বললেন হাটতে পারিনা অয়ন আমি আর বলেই চোখ বেয়ে নেমে আসলো দু’ফোটা অশ্রু।আর আমার বুক ফেটে কান্না আসতে থাকলো বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলাম আমি সেই ছোট্ট বেলার মত। বাবা হাত ও ঠিক মতো নাড়তে পারছেন না। আমার মাথায় তবু হাত বুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। রেহানা আন্টী এগিয়ে এসে বাবার চোখ মুখ মুছে দিল। আর আমাকে এক প্রকার হতবাক করে দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আমার এই জীবনে প্রথম কোন নারী আমাকে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়েছেন। আমি খুবই আপ্লুত হয়ে পড়লাম। আমার আরো কান্না আসতে থাকলো, আমার বাবার জন্য, আমার না দেখা মায়ের জন্য।
মাঝ রাতে ঘুম ভেংগে গেল আমার, যে কাজ আশৈশব আমি করিনি, তা-ই করতে গেলাম। সেদিন রাতে আমি কী মনে করে যেন আমি বাবার সাথে ঘুমাতে আসলাম, পরে মনে হলো না আসলেই ভাল হতো, যে দৃশ্য আমি আমার দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করিনি, আমাকে আজ তা-ই দেখতে হলো, অবশ্য এই ধাক্কাটা আমার জন্য দরকার ছিল, আমার অতি সরল আচরনের পেছনেও যে জানার কোন ফাঁক আছে সেটা বোঝার জন্য হলেও মাঝরাতে বাবার রুমে আসাটা জরুরি ছিল।
…………………………………………………………………………………………………………
মানুষের জীবন আসলে খুবই অদ্ভুত আর প্রবাহমান। বাবার রুমে মাঝরাতে আমি যখন ঢুকলাম, তখন প্রায় রাত তিনটা, জেট ল্যাগের কারনে আমার ঘুম আসছিল না। ভেজানো দরজায় আমি কোন প্রকার শব্দ না করেই প্রবেশ করার চেষ্টা করতে গিয়ে দরজার পাশে রাখা সাইড টেবিলের সাথে পা লেগে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম ঠিকই কিন্তু প্রচন্ড জোরে শব্দ করে একটা গ্লাস পড়ে গেলো। আমি ভয় পেলাম বাবা হয়তো উঠে বসবে, কিন্তু আমাকে প্রায় দুনিয়ার অষ্টম আশ্চর্যের হতবিহবলতায় অবাক করে দিয়ে বাবার পাশ থেকে উঠে বসলেন রেহানা আন্টি!! ডিম লাইটের আবছা আলোতেও আমি তার ভয়, বিস্ময় আর হতাশ মুখ এক সাথে আবিষ্কার করলাম। আর আমি? অবাক, দুঃখ বা হতাশা কিছু নয় বরং আমি শুধু নিঃশব্দে লাইট টা জ্বলালাম। রেহানা আন্টি, আমাকে বলতে গেলো- অয়ন বাবা, আসলে তোমার বাবার শরীর খারাপ তাই আমি ...
আমি নিজের তর্জনী ঠোঁটের উপর রেখে তাকে চুপ করতে বললাম। আর খুব আস্তে বললাম আপনি প্লিজ আমার সাথে ডাইনিং এ আসুন। বাবা ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ঘুমাচ্ছে আমি বুঝতে পেরে আমি রেহানা আন্টি কে ডাইনিং এ নিয়ে সব জানতে চাইলাম। রেহানা আন্টিও আমার নির্দেশ মেনে ধরা পড়া চোরের মত মাথা নিচু করে ডাইনিং এ আসতে লাগলেন আমার পিছু পিছু। বাবার রুমের লাইট অফ করে আমরা ডাইনিং এর দিকে গেলাম।
ডাইনিং টেবিলে আমি তার মুখোমুখি বসে বললাম- দেখুন আমি সত্য জানতে চাই, এখন আমার বাবা যখন প্রায় মৃত্যু শয্যায়, আশা করি আপনি আমাকে সব সত্য বলবেন। অথবা আমি এই বাড়ি আর সব ছেড়ে চিরদিনের মত কোথাও চলে যাব। আমার মনে তখন বৈশাখের ঘুর্নিঝড়, রাগ আর কষ্ট একসাথে ঘুরপাক খাচ্ছে, সারাজীবন আমার যে বাবা কে আমি সন্ত পুরুষ জেনে এসেছি তার এহেন পদস্খল আমার সহ্য হচ্ছেনা। কী তীব্র বেদনাই না আমি অনুভব করছিলাম সে মুহুর্তে। আমার নিজেকে রিক্ত আর প্রতারিত মনে হচ্ছিল,
রেহানা আন্টি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে শুরু করলেন- অয়ন, আজ যে সত্যের মুখোমুখি তুমি দাড়াতে যাচ্ছ, তা আসলে কারোর জন্যই মঙ্গগল হবে না, আমার মনে হয় তাই তোমার সেটা না শোনাই সব চেয়ে ভাল। শুধু এটুকুই বিশ্বাস রেখো তুমি যা দেখেছে, তাতে কোন পাপ নেই, তাতে কোন অন্যায় নেই।
আমি জেদীর মত উনাকে বললাম- দেখুন আমি ভাবাবেগের কথা শুনতে নই আমি সত্য জানতে চাচ্ছি। আপনি আমার বাবার রক্ষিতা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি পুরোটাই জানতে চাই” দাঁতে দাঁত চেপে বললাম।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেহানা আন্টি বলতে শুরু করলেন- ছিঃ অয়ন! আমাকে নোংরা ভাবছ ঠিক আছে, বাবাকে না। তোমার বাবা তার সমস্ত জীবনের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়েছেন শুধুমাত্র তোমাকে একটা সুস্থ জীবন দেয়ার জন্য।
আমি ক্রূর হাসি দিয়ে বললাম, এখন কী আমাকে নিয়ে ইমোশনাল গেইম খেলে নিজেকে আড়াল করতে চাইছেন!! শোনেন আমি ভালই বুঝতে পারছি আমার বাবার একাকীত্বের সুযোগে আর সম্পদের লোভে নিজের হীন চরিত্রে বাবাকে বশ করেছেন গত ছয়মাসে!!
এইবার হেসে ফেললেন রেহানা আন্টী- অয়ন তুমি যা ভাবছ, বিষয়টা তার চেয়েও জটিল। আমি তোমার বাবার বিবাহিতা স্ত্রী, আর সেও ত্রিশ বছর ধরে।
ত্রিশ বছর!!! আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, তাহলে আমার মা!
অয়ন বাবা, শোন প্লিজ, তুমি একটু ঠান্ডা মাথায় আমার কথা গুলো শোন। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে, আজ আমি তোমাকে যা বলবো তা কেবলমাত্র তোমার বা আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং তোমার বাবা কখনোই যেন বুঝতে না পারেন তুমি আমার কাছ থেকে সব জেনেছ, ইনফ্যাক্ট যেন কেউই বুঝতে না পারেন যে তুমি কিছু জানো।
আমি তখন ক্ষোভ আর কৌতুহলে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে তার সব শর্তেই রাজি হয়ে গেলাম। উনি বলতে শুরু করলেন-
তোমার বাবা ছিলেন এক শিক্ষকের ঘরের সন্তান, ছোটবেলায় মাকে হারান, তোমার দাদা পাগল হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন, অনেক পরে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল কোন এক মর্গে। সে গল্প অন্য একদিন বলব। তোমার অসহায় এতিম বাবাকে আমার মা নিজ সন্তানের স্নেহে বড় করবেন বলে আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন। ও বলা হয়নি, আমি আর তোমার বাবা কাজিন। আমার মা ছিলেন তোমার বাবার ফুপু। আম্মাকে তোমার বাবাকে নিয়ে এলেন আমাদের বাসায়। আমাদের বাসায় যখন সে আসলো, তখন আমার বাবা এলাকার চেয়ারম্যান এবং ব্যাবসায়ী। এলাকার অন্যতম সেরা ধনী পরিবারের সন্তান ছিলাম আমরা। আমরা মানে আমি আর আমার তিন বোন। আমাদের কোন ভাই ছিল না। তোমার বাবাকে আমার মা নিজ সন্তানের স্নেহে বড় করলেও আমার বাবা তাকে দুইচোখে দেখতে পারতো না। কারনে অকারনে মারতো। অসহায়, এতিম একটা ছেলের প্রতি আমার বাবার এমন সীমাহীন আক্রোশ কখনোই আমি বা আমার বোনেরা মানতে পারতাম না। তাকে আমরা সবাই খুব খুব ভালবাসতাম। আমি ছিলাম সবার ছোট, তোমার বাবার সমবয়সী। আমার বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অনেক ছোটবেলায়, উনি স্বামীর সাথে সেই বয়সেই ইউ এস এ পাড়ি জমান। এক সময় উনার সাথে আমাদের সবার যোগাযোগ কোন অদৃশ্য কারনে বন্ধ হয়ে যায়, সম্ভবত উনার উন্নাসিক স্বামী আমাদের সাথে উনাকে আর যোগাযোগ রাখতে দেন নি। যাই হোক, যখনকার কথা বলছি, আমার মেজ বোনের ও বিয়ে হয়ে গেছে। আমি আর তোমার বাবা একই ক্লাসে পড়তাম। ভীষন ভাল ছাত্র ছিল তোমার বাবা। সে বছর আমি এবং সে দুজনেই এক সাথে ট্যলেন্টপুলে বৃত্তি পেলাম ক্লাস ফাইভে। পুরো গ্রামে আমাদের নিয়ে মাতামাতি, অনেক সংবর্ধনা দেয়া হলো। আমার বাবা সেই প্রথন তোমার বাবাকে নিজে থেকে একটা শার্ট কিনে দিলেন। আমার এত ভাল লাগছিল, আমি কেঁদে ফেললাম, দেখলাম তোমার বাবাও কাঁদছে। আচ্ছা অয়ন তুমি কী জানো তোমার বাবা যে খুব সুন্দর একটা ডাক নাম আছে??
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তে তাকালাম রেহানা আন্টির দিকে।
তোমার বাবার ডাক নাম টগর। তোমার দাদা রেখেছিলেন সে নাম। জীবনে আমার মা, আমি আর বোনেরা ছাড়া কেউ কখনো সে নামে ডেকেছিলেন কিনা জানা নেই। আজ আমি তোমাকে টগরের গল্প বলব।
টগর ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, যদিও আমার বোনেরা তাকে ভাই ভাবতেই খুব পছন্দ করতো। কিন্তু আমার শৈশবের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল টগর। টগর খুব সুন্দর ছবি আকতে পারতো। একবার তখন আমরা ক্লাস এইটে পড়ি, জাতীয় পর্যায়ের কোন এক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় দেশ সেরা হলো টগর। পুরষ্কার দিবেন ততকালীন প্রেসিডেন্ট। তার কিছুদিন পর আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা। টগরকে ঢাকায় নিয়ে যাবার কেউ নেই, পুরষ্কার আনতে যাবে কেই নেই তার সাথে। আমাদের স্কুলের এক স্যার গেলেন সাথে। বাবা কিছুতেই খরচ দিবেন না, এইসব ছবি আকাআকি তার কাছে অর্থহীন চর্চা। মা লুকিয়ে আমার মেজ বোনকে দিয়ে টাকা পাঠালেন স্যারের কাছে টগর কে ঢাকায় নিয়ে যাবার খরচ। টগর আর স্যার দুই দিনের জন্য ঢাকা গেলেন। প্রতিটা জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হলো তোমার বাবার ছবি। আমাদের গ্রামে তখন পত্রিকা আসতো সন্ধ্যার দিকে। হেড মাস্টার ছুটতে ছুটতে আসল টগরের ছবি সহ পত্রিকা নিয়ে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল টগর আমাদের কোন অংশ নয়, টগর বিরাট কোন ব্যাক্তিত্ব। আর টগর, কী ভীষন লাজুক ছিল, রাতের আগে তাকে আর খুজেই পাওয়া গেল না। তার কিছুদিন পর জানা গেলো টগরকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সাথে ইন্ডিয়া পাঠাবে বাংলাদেশ সরকার। টগরের গর্বে ভরে গেলো আমার মায়ের বুক। নিজের জমানো টাকায় নতুন নতুন সব শার্ট বানিয়ে দিলেন, পনের দিনের জন্য টগর চলে গেলো ইন্ডিয়া। টগর গেলো ১৫ দিনের জন্য। আমাদের বয়স তখন ১৪। শৈশব ছেড়ে কৈশোরে মাত্র প্রবেশ করেছি আমি। টগর কে না দেখে ১৫ দিন থাকা আমার কাছে দুর্বিষহ লাগতে লাগলো। আমি বুঝে গেলাম, আমি টগরের প্রেমে পড়েছি। কী ভীষন লজ্জা আর ভয় হতে থাকলো আমার। আমার মনে হচ্ছিল যে কেউ আমাকে দেখলেই বুঝে ফেলবে আমি টগরের প্রেমে পড়েছি। ঐ ১৫ দিন যে আমার কী করে কাটলো বোঝানো যাবেনা।
টগর ফিরলে আমার মনে হলো আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। টগর তখন অনেক কনফিডেন্ট একজন কিশোর। ১৫ দিনের বিদেশ সফর ওকে অনেক বদলে দিয়েছে, সরকারের কাছ থেকে পাওয়া টাকায় সে আম্মার জন্য শাড়ি আর আব্বার জন্য ঘড়ি আনলো। আমার বোনদের জন্য এনেছিল চুলের ক্লিপ। আমরা সবাই খুব খুশি হলাম। আমাকে খুব অবাক করে দিয়ে সে আমাকে একটা লাল নোট বুক গিফট করলো, তাও সবার চোখের আড়ালে। আমি খুশি আর বিস্মইয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সে রাতে টগর জানালো সে ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করতে চাচ্ছে। সেই প্রথম আমার বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলাম সদ্য কচি দাড়ি গোফ গজানো টগরকে। কী সাবলীল আর আত্মবিশ্বাসী লাগছিল টগর কে। সে জানালো সরকারি অর্থ সহায়তায় সে ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করতে চায়, বিদেশি একটি সংস্থা তাকে ফান্ডিং দিবে। টগরের বলার মাঝে এমন একটা কিছু ছিল যে বাবা না বলার কোন সুযোগ ই পেলেন না। আম্মা শুধু কেপে গিয়ে বলল, তুই একা কী করে থাকবি বাবা? ফুপু আম্মা, আমি তো সবসময়ই একা। টগরের এই কথা শুনে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন আম্মা। আর আমি- কী প্রচন্ড কষ্ট যে আমার হচ্ছিল, এক গাদা কান্না দলা পাকিয়ে আমার গলার কাছে এসে ঠেকলো। আমার মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় দম আটকে মারাই যাবো। আমি সারারাত নির্ঘুম কাদলাম। আম্মা আমার ফোলা চোখ দেখে বুঝলেন টগরের জন্যই আমার কান্না। আম্মা শুধু বললেন- রিনা, টগর কে বাঁধা যাবেনা রে,ও যে অজেয়। ও তোমাকে বলা হয়নি, আমার ডাক নাম রিনা। মায়ের ঐ কথায় আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম। তাহলে কী টগর চিরদিনের মত আমার কাছ থেকে দুরে সরে যাবে!!
টগরের ঢাকায় যাওয়াট আমার জন্য বলতে গেলে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিল, যে কথা কখনোই আমি হয়ত মুখ ফুটে বলতে পারতাম না, চিঠি লিখে জানাতে আমার খুব একটা সময় লাগলো না, চিঠি দেয়া নেয়া আর বছরের দুই ঈদে টগর বাড়ী আসার মধ্যে দিয়ে আমরা আরো বেশি কাছাকাছি চলে এলাম। এস এস সিতে টগরের রেজাল্ট খুব একটা ভাল না হলেও আমি দুর্দান্ত রেজাল্ট করলাম। এবার মা চাইলেন আমি যেন ঢাকায় পড়তে যাই, বাবাকে রাজি করাতে পারলাম না তবে, আমাকে কথা দিলেন এইচ এস সির পর আমি অবশ্যই ঢাকা গিয়েই পড়বো। এইচ এস সি পরীক্ষার ২ মাস আগের কথা ,এক লঞ্চ দূর্ঘটনার আমার বাবা আর বোন মারা যায়। এই ঘটনায় পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে আম্মা। আমিও কিছুতেই আর মনোযোগ দিতে পারছিলাম না, টগর এসে থাকলো কিছুদিন। এরপর আমাদের পরীক্ষা, আমার রেজাল্ট এতটাই খারাপ হলো যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াও হলো না। আর মাকে রেখে ঢাকায় পড়তে যাওয়াও আমার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়লো। আমি স্থানীয় এই কলেজে বি এ তে ভর্তি হলাম। আব্বার ব্যাবসার কিছুই আমরা জানতাম না। আম্মার মানসিক অবস্থাও তখন খুব খারাপ ছিল, আম্মাও সব কিছু গোছাতে পারছিলেন না। কোন ভাবে আমাদের দিন চলছিল। টগর তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র। আমার সাথে তার চিঠি লেখালেখি টা বেশ বেড়েছে তখন, আমার তো তখন টগর ছাড়া কেউ ই নেই। আমরা খুব অর্থকষ্টে পড়ে গেলাম, আমার চাচারা ঘোষনা করলো যে আমাদের বাবার কোন ছেলে না থাকায় আসলে আমরা তেমন কোন বিষয় সম্পত্তি পাবোনা। তবুও তারা তাদের মহত্ত্ব দেখাতে আমাদের কোন রকম খাওয়া পড়ার ব্যাবস্থা করলো। আর আম্মাকে চাপ দিচ্ছিল আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার জন্য। তখন টগর মাত্র থার্ড ইয়ারে পড়ে, ওকে বিয়ের কথা বলাটাও আমার কাছে খুব লজ্জার। তবু একবার ঈদে সে বাসায় আসলে আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম- টগর আমি আর পারছিনা, চাচার আমাকে বিয়ে দিবেন ই। টগর হাসতে হাসতে বলল চল তাহলে বিয়ে করে ফেলি। আমি অবাক হয়ে তাকালাম, সে কাছে এসে বলল আমি সিরিয়াস। তবে তোমার উপযুক্ত হতে আমাকে দুইটা বছর সময় দিতে হবে। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন। তার ও প্রায় বছর খানেকপর মেজ আপার বাসায় যাবার নাম করে আমরা খুব বেড়ালাম, সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার আগে টগর কি মনে করে যেন আমাকে বলল, রিনা বিয়ে করবে আমায়?্টগরের কণ্ঠে এমন কিছু একটা ছিল যে আমিও রাজি হয়ে গেলাম। সেদিন সন্ধ্যায় কাজি অফিসে গিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম আমরা। ওর হাত ধরে যখন ফিরছিলাম, কী অদ্ভুত একটা অধিকার বোধ হচ্ছিল। টগর বলল আর মাস ছয়েক পরেই ওর ফাইনাল পরীক্ষা, পরীক্ষা দিয়ে এসেই আম্মাকে বলে সব ব্যাবস্থা করবে। টগরের ঢাকায় যাবার তাড়া ছিল পরদিন ভোরে সে চলে গেলো।
আমার মন পড়ে থাকলো টগরের কাছে, আমি বারেবার ওকে বাড়ি আসার তাড়া দিচ্ছিলাম, কিন্তু পরীক্ষার ব্যাস্ততায় ও সময় করতে পারছিলনা, আমার চাচাদের উতপাত বেড়েই চলল। আমাদের কিছু বড় গাছ ছিল সেগুলো আম্মাকে না জানিয়েই বিক্রি করে দিলেন। আম্মাকে চাপ দিচ্ছিলেন তাদের পছন্দ করা এক লোকের সাথে বিয়ের জন্য। আমার একদম দম বন্ধ হয়ে আসছিল, এমনই এক রাতে আমাকে অবাক করে দিয়ে টগর এসে হাজির। আম্মার শরীর টা সেদিন খুব খারাপ ছিল, আমি টগর কে ভাত বেড়ে খাওয়ালাম। সে হেসে বলল, এই তো আমার বউইয়ের মত লাগছে। আমি ভীষন লজ্জা পেলাম। সেদিন রাত আমার জীবনের সেরা রাত ছিল। বিবাহিত জীবনের পুর্নতা পেল সে রাতে। খুব খুব সুখে কাটলো আমাদের সে রাতে। পরের সপ্তাহে টগরের ফাইনাল, তাই আম্মার দোয়া নিয়ে পরদিনই চলে গেলো টগর।
টগর চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন আম্মা। বিভিন্ন কৌশলে আমাকে ভয় দেখাতে লাগলো, আমি অনেকবার টগরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু চাচাদের বাধায় আর ওর পর্যন্ত পৌছানো হল না আমার। আম্মার মৃত্যুর পরদিন ই একপ্রকার বেধেই আমার বিয়ে দেয়া হয় হাসেমের সাথে। স্বল্প শিক্ষিত হাসেম আমাদের গ্রামের ই ছেলে কিছুটা বোকা আর উদাসীন দরিদ্র পরিবারের সে খুব বেশিদুর লেখাপড়াও করেনি। আমার মেজ বোন কে আম্মার লাশ ও দেখতে দেয়া হয়নাই। আমি টগরের কথা অনেকবার সবাইকে বলতে চাইলেও কেউই আমার কথা শুনলো না। একদিকে মায়ের জন্য শোক অন্যদিকে টগরকে হারিয়ে ফেলা আমি পাগল প্রায়। হাসেমকে বিয়ের রাতে আমি পা ধরে অনুরোধ করি তাকে জানাই টগরের কথা। বোকা হাসেম বলে ঠিক হয়ে যাবে, টগর ঢাকা শহরে পড়ে তোর কাছে কি আর আসবে??
মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে টগর গ্রামে আসার অনেক চেষ্টা করে কিন্তু আমার চাচারা মিথ্যা খবর দেয় যে আমি হাসেমের সাথে পালিয়ে গেছি শুনে মা মারা গেছে, টগর অবশ্য বিশ্বাস করেনি প্রথমে, কিন্তু আমার অতি ধুরন্ধর চাচারা পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে করে যে টগর আর গ্রামেও আসতে পারেনা, আমার সাথে দেখাও করতে পারেনা। আমিও এমন ট্রমায় পড়ে গিয়েছিলাম। টগরের সাথে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। যখন যোগাযোগ করতে পারলাম জানলাম তোমার মা কে বিয়ে করে সে দেশের বাইরে গেছে পড়াশোনার জন্য। আমি একদম ভেঙ্গে পড়লাম। এর মাঝেই সাব্বির এলো আমার গর্ভে। হাসেমের সাথে আমার কখনোই বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না, আর তাই বুঝতেই পারছো সাব্বির তোমার পিতারই সন্তান।
যে অনুচ্চারিত ভয় আমি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছি সাব্বিরের ব্যাপারে, আজ তার মুখোমুখি আমি। কী তীব্র হাহাকার আমি বোধ করছি, সাব্বির আমার ভাই, একই পিতার ঔরসে জন্মানো ভাই আমার। এমন এক অদৃশ্য সম্ভাবনার ভয় যে আমার মাঝে ছিল না তা না, কিন্তু বরাবরই উড়িয়ে দিতে চাইতাম আমার সেই সন্দেহ করা ভয়। উফফ আজ তাহলে এই অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি আমি!! তাহলে আমার মা??
………………………………………………………………………………………………………………..
ডাইনিং টেবিলে আমি আর রেহানা আন্টি বসে যখন কথা বলছিলাম, এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম আমরা যে খেয়াল ই করিনি, খুব দ্রুত কেউ একজন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চমকে উঠলাম আমি আন্টির কন্ঠে উষ্মা শুনে- তুমি এখানে কী কর!!
তাইলে তুই অয়ন বাবারে সব কইয়া দিছস!!
রেহানা আন্টি বলল- ওর তো জানতে হতই , আর কতদিন তোমরা ওরে অন্ধকারে রাখবা আর আমারে কষ্ট দিবা!!
হাসেম মামা চীৎকার করে উঠে, আমি তোরে এইজন্যই এই বাড়ীতে রাখতে চাইনাই কোনদিন। হাসেম মামার চীৎকারেই কিনা জানিনা, বাবার ঘুম ভেঙ্গে যায়,’হাসেম, হাসেম! কি হয়েছে??’ রেহানা আন্টি আমাকে যেতে না করে, উনারা দু’জন এখন দৌড়ে বাবার রুমে যায়, বাবা ওয়াশ রুমে যায়। রেহানা আণ্টি তাকে হেল্প করে। আমি দুর থেকে দেখি কী সস্নেহে বাবাকে রেহানা আন্টি ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। আমি কিছুটা এগিয়ে বাবার ঘরে উঁকি মারি, আমার সুদর্শন বাবা ওজন হারিয়ে ক্ষীনকায় হয়ে গেছে, আমাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে কাছে ডাকলো। আমি এগিয়ে গেলে বাবা হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে ডেকে নিলেন- ঘুম আসছে না অয়ন?? আমি মিথ্যে করে বললাম, পানি খেতে উঠে তোমার রুমে আলো দেখে আসলাম বাবা।
বাবা বললেন অয়ন আমার তোমার সাথে অনেক কথা জমে আছে। আমি বললাম আমারো। কাল সকালে আমরা এক সাথে ব্রেকফাস্ট করবো বাবা, তখন কথা হবে। তুমি কোথাও যেও না।
সেদিন রাতে আমার আর ঘুম হলো না, খুব ভোরে আমি ছাদে গেলাম, ছাদে খুব সুন্দর বাগান, আমাদের খালি ছাদে এই প্রথম আমি এত সুন্দর বাগান দেখলাম। বহুদিন পর আমি ভোর হওয়া দেখলাম, আমার মাথায় তখন রাজ্যের প্রশ্ন। আমার মা আর আমি কী বাবার জীবনের অনাহুত অতিথি, নাকি বাবা আজীবন আমাকে করুনা করে গেছেন। আমার মায়ের মৃত্যু নিয়ে কী আসলেই কোন রহস্য আছে? আমার মায়ের কি স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে নাকি বাবা তার প্রথম প্রেম কে প্রতিষ্ঠিত করতে আমার মা কে... না না আমি আসলে কী আজেবাজে কথা ভাবছি,আমার শৈশব কৈশোরে বাবা আমাকে কী তীব্র ভালবাসায় ই না বড় করেছেন।
আমার খুব চায়ের তৃষ্ণা পাচ্ছিল, ভাবছি নিচে গিয়ে এক কাপ চা কিংবা কফি কিছু আনবো কিনা। কিন্তু নিচে যেতেও ইচ্ছা করছেনা। নিচে নামবো কি নামবো না ভাবছি এমন সময় সিগারেট হাতে সাব্বির উঠে এলো ছাদে। আমাকে দেখে সাব্বির বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, নিচে নেমে যেতে চাইলো- আমি ডাকলাম,’ সাব্বির কী করছো আজকাল?” স্যার আমি বড় বাবার সাথে থাকি, আমার দোকান টা ভাড়া দিয়ে দিয়েছি, এম বি এ তে ভর্তি হয়েছি।
‘বাহ, তাহলে তো তুমি বেশ ব্যাস্ত, অফিসে যাওনা?’
“স্যার, বড় বাবা আমাকে অফিসে যেতে না করেছে, আম্মু বলেছে এম বি এ শেষ করলে বড় বাবাকে বলবে অফিসে জবের ব্যাবস্থা করতে’
‘ সাব্বির, তুমি কী খুব গাছ ভালবাসো তাই না??
লজ্জা পেয়ে সাব্বির বলল- স্যার আপনি বললে আমি সব টব সরিয়ে ফেলব
আরে না না , আমার তো খুব ভাল লাগছে, সুন্দর হয়েছে।
সাব্বির, তোমার বন্ধু আছে??
স্যার আমি নিচে যাই, বলে দ্রুতই নিচে নামলো সাব্বির, সম্ভবত আমার সাথে ছোটবেলায় খেলতে চাওয়ার অপরাধে প্রাপ্ত শাস্তির স্মৃতি এখনো ওর মন থেক মুছে যায় নাই। ‘সাব্বির কাউকে আমাকে এক কাপ চা পাঠাতে বলো না প্লিজ’।
আমাকে অবাক করে দিয়ে চা নিয়ে আসলেন রেহানা আন্টি, অয়ন বাবা, হাসেমকে তুমি কখনো কিছু জিজ্ঞেস করোনা, ও তোমাকে মিস গাইড করবে।
ও আপনি বুঝি আমাকে খুব গাইড করছেন!! কেন জানিনা প্রচন্ড রাগ লাগছিল আমার ।
“আচ্ছা আপনি কী আমাকে আমার মায়ের কথা বলবেন- কিভাবে আপনি আমার মাকে সরিয়ে দিয়ে আমার বাবার জীবনে এলেন আবার’ রেহানা আন্টী বলতে শুরু করলো’ অয়ন বাবা তোমার মা কে আমি কখনোই দেখিনি, আর তোমার মায়ের ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা’ তোমাকে আমি যা বলেছি, সবই আমার জীবন কাহিনী সেখানে তোমার মায়ের কোন অংশ নেই বা তোমার মা ও সেখানে আমার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নয়’
‘তোমার বাবা তোমাকে বলেছেন ই যে তোমার মা মারা গেছেন’ ‘ আর কিছু আমি জানিনা’ বলে দ্রুত চলে গেলেন তিনি।
বাবা সবসময় দেরি করে ঘুম থেকে উঠেন, কিন্তু এখন অসুস্থতার কারনে ঘড়ি ধরা রুটিন তার, বাবার ফিজিও থেরাপিস্ট আসেন সকাল সাতটায়। আমি ছাদ থেকে দেখলাম শ্যামলা এক তরুনী থেরাপিস্ট আসলেন আমাদের গাড়ি করে, বাবাকে থেরাপি দিতে। আমি নিচে নামলাম, বাবাকে গুড মর্নিং বলতে। বাবা আমাকে দেখে তার থেরাপিস্ট সুমাইয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বাবা খুব আগ্রহ করে বললেন- দেখ সুমাইয়া আমার ছেলে-অয়ন, খুব হ্যান্ডসাম না?? আমি অসুস্থ শুনে পড়াশোনা বাদ দিয়ে চলে এসেছে। মনে হলো বাবা খুব খুশি হয়েছেন আমি চলে আসাতে।
‘গুড মর্নিং সুমাইয়া’- হাত নেড়ে বললাম আমি
অয়ন সাহেব গত সাতদিন ধরে আমি আপনার প্রশংসা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে হয়ে পড়েছি- বলেই হা হা করে হেসে ফেলল । কী সুন্দর রিনরিনে হাসি সুমাইয়ার। আচ্ছা অয়ন সাহেব আমার ডাক নাম কনা, আপনি আমাকে কনা ও ডাকতে পারেন। আমি আংকেল কে অনেকবার বলেছি উনি কেন যেন কষ্ট করে সুমাইয়াই ডাকেন আমাকে। মেয়েদের সাথে খুব একটা না মেশায় কনার সাবলীলতায় আমি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।
‘ওকে মিস কনা, আপনি বাবাকে এক্সারসাইজ করান, আমি ফ্রেশ হই’ বলে আমার রুমে চলে গেলাম। ব্রেকফাস্টে বসে দেখি আজ আমার ফেভারিট সব ব্রেকফাস্টের আয়োজন করেছেন রেহানা আন্টি, অকারনে আমার সাথে খাতির দিতে চাচ্ছেন বলে আমার মনে হল, আরো বিরক্তি বাড়লো। তবু বাবার জন্য আগ্রহ দেখে খেতে বসে বুঝলাম আমি খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম।
"বাবা আমার কিছু কথা ছিল তোমার সাথে!"
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাবা তাকালেন।
বাবা আমি মায়ের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল।"
বাবা এবার আমাকে বললেন -আমার মনে হয় এর চেয়ে জরুরী কথা আমার তোমার সাথে আছে"
"কিন্তু বাবা আমি মনে করি মায়ের ব্যাপারে জানার অধিকার আমার আছে"
"তোমার জন্মের সময় মা হারিয়েছ, এর বেশি কিছু জানার দরকার নেই" চিবিয়ে চিবিয়ে এই কথা বললেন বাবা, তার মুখের বর্ণ তখন রক্তিম, হঠাৎই ঘামাতে শুরু করলেন বাবা, আমি ভয় পেয়ে হাসেম মামাকে ডাকলাম আর উঠে গিয়ে বাবার পাশে গিয়ে দাড়ালাম-খারাপ লাগছে বাবা?
হাসেম মামা দৌড়ে ওষুধ নিয়ে বাবার জিহবার নিচে দিলেন, স্যার আপনি শান্ত হন। ততক্ষণে দৃশ্যপটে মূল ক্রিমিনাল রেহানা আন্টি হাজির, এসেই আহ্লাদ দেখানো শুরু করলো, উফফ কি হয়েছে তোমার। প্রেশার বেড়েছে বোধ হয় আবার"। আমার দিকে তাকিয়ে একটা রাগী দৃষ্টি দিল "অয়ন, বাবার শরীর কিন্তু খুবই খারাপ, আশা করি বুঝতে পারছ" না চাইতেও আমার ঠোটেঁ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল তার কথায়। ওষুধটা নিতেই বাবা হয়ত একটু ভাল ফিল করল। আমি বাবার কাধেঁ হাত রাখলাম-‘অয়ন, আমি চাই তুমি আমাদের ব্যাবসা টা বুঝে নাও, আমাদের জি এম তোমাকে সব বুঝিয়ে দিবেন’
‘আমি’!! একপ্রকার চীৎকার করেই উঠলাম আমি। ‘বাবা আমি ব্যাবসা বুঝিনা, আমি পারবো না’ তুমি লোক রাখো।
‘ অয়ন, এই ব্যাবসা তোমার, তোমাকেই বুঝে নিতে হবে’ বাবার গলায় আদেশ।
বাবা আমি আমার মাস্টার্স শেষ করে, পি এইচ ডিতে এনরোল করবো ভাবছি। আমার প্রিয় বিষয় কোয়ান্টাম ফিজিক্স, আমি ব্যাবসা করলে তুমি শুধু লস ই খাবে’
‘অয়ন, আমি চারুকলার ছাত্র ছিলাম, জীবনে আমি একজন আর্টিস্ট হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ব্যাবসায়ী হিসাবেই আমি অনেক বেশি সফল’ তুমিও পারবে।বাবা বেশ রাগ্বত স্বরে বললেন।
তুমি রেডি হয়ে আসো, অফিসের কয়েকজন উপরের লেভেলের কর্মকর্তা আসবেন তোমার সাথে ফরমাল ই পরিচিত হতে। অবশ্যই তুমি স্যুট পড়ে আসবে।
অসুস্থ আর দৃঢ় গলায় বলায় বাবার কথা মেনে আমি বাবার স্টাফদের সাথে কথা বললাম। উনাদের অনেকেই আমাদের কোম্পানিতে একদম শুরু থেকেই আছেন।
পরবর্তী কয়েকদিন বাবার ব্যাবসা বুঝে নিতে আমি রীতিমতো গলদঘর্ম হয়ে গেলাম। সকালে ব্রেকফাস্ট এর পর থেকে শুরু, মাঝরাতে ফিরতাম আমি। আস্তে আস্তে বাবার অফিসে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিলাম আমি। বাবা আগের চেয়ে একটু সুস্থ। ইদানীং হাটতেঁ পারছেন একটু নিজে নিজে। মাঝে মাঝে সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে কনার সাথে দেখা হয়। বাবার সাথে কনার খুনসুটি গুলো ভীষন মজার ছিল, আমিও যোগ দিতাম না যে তা না। তবে কণার স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা দেখতেই আমার খুব ভাল লাগতো। রেহানা আন্টি পারতঃ পক্ষে আমার সামনে আর আসেন না। সাব্বিরের সাথেও আমার খুব একটা দেখা হয় না।
অতিরিক্ত ব্যাস্ততায় হাপিয়ে উঠছিলাম আমি। পালাই পালাই লাগছিল মনে। একদিন রাতে বাবাকে বললাম বাবা আমি কয়দিন ছুটি চাই, বাবা বললেন কেবল তো মাত্র গুছিয়ে এনেছ এখন ই কেন ছুটি! আমি চুপ করে আছি দেখে বললেন ঠিক আছে, কোথাও ঘুরে আসো।
বাবা আমি সাব্বির কে নিয়ে যাই! বাবা ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, এক কাজ করো কণাকেও বলে দেখো না তোমাদের সাথে ও ওর বন্ধুদের নিয়ে যাবে কিনা, ও তো প্রায় তোমার সমবয়সী ই। ক্ণাকে নিয়ে যাওয়ার কথায় আমার একবার মনে হলো বাবার অন্য কোন প্ল্যান নেই তো! পরক্ষণেই সে চিন্তা মন থেকে সরালাম। বাবা আমাকে জানেন, এমন কিছু ভাববেন না। এতটা অবিবেচক তিনি কখনোই হবেনা না। আমি তাই বললাম আচ্ছা জিজ্ঞেস করে দেখব।
কণাকে একবার জিজ্ঞেস করাতেই হৈ হৈ করে উঠলো। ঠিক হলো আমি, কণা, কনার বেস্ট ফ্রেন্ড সোমা সাজেকে যাবো। আমাদের সাথে যাবে সাব্বির। সাব্বিরকে ড্রাইভার ভাবতে আমার কখনোই ভাল লাগে না। তাই আমি সাথে আমাদের পুরানো ড্রাইভার মন্টু আংকেলকেও নিলাম, অনেক টা বাবার কথা না মেনেই।
সাজেকে যাবার দিন কনা আর সোমার সাথে সোমার কাজিন ইষিতা ও এলো। সারা রাস্তা আমরা অনেক মজা করতে করতে গেলাম। অবশ্য বলা ভাল সব মজাই কনা করলো, সাথে ছোট্ট ইষিতা আমি তো বরাবরই মুখচোরা, তবু মাঝে মাঝে কথা বলে জমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সাব্বির একদম চুপ। সাব্বিরের এই অদ্ভুত এটিচিউড দেখে কণা হেসেই কুটিকুটি, সে সাব্বিরের নাম দিয়েছে কাষ্ঠ মানব। একটু পরপর খোঁচাচ্ছে। আমার ভীষন মজা লাগছিল।
সাজেকে আমাদের কটেজ গুলো খুব দূরে দূরে, কিন্তু বাবার নির্দেশেই কিনা জানিনা কোন বিচিত্র কারন সাব্বির আমাকে চোখে চোখে রাখতে লাগলো। আমি ব্যাপারটা ইগ্নোর করে গেলাম। কনাদের কটেজ একটু দূরে। সাজেকের কয়েকটা দিন আমরা খুব মজা করলাম, কনার সাথে বন্ধুত্বটা আমার বেশ জমে উঠলো। সোমার সাথেও বেশ সহজ এক টা সম্পর্ক হলো। সাব্বির ও আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে সবার সাথে, শুধু আমার সাথে কিছুতেই সম্পর্ক টা আর হৃদ্য হলোনা, আমাকে দেখলেই আড়ষ্ট হয়ে যায় সে। কনার সাথে সাব্বির এখন অনেক সাবলীল। মাঝে মাঝে আমি দূর থেকে ওদের দেখি, সারাক্ষন খুনশুটি, সোমা তাদের নাম দিয়েছে টম এন্ড জেরি। সাব্বিরের মাঝে আমি যেন আমার নিজেকেই খুঁজি, ঠিক আমার মতই সে দাঁত দিয়ে নখ কাটে, আমারই মত সবসময় ডার্ক কালার পড়ে, আমার মতই সাহলে তারো চোখের দু’পাশে ভাঁজ পড়ে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি সাব্বিরকে আমার ভাই বলে বুকে জড়িয়ে ধরতে না পারার হতাশায়।
ফেরার আগের দিন বিকালের দিকে আমি হাটতে বের হয়েছিলাম, সোমার একটু জ্বর এসেছিল, আর সাব্বির গাড়ির কিছু কাজ করাতে মন্টু আংকেল কে নিয়ে গ্যারেজে। আমি একাই এগুচ্ছিলাম, কনা বলল চলুন আমি ও যাই। খুব সুন্দর ছিল সেদিনের বিকাল, শেষ বিকালের নরম রোদের কনাকেও খুব সুন্দর লাগছিল, সেই প্রথম আমি খেয়াল করলাম কনা আজ শাড়ি পড়েছে, অন্য সময় তাকে আমি টপ কিংবা কুর্তি টাইপ কিছুতেই দেখি। কিছুদূর পর, কনা বলল- অয়ন সাহেব, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে আজ?
আমি হেসে বললাম- সুন্দর।
‘আচ্ছা, আপনি কী লাভ এট ফার্স্ট সাইটে বিশ্বাস করেন?’
আমি হেসে ফেললাম- কনা আমার জীবনে প্রেম ভালবাসা ব্যাপার গুলো নেই।
‘আপনার হাসি কিন্তু খুব সুন্দর, আপনি চাইলেই সিনেমায় নামতে পারেন’- আমি এবার অট্টহাসি দিলাম
আমি সিরিয়াস, আপনি হাসছেন কেন?
‘অয়ন সাহেব আপনাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আমি আজ বলতে চাই, ভেবেছিলাম ঢাকায় গিয়ে বলব। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই বুঝেছেন আমি স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড মানুষ, লুতুপুতু মার্কা ন্যাকামি আমার মাঝে নেই’
কনার কথায় এবার আমার হার্টবিট মিস হলো, আশৈশব তাড়িয়ে বেড়ানোর দ্বিধা কি তবে আজ আমাকে আবার চ্যালেঞ্জ জানালো। কনা কী তবে আজ আমায় আবার অপ্রিয় সত্যের মুখে দাড় করিয়ে দিবে?
আমি বেশ দুরুদুরু মুখে কনার দিকে তাকালাম
‘অয়ন আমি আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি, আপনার সাথে প্রথম যেদিন আমার দেখা হয়, বলতে পারেন আমি সেদিনই আমি আপনার প্রেমে পড়েছি, আপনাকে যতই দেখেছি আপনার প্রতি আমার মুগ্ধতা বেড়েছে কেবল’
‘কনা, আপনার ভুল হচ্ছে, আপনার ভালবাসা আমি গ্রহন করতে পারিনা, আপনি কেন ইনফ্যাক্ট কারো ভালবাসাই এমি গ্রহন করতে পারিনা। আপনি আমায় ক্ষমা করুন প্লিজ।’
‘কেন আমি সুন্দরি নই বলে? আমি মধ্যবিত্ত ঘরের বলে, নাকি আপনি কোথাও বাঁধা? আমি যতদূর জানি আপনি সিঙ্গেল, আপনার বাবার ও আমাকে খুব পছন্দ বলেই আমি বুঝি, আপত্তি হবার কথা না। আপনার দ্বিধা কেন তবে?’
‘ সে আমি আপনাকে বোঝাতে পারবোনা, বলতে পারেন জন্ম আমার আজন্ম পাপ’ আমি ভেজা গলায় বললাম, এমন সময় গাড়ীর হর্ণে আমাদের সম্বিত ফিরলো। সাব্বির রা ফিরেছে, রাস্তায় আমাদের দেখতে পেয়ে হর্ণ দিচ্ছিল। ওদের সাথে ফিরে আসলাম আমরা কটেজে। সন্ধ্যা প্রায় গাড় হয়ে আসছে। সেদিন সন্ধ্যায় আমি আর কটেজ থেকে বের হলাম না, ইষিতা আমাকে ডিনারের জন্য ডাকতে এসেছিল, মাথা ব্যাথার অজুহাতে এড়িয়ে গেলাম।’
সারারাত নিজের সাথে অসীম যুদ্ধ আর পরাজয়। কী নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি আমি, এভাবে কেউ কখনো আমাকে চাইবে এই সম্ভাবনার ভয়ে, মেয়েদের বরাবর ই এড়িয়ে গেছি আমি। আজ এতদিন পর এভাবে এই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাকে স্রষ্ঠা করবেন কে জানতো। খুব সকালে রওনা দেয়ার কথা আমাদের। গাড়িতে আমি কোন কথাই বললাম না কারো সাথে, কানে হেড ফোন আর বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা শেষ করলাম আমাদের।
বাড়ী ফিরে জানিনা হঠাৎ কেন যেন জ্বরে পড়ে গেলাম আমি, তীব্র জ্বরে প্রায় দুইদিন আমি অচেতন থাকলাম, তৃতীয়দিন সকালে আমার জ্বর পুরোপুরি সারল আতংক নিয়ে, আমার বিছানার পাশে কনা বসা, আমি আবার চোখ বুঝে ফেললাম, এবার বাবার কন্ঠস্বর, অয়ন কেমন লাগছে বাবা, দেখ কনা সারারাত তোমার পাশে জেগে ছিল। উফফ, কী অদ্ভুত কথা, একটা মেয়ে কেন একটা অজানা ছেলের পাশে সারারাত থাকবে, বাবাই কেন বা এলাউ করলেন তাকে। কিন্তু আমি যা শুনলাম তা আমার ভাবনার চেয়েও ভয়াবহ।
আশৈশব জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকা আমি নাকি দু’দিন শুধু কনার নাম করেছি!!!
ভয়ের শীতল স্রোত বেয়ে চলল আমার মেরুদন্ড দিয়ে। না চাইতেও এক অন্ধকূপে পড়ে গেছি আমি, কিভাবে উদ্ধার পাবো? কনার মুখোমুখি দাড়িয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিনতম সত্য আমি উন্মোচন করবো, করবোই। এবং সেটা আজই। আর বেশিদূর কনার আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া যাবেনা। আমার পরিচয় ওকে আজ জানতে হবেই। সে বাবা কষ্ট বা ভয় যা- ই পান না কেন।
………………………………………….
বিছানায় শুয়েই রুক্ষ গলায় আমি বললাম, কণা, আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন থ্যাংক্স। আপনার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে, আমার আরো আগেই বলা উচিৎ ছিল। তবে তার আগে আমি বাবার সাথে কথা বলার জন্য একটু সময় চাই।
বাবা ভ্রু কুচঁকে বললেন, তুমি আগে সুস্থ হও, তারপর আমরা কথা বলি।
বাবা তোমার সাথে কথা বললেই সুস্থ হয়ে যাবো। কণা আপনি প্লিজ, ড্রইং রুমে একটু অপেক্ষা করুন। কণার মুখ বর্ণ তখন রক্তিম, সম্ভবতঃ আমার কথায় অপমানিত বোধ করেছে।
কণা রুম থেকে বের হবার পর আমি বাবাকে কাছে আসার জন্য রিকোয়েস্ট করলাম,
"বাবা, তোমার মনে আছে ছোটবেলায় আমি শুধু মেয়েদের ফ্রক পড়তে চাইতাম বলে একবার তুমি আমাকে ওয়াশরুমে আটকে রেখেছিলে? আচ্ছা তোমার তো নিশ্চয়ই মনে আছে, স্কুলে নাচের প্রোগ্রামে আমি সব সময় মেয়েদের ভুমিকায় নাচতাম বলে তুমি আমাকে কো-এডুকেশানে দিয়েছিলে?
বাবা এই ব্যাপার গুলো নিয়ে আমি কখনোই তোমাকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাড়া করাই নি, কারন সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করে গেছি তুমি সবসময় আমার মংগল চেয়েছ, এবং অবশ্যই তুমি আমাকে সব চেয়ে ভালবেসেছ।
কিন্তু বাবা আজ একটা জটিল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি আমি তুমি এবং কণা। আমি ভালভাবেই বুঝতে পেরেছি তুমি কণার সামনে আমাকে একজন মহাপুরুষ হিসাবে দাড়ঁ করিয়েছ, এবং খুব সম্ভবত আমার সাথে বিয়ের ব্যাপারেও ওকে প্রচ্ছন্ন স্বপ্ন দেখিয়েছ।
বাবা -আমি জানতে চাইছি কেন, তুমি জেনে শুনে বুঝে কণার সাথে এমন একটা খেলা খেললে, কণার বান্ধবী সোমার কাছ থেকে জেনেছি তুমি কণার বাবা মায়ের সাথেও এই ব্যাপারে কিছু কথা এগিয়ে রেখেছ, “বাবা তুমি কী তাদের আমার সম্পর্কে বলেছ সব? বাবা প্লিজ চুপ করে থাকবে না, আমি গ্লানি অনুভব করছি। "
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বাবা বললেন- “অয়ন আমি তোমাকে সংসারি দেখতে চাই, আমি সবসময় চেয়েছি তোমার একটা নরমাল লাইফ হোক, আর দশটা যুবকের মত তোমার সুখের সংসার হোক। আমি ছোট বেলা থেকেই তোমাকে একটা পারফেক্ট জীবন দেয়ার ট্রাই করেছি, আমার সমস্ত সৃষ্টিশীলতা আমি ব্যয় করেছি তোমাকে স্বাভাবিক জীবনে আনতে। তুমি যখন নাচের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছিলে, আমি তোমাকে সেখান থেকে বের করে এনে ছবি আকাঁ শিখিয়েছি, মেয়েদের পোষাক পড়তে চাওয়াটা কতখানি অস্বাভাবিক, সেটা তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি, তুমি যেন হীনমন্যতায় না ভোগ তা-ই তোমাকে সমবয়সী কারো সাথে খুব বেশি মিশতে দেইনি। এ লেভেলস পর্যন্ত তোমার বন্ধু ছিল তারাই যাদের কাছে তুমি কেবলই একটা মাইনর, অর্থাৎ তোমাকে তারা খুব একটা গুরুত্ব দিবেনা বলতে পারো খেয়ালই করবে না। আর তোমার স্কুলে আমি মোটা টাকা ডোনেশান দিয়ে গেছি, যেন স্কুলে কোথাও তোমার কোন সমস্যা না হয়।
কণাকে আমি যখন দেখি, আমার ওকে খুব পছন্দ হয় তোমার জন্য। আমি ওর বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে চাই-যেহেতু আমি বাসা থেকে বের হতে পারি না, তাই তারাই এসেছিলেন, বলতে পারো আমি প্রচ্ছন্নভাবে চেয়েছি তারা তোমার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান জানুক।
আমার প্ল্যান এখানেও সফল। কণার নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবা-মা এমনিতেই ৩ কন্যা দায়গ্রস্থ, তার উপর তাদের এক মাত্র ছেলে ড্রাগ এডিকটেড। তারা তোমাকে জামাই হিসাবে পেলে বর্তে যাবে।
এবার বলি কণার প্রসংগে, আমি আসলে চেয়েছিলাম তোমার সাথে ওর বন্ধুত্ব হোক, পরবর্তীতে আমি তোমাকে বিয়েতে কনভিন্স করব, আর কণাকে আমি তোমার ব্যাপারে এক মোহাচ্ছন্ন রূপকথায় রেখেছি, যেখানে তুমি এক রাজপুত্র যার সবটাই কেবল পজিটিভ গুনাবলী। সে তোমাকে নিয়ে কল্পনার জগৎ সাজিয়েছে। সে খুব ছটফটে, তাই হয়তো বোকার মত তোমাকে প্রপোজ করে বসেছে। আমার প্ল্যান টা এই জায়গায় মার খেয়েছে, আমি চেয়েছিলাম আমি তোমাকে আগে সব বলব এবং কণাকেও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করব'
"বাবা, তুমি যা বলছ সেটা কতটা অসম্ভব তুমি ভাল করেই জানো, আমার অক্ষমতা আমাকে কখনোই কোন নারী সংগলাভে সায় দেয় না বাবা। আমি চাই তুমি কণাকে সব বল, যদি তুমি না বলতে পারো আমি বলি"
"অয়ন, তুমি নিশ্চয়ই একা থাকবেনা সারাজীবন, আমি তো এখনই অসুস্থ, তোমাকে একা রেখে আমি মরেও শান্তি পাব না বাবা"
"বাবা, আমার একা থাকাটাই নিয়তি, আমি আমার স্বার্থের জন্য কণার জীবন নষ্ট করতে পারিনা"
"নষ্ট কেন হবে, কণা তোমাকে ভালবাসে তোমাকে পাশে পেলে সে ধন্য হয়ে যাবে"
"বাবা কী অসম্ভব সম্ভাবনার কথা তুমি বলছ, বোঝ! আমি কখনো তাকে সন্তুষ্ট করতে পারবো না, আমাকে বিয়ে করলে ও মা হতে পারবেনা। বাবা আমি চাই না এইসব ব্যাপার আর এক পা আগাক" "তুমি প্লিজ আজই সব বন্ধ করবে অথবা আমি আমার নিয়তি মেনে নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করব"
বাবা বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন "বেশ, আমি কণার ব্যাপার টা দেখছি, কিন্তু তুমি আমাকে কথা দিবে যে, তুমি কণাকে কিছুই বলবে না, আমি চাইনা এত বছর ধরে প্ল্যান করা সব কিছু ভেস্তে যাক, আমি চাই তুমি বলো তুমি অন্য কাউকে ভালবাসো।“
অয়ন বলল- বাবা মিথ্যে বলতে বলতে আমি টায়ার্ড হয়ে পড়েছি, আমি আর পারবো না। আমি আর অভিনয় করতে পারছিনা বাবা।
বাবা- অয়ন, তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমি আমার একটা জীবন স্যাক্রিফাইস করে দিয়েছি, সেটা কেন বুঝছ না!!
তুমি স্যাক্রিফাইস করেছ নাকি আমার মা কেই স্যাক্রিফাইস করে দিয়েছ!!
অয়ন, তুমি কী উল্টাপালটা বলতেছ আমি কিছুই বুঝছিনা, এনি ওয়ে কণা বাইরে বসে আছে, আমি ওর সাথে কথা বলছি নাকি তুমি বলবে?
বাবা আমি কণাকে সত্যি টা বলতে চাই
অয়ন প্লিজ তুমি শুধু ওকে বিয়ে করবেনা, তোমার অন্য কোথাও প্রেম আছে জানিয়ে দাও বাকি টা আমি দেখছি।
বাবার অবাধ্য আমি কখনোই হই নি, আজ ও হতে পারিনি। নির্জলা মিথ্যা কথা বলতে হলো কণাকে, আমি অন্য কাউকে ভালবাসি তার সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাই। কণা অবিশ্বাসের দৃষ্টীতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। আমি বললাম- আমাকে ক্ষমা করো, কণা বলল- কেন? জানিনা। বলে আমি রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। কণাকে বাবা আর কি বলেছিলেন আমি জানিনা।
কিন্তু আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছিলাম, আপাতত কণার ব্যাপারটা সামলানো গেছে। কণা যথারীতি আমাদের বাসায় আসতো বাবাকে থেরাপি দিতে, আমি কখনোই ওর সামনে যেতাম না লজ্জা আর গ্লানিতে।
সুস্থ হয়ে আমি অফিস শুরু করলাম। আবার ব্যাস্ততা, আবার প্রথম থেকে শুরু করা। এর মাঝে আমার মা এর ব্যাপারে জানতে আমি অনেক কিছু ভাবলাম, কিন্তু কোন প্ল্যান ই বেশিদূর এগোতে পারলাম না, রেহানা আন্টি আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ান, আর হাসেম মামা তো আজীবন বাবার পোষ্য, উনি আমাকে মুখস্ত বুলি আওড়িয়ে যায়। কিন্তু একটা অদ্ভুত ঘটনা আমাকে একটা সূত্র এনে দিল সামনে, বাবা অসুস্থ হওয়ায় আমরা বেশ কিছু বায়ারের অর্ডার হারিয়েছিলাম, ব্যাংকের কাছে প্রচুর পরিমান দেনা হয়ে গিয়েছিল। আমি কিছু প্রোপ্রার্টি বিক্রি করে প্রাথমিক ধাক্কা সামলানোর প্ল্যান করলাম। বাবার সাথে পরিকল্পনার আগে আমি আমাদের প্রোপার্টিগুলোর লিগ্যাল পেপার নিয়ে বসলাম, আমাদের উকিল ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ চাচার সাথে আমি বসতে চাইছিলাম, উনি আমাদের পুরানো ল’ইয়ার। কী মনে করে জানি আমি আমাদের জুনিয়র লিগ্যাল কর্মকর্তা ফারিয়ার সাথে আগে কথা বলতে চাইলাম। ফারিয়া মেয়ে টা অসম্ভব সুন্দরী, অফিসের সব ইয়াং ছেলেদের ক্র্যাশ সে আমি বুঝতে পেরেছি, যাই হোক। ফারিয়া বছর দুয়েক হলো জয়েন করেছে। আব্দুল্লাহ চাচার বয়স হয়ে যাওয়াও সে ই আস্তে আস্তে বুঝে নিচ্ছে আমাদের লিগ্যাল কাজ গুলো।
ফারিয়া জানালো আমাদের বিরাট একটা প্রোপার্টি আছে গাজীপুরে। যেটা আসলে অনেক বছর ধরে পরেই আছে, আর একটু রিমোট অঞ্চলে হওয়াতে সেটা কোন কাজে ও লাগেনি, ফ্যাক্টরি করার জন্য বাবা কিনেছিলেন বলে ফারিয়ার ধারনা, বিশেষ কিছু সে ও জানেনা। ফাইলগুলো আনতে বললাম, অনেক পুরানো ফাইল। ফাইল খুলে আমি একটা ধাক্কা খেলাম জমিটার মালিক বাবা না, রুহুল আমিন নামের কেউ। তাহলে এই প্রোপার্টি আমাদের নামে কেন? আমি ফারিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ফারিয়া কিছুই জানেনা। ফাইল ঘেটে দেখলাম, এই প্রোপার্টি টাই আমাদের সব চেয়ে পুরাতন, প্রাথমিক লোন ও নেয়া হয়েছিল এই প্রোপার্টির এগেইন্সটে। পরে বাবাকে পাওয়ার অফ এটর্নি দেয়া হয়েছে। আর লোন টা নেয়া হয়েছিল, আমার জন্মের চার মাস পরে। পরবর্তীতে এই প্রোপার্টি আমাদের কোম্পানির নামে ওয়াকফ করে দিয়েছেন রুহুল আমিন সাহেব। বিষয়টা আমার কাছে ব্যাপক ঘোর প্যাচ লাগায় আমি ভাবছিলাম বাবার সাথে কথা বলব কিনা। পরবর্তীতে আমি ফারিয়াকে দিয়ে আব্দুল্লাহ সাহেবের কাছ থেকে কথা বের করতে বললাম। ফারিয়াকে বারেবার বলে দিলাম আমি জানতে চেয়েছি সে যেন উনাকে বুঝতে না দেয়।
ফারিয়া যথেষ্ট স্মার্ট আর চটপটে আছে। পরদিন ই আমার জন্য বিশাল এক সারপ্রাইজ নিয়ে হাজির। রুহুল আমিন সাহেব আমার বাবার শ্বশুর, বাবাকে নাকি বিয়েতে জমিটা দিয়েছিল ব্যাবসা করার জন্য। মানে আমার নানার কাছ থেকে যৌতুক নিয়েছিলেন বাবা, উফফ আমার আজীবন মহাপুরুষ ভেবে আসা বাবা আর কত শত ক্রাইম করেছেন কে জানে। আমি আবারো আমার মায়ের জন্য অসম্ভব কষ্ট বোধ করতে থাকলাম। আমি সিধান্ত নিলাম বাবাকে কিছু না জানিয়ে আমি আরো তথ্য বের করব, আর এই কাজে অবশ্যই আমার প্রধান সহকারি হতে হবে ফারিয়াকে।
ফারিয়া কোন বিচিত্র কারনে আমাকে অসম্ভব ভয় পায়, আমি তার ভয় কাটানোর জন্য ট্রাই করলাম। তার জন্মদিনের আয়োজন করালাম অফিসে। তার সাথে মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প করতে শুরু করলাম। জানা গেলো সে আমার দুই ব্যাচ জুনিয়র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এই সূত্রে সে আমার সাথে আগের চেয়ে সহজ আজ সপ্রতিভ হলো। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফারিয়ার গল্প শুনতাম, তার সাথে সহজ হওয়াটা দরকার ছিল আমার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। ফারিয়ার বয় ফ্রেন্ড আছে জানলাম, ছেলেটি অন্য ধর্মের বলে বাসায় কিছু সমস্যা। কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেটি দেশের বাইরে যাবে পড়তে, সে বিয়ে করে তার সাথে বাইরে চলে যেতে চায় জানলাম। ফারিয়ার সাথে আমার একটা মিষ্টি বন্ধুত্ব হল। সে আমাকে ইদানিং অয়ন ভাইয়া ডাকে, সে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা-মাকেও খুব ভাল বাসে এদিকে প্রেমিককেও। বিরাট টানাপোড়নে আছে জানায়।
আমি তাকে একটু একটু করে আমার কথা বললাম। আমার মা নেই ছোটবেলা থেকে শুনে কেঁদে ফেলল বেচারি, একদিন সুযোগ বুঝে তাকে আমি আবদুল্লাহ চাচার কাছ থেকে আমাদের কোম্পনির ব্যাপারে আর রুহুল আমিন এর পরিবারেরো জানতে বললাম।তাকে কথা দিলাম, তার প্রেমিকের ব্যাপারে তার বাবা কে কনভিন্স করার সব ট্রাই আমি করব, যদি না পারি তাকে বিদেশে পাঠানোর সব দায়িত্ব আমার।
ফারিয়া আমার কাছ থেকে কিছু সময় চাইল।
অফিসের নানা ঝামেলায় বাসায় আসলে আর খুব একটা অবসর সময় পাইনা। কণা তার ডিউটি করতে বাসায় আসে, ভুলেও আমার সামনে পড়ে গেলে চোখ ফিরিয়ে চলে যায়, আগের হাসিখুশি ভাবটা আর নাই বাবার সাথে, হাসেম চাচার কাছ থেকে জানলাম, কণার বাবা খুব অসুস্থ। পরিবার টি নানান ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, বাবা অনেক হেল্প করতে চাইছেন কিন্তু কণা অনড়, নিবেনা সে কিছুই তার নির্ধারিত চার্জ ছাড়া। কণার ভাইকে বাবা প্রতিষ্ঠিত করার কথাও বলেছিলেন নাকি, কণা রাজি হয় নি। উলটো নাকি বাবাকে বলেছে এইধরনের কথা বললে, সে আর বাসায় আসবেনা। আমার খুব খারাপ লাগলো শুনে, কিন্তু আমার সাথে বিয়ে হলে এর চেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেত সে। এখন হয়তো আমাকে ঘৃণা করে, সত্যি টা জানলে করুনা করত।
একদিন সকালে আমি ছাদে বসে কফি খাচ্ছিলাম, দেখি কণা নিচে সাব্বিরের সাথে গল্প করছে, সাব্বিরকে খুব হাসি খুশি দেখাচ্ছিল। কণাও যথারীতি সাবলীল। আমার মাথায় একটা ভিন্ন পরিকল্পনা এলো। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাকে সাব্বিরের কাছাকাছি যেতে হবে, বাবা সেটা সহজে হতে দিবেন না। আমি সু্যোগ খুজতে লাগলাম।
কিন্তু এত খারাপ ভাবে সুযোগ আসবে আমি চাই নি, সন্ধ্যায় এম বি এ ক্লাস থেকে ফেরার সময় মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় পড়ে সাব্বির, কয়েকদিন হাসপাতালে থাকাটা জরুরি হয়ে পড়ে, আমি প্রতিদিন ওকে দেখতে যেতাম সন্ধ্যার পর আর অনেক সময় কাটাতাম। সাব্বিরকে বললাম আচ্ছা সাব্বির আমাকে তুমি ভাই ভাবতে পারোনা, সব সময় এমন আড়ষ্ট কেন থাকো! আমি কী কখনো তোমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছি?
সাব্বিরের চোখে পানি এসে পড়লো শুনে- স্যার আপনি সব জানেন না, সব জানলে আমাকে ভাই ভাববেন না আর, আমাকে শুধু ঘৃণা করবেন।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম-
সাব্বির চোখ নামিয়ে নিল, আমি বললাম কি বলতে চাইছ? আমি সাব্বিরের হাত ধরলাম। ‘সাব্বির আমাকে নিশ্চিন্তে বলতে পারো’
স্যার, আমার মা আপনার বাবার রক্ষিতা এটা আপনি বোঝেন না? সবাই ভাবে আমি জানিনা, কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকেই এটা বুঝতাম, এমন কি একবার আমি তাদের কে খুব অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেও ফেলি।
সাব্বিরের কথা শুনে আমি হাসবো নাকি কাদবো বুঝিনা। তবু বললাম, তুমি জিজ্ঞেস করোনাই। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আব্বাকে(হাসেম), সে বলছে আমি ভুল দেখেছি, আর এটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে, আমি অনেকবার রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেছি আপনি জানেন না, বড় বাবা আমাকে আবার নিয়ে আসছে, ছোটবেলায় দামি খেলনা কিনে দিছে, বড় হবার পড় বড় বড় সুযোগ দিছে, ভাল জায়গায় পড়াশোনা, দামি জামা কাপড়, বাইক সব দিছে। স্যার আমি তো ছোটলোকের বাচ্চা, তাই লোভ সামলাতে পারিনাই। আপনার চোখে চোখ মেলাতে পারিনি কখনো। নিজেকে ভীষন ছোট লাগত, কিভাবে আপনাকে ভাই ভাবার সাহস পাই। সেই ছোটবেলায় ঝাপসা সেই দৃশ্য মনে পড়ে যখন আমার মায়ের কারনেই আপনার মা ঘর ছেড়েছিল। কিচ্ছু মনে নাই আর, আব্বা মাকে খুব মেরেছিল এইজন্য। পরে তো দেখলাম আমরা আপনাদের বাড়িতে চিরতরে উঠে এসেছি। বিশ্বাস করেন স্যার আমি আমার মায়ের সাথে অনেকবছর ধরে কথা বলি না ঠিক মতো।।“ আরো অনেক কিছু বলছিল সে নিজের কথা কিন্তু সেসব শোনায় মন নেই আমার।
“কী আমার মা বাড়ি ছেড়েছিল মানে কি? মারা যায় নি উনি? কি জানো ঠিক মতো বল”
ভীষন উত্তেজিত হয়ে পড়লাম আমি। আমার কন্ঠে প্রচন্ড কৌতুহল।
‘স্যার, আমি কিছুই জানি না আর, শুধু মনে আছে অনেক ছোটবেলায় আমরা আপনাদের বাসায় এসেছিলাম, বড় বাবা আমাকে খুব আদর করছিল, ‘আর তারপর একদিন দেখি আপনার মা কি নিয়ে যেন রাগারাগি করে চলে গেল।‘
আমার মা বেঁচে আছেন তাহলে!! আমার জন্মের সময় তার মৃত্যু হয় নি তাহলে!!!
আল্লাহই জানে আর কি কি রহস্য যে আমাকে উন্মোচন করতে হবে। আমার মনে হয়, আমাদের প্রোপার্টির মালিক পর্যন্ত পৌছতে পারলে আমি অনেক রহস্যের জট খুলতে পারব।
সাব্বির কী আমাকে মা পর্যন্ত পৌছাতে সাহায্য করতে পারবে?? আমি কী ওকে জানাবো ওর আসল পিতৃ পরিচয়! নাকি আমার মায়ের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত ওকে না জানানোই ভাল হবে?
গত কয়েক মাসের ঘটনা প্রবাহ আমাকে আগের চেয়ে অনেকবেশি বাস্তববাদী করে দিয়েছে, আর তাই আমি ওকে কিছু বলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলাম। ওকে শুধু বললাম, ঠিক আছে আমাকে ভাই ডাকতে হবে না তোমার স্যার ই ডেকো। কিন্তু সাব্বির আমাকে বন্ধু ভেবো তুমি বলে হাতে হাত চেপে শুকনো হাসি দিলাম আমি।
এমন সময় ফোনের ভাইব্রেশানে সম্বিত ফিরে পেলাম আমি, ফারিয়া ফোন করেছে আমায়- ভাইয়া রুহুল আমিন সাহেবের খোঁজ পাওয়া গেছে, আর আপনাদের সব প্রোপার্টি আর কোম্পানির ফাইল ও আমি হাতে পেয়েছি। কাল সকালে অফিসে সকাল সকাল চলে আসবেন।
……………………………………………………………………………
কাল ফারিয়ার ফোন কল পেয়ে জানিনা কিভাবে আমার সারাটা রাত কাটলো, খুব সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাবাকে বলে গেলাম, বাবা কনাকে একটু বলো যেন সাব্বিরকে হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসে, বাবা সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন কিছু বললেন না। বাবার প্রতি ইদানিং আমার অসীম রাগ সত্ত্বেও আমাকে বোঝার রেয়ার একটা ক্ষমতা আছে বলে আমি বাবাকে অসীম ভালবাসি। বাবার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমাকে মনে করিয়ে দিল ছোট থেকেই বাবা আমার সব প্ল্যান আমার আগেই বুঝে ফেলে। আর সাধারনত যদি সেই প্ল্যান বাস্তবায়ন করা বাবার জন্য আমার চেয়ে সহজসাধ্য হয়, তবে তিনি তা করেন। আমি একটু হেসে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম।
আজ অফিসে মনে হয় আমি ই প্রথম এসেছি। অফিসে চাপরাশি আর পিওন রা ছাড়া কেউ ই নেই। আমি আমার রুমে ঢুকে ফারিয়া কে কল দিলাম, ফারিয়ার ফোন সুইচড অফ। আমার ভ্র কুচকে গেলো আপনাতেই। আমি পিওন কে ডেকে এক কাপ কফি দিতে বললাম। কফিতে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলাম, সাধারনত আমি পত্রিকা পড়িনা। আজ নিজের অস্থিরতা কাটাতে পত্রিকায় মনোযোগ দিলাম। তৃতীয় লিংগের ব্যাক্তিদের অধিকার আর সমাজের দায় নিয়ে এক গোল টেবিল বৈঠকের সংবাদ পড়তে শুরু করলাম, যখন দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষক ও বিশিষ্ট নারী নেত্রী তার বিরোধপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। তাঁর মতে সন্তানের তৃতীয় লিংগের পেছনে বাবা-মায়ের খামখেয়ালিপনাও দায়ী। উনার মতে জন্মের আগেই সেক্স ডিটারমিনেশনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রমোট করা উচিৎ। উনি বলতে চাইছেন যে সেক্স ডিটারমিনেশানের মাধ্যমে যদি দেখা যায় সন্তান টি ক্লীব বা হিজড়া তবে শিশুটির ভয়াবহ জীবন যুদ্ধের কথা ভেবে হয় শিশুটিকে টার্মিনেট করা উচিৎ অথবা সন্তান টি হবার পর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসা উচিৎ। অন্য অংশগ্রহনকারীরা দেখলাম তার মতের বেশ সমালোচনা করেছেন। আমি আরেকবার নাম টির দিকে তাকালাম ফারহানা আমিন রোজি। তৃতীয় লিঙ্গ কে সরকার স্বীকৃতি দেয়ার পর ও আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গি খুব একটা বদলে যায় নি, ভাবছিলাম। এমন সময় টেক্সট ফারিয়ার নাম্বার থেকে আসলো- ‘স্যার, আমি একটু ঝামেলার আটকে গেছি, আমার আসতে লেইট হবে।‘
আমার কেন জানি না খুব টেনশান হচ্ছিল, আমি তাই কাজের মাঝে ডুবে যেতে চাইলাম। লাঞ্চের পর ফারিয়া শুকনো মুখে অফিসে ঢুকলো। হাসিখুশি ফারিয়াকে আজ কেন যেন খুব বিধ্বস্ত লাগছে। ফারিয়া সবসময়ই খুব পরিপাটি, আজ ই কেন যেন মনে হচ্ছে ওর ঠিক মতো ঘুম হয়নি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম- ফারিয়া, ঠিক আছো তুমি??
জ্বী স্যার, কিছু না বলেই আমাকে কোম্পানির ফাইল গুলো দেখাতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো, আমিও আসলে ফাইল গুলোর ব্যাপারে এতটাই কৌতুহলী ছিলাম যে ফারিয়ার সাথে আর কথা এগুলো না।
রুহুল আমিন সাহেব তার গাজীপুরের সব প্রোপার্টি আমার নামে এবং কোম্পানির নামে হেবা করে দিয়েছেন, বাবাকে পাওয়ার অফ এটর্নী দেয়া ছিল আমার ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। সুতরাং আমি চাইলে এখন বিক্রি করতে পারি। রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট জাজ রুহুল আমিন সাহেব ঢাকার উত্তরায় থাকেন, এই খবর টুকু ফারিয়া বলতে পারলো, সে জানালো আব্দুল্লাহ চাচা ফারিয়াকে জানিয়েছেন কোন অবস্থাতেই যেন আমাকে উনার ঠিকানাটা জানানো না হয়। ফারিয়া আমাকে ব্যাগ থেকে বের করে একটা চিরকুট দিল- স্যার আমি অনেক ঝামেলা করে আপনার বাবা-মায়ের ডিভোর্সের ফাইল থেকে খুব দ্রুত ঠিকানা টা বের করেছি। অন্য কিছু এমনকি নাম টাও খেয়াল করার সময় পাই নি।
মনে মনে আমি চমকালাম- আমার বাবা মায়ের তাহলে ডিভোর্স হয়েছিল। মা মারা যান নাই, সাব্বিরের কথা তাহলে ঠিক, ওর বর্ন্না করা টুকরো ঘটনাগুলো আমাদের তথ্য কে সমর্থন করে যাচ্ছে। আমার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ছে রেহানা আন্টির উপর, উনার জন্যই তাহলে আমি মাতৃ স্নেহ বঞ্চিত, আমার বাবা তো আরেক কাঠি উপরে। নিজের প্রেম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমাকে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত রেখেছেন এত বছর, না জানি আমার মা কোথায় আছেন কেমন আছেন।
কী ভেবে যেন দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে বেরিয়ে গেল আমার মুখ থেকে- ফারিয়া জানো আজ ই প্রথম আমি জানলাম আমার বাবা- মায়ের ডিভোর্স হয়েছে, আমি জানতাম আমার মা মারা গেছে।
কী বলছেন স্যার!! সত্যি !! আমি তো আবদুল্লাহ চাচার কাছ থেকে জানলাম আপনার আম্মা খুব স্কলার ছিলেন, আপনার নানাও আপনার বাবাকে খুব ভালবাসতেন। প্রতিবছর আমাদের কোম্পানির একটা শেয়ার আপনার নানার একাউন্টে পাঠানো হয়। আচ্ছা স্যার, আপনার মা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তা নিশ্চয়ই আপনি জানতেন।
আজ মনে হয় আমার ধাক্কা খাওইয়ার দিন, এতদিনের চাপা সব তথ্য আজ আমার নার্ভাস সিস্টেমে আঘাত দিচ্ছে। ‘না, আমি জানতাম না- জানলে আমি অবশ্যই তাকে খুঁজে বের করতাম’
স্যার আপনার এন আই ডি তে আপনার মায়ের নাম আছে না? আমরা সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরি থেকেও তাকে খুঁজে বের করতে পারব আশা করি। ফারিয়ার কথায় আমি বেশ আশার আলো খুঁজে পেলাম। দ্রুত ডিরেক্টরি যোগাড়ের ব্যাবস্থা করলাম।
এন আই ডি তে আমার মায়ের নাম দেয়া আছে- আবেদা ফারহানা, ডিরেক্টরি তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও এই নামের কাউকে পেলাম না, অর্থাৎ তথ্য ভুল আছে কোথাও, আমি খুব হতাশ বোধ করতে থাকলাম। আমার মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছিল তখন। ফারিইয়া বলল ভাইয়া চলুন বাইরে কোথাও বসে কফি খেয়ে আমরা আবার কাজ শুরু করি।
ফারিয়ার সাথে কফিশপে বসে মাথা থেকে আগের সব চাপ মুক্ত হবার জন্য হাল্কা গলায় বললাম- ‘তোমার বয় ফ্রেন্ড কেমন আছে, ফারিয়া? তোমাদের বাইরে যাওয়ার প্ল্যানের কী হলো?’
ফারিয়া চুপ করে থেকে বলল- ভাইয়া কাল রাতে ও আমাকে কিছু না বলে চলে গেছে, ওর ভিসা কিংবা যাওয়ার ডেট সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ফারিয়া।
‘ আল্লাহ কী বলো!! কিছুই বুঝতে পারো নি তুমি? এমন করতে পারলো সে!!” আমার কন্ঠে উষ্মা।
‘ ভাইয়া, সে যে আমার কাছ থেকে মুক্তি চায় সেটা আমি বুঝতে পারলে তো এম্নিতেই আমি ওর কাছ থেকে সরে আসতাম, এতদূর এগিয়ে যাওয়ার পর এভাবে পালানোর কোন কারন আমি খুঁজে পেলাম না’ ফারিয়া চোখ মুছতে মুছতে বলল।
ইশ, আজ একের পর এক চাপ যাচ্ছে মনের উপর দিয়ে। ফারিয়াকে রিল্যাক্স করার দরকার। আমি সহজ গলায় বললাম- আল্লাহ যা করেন ভালর জন্য ই করেন, আমার মনে হয় এই সম্পর্ক ভাল কিছু বয়ে আনতো না, তুমি মন খারাপ করো না, নিশ্চয়ই তুমি আরো অনেক ভাল কাউকে ডিসার্ভ করো।‘
ফারিয়া শুধু শুকনো হাসি দিয়ে বলল- আচ্ছা ভাইয়া আপনি স্যারকে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেন নি।
‘করেছি ফারিয়া, বাবা এড়িয়ে গেছেন। অ্যার এখনো তো সে খুব ই অসুস্থ, অপ্রিয় কিছু বললেই আরো অসুস্থ হয়ে যান’
ও ভাইয়া আরেকটা জিনিস জানেন আমাদের কোম্পানির একক মালিক কিন্তু আপনি, স্যারের কোন শেয়ার নাই। আপনার মাকে শুধু একটা নির্দিষ্ট শেয়ার দেয়া হয় প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা হিসাবে।
আল্লাহই জানে আমার অ্যার কী কী জানতে হবে, আমি ফারিয়াকে বললাম, ব্যাংক ডিটেলস থেকে নানার ডিটেইল ঠিকানা বের করতে। ফারিয়ার মুখ এবার উজ্জ্বল হলো। স্যার ইনশাল্লাহ কাল পেয়ে যাবেন।
আমরা অফিসে ফিরে কোম্পানির অন্যান্য পেপার গুলো চেক করলাম। তেমন গুরুত্বপূর্ন নতুন কোন তথ্য পেলাম না, বরং ফারিয়া যা জানিয়েছে মোটামুটি তাই।
আমার ভীষন ক্লান্ত লাগছিল। ফারিয়াকে বললাম- আজ থাক কাল আবার কাজ শুরু করব। ফারিয়া বলল- ভাইয়া এখন কী বাসায় যাবেন? আমি বললাম না, বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছেনা এখন। আমাদের কেয়ার টেকারের ছেলে কে দেখতে হাসপাতালে যাবো ভাবছি।
‘ভাইয়া আমি আসি আপনার সাথে? বাসায় যেতে আমারো ইচ্ছা করছে না’।
‘ভেবে যেন রাজি হয়ে গেলাম আমি’। ‘আচ্ছা চলো’
হাসপাতালে সাব্বিরের কেবিনের বেশ আগে থেকেই সাব্বিরের হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা গিয়ে দেখি কনা এসেছে সাব্বিরকে দেখতে, গল্প জমে উঠেছে। আমার সাথে ফারিয়াকে দেখে কনা খুব অপ্রস্তুত হলো, হয়তো ভেবেছে এই সেই মেয়ে যার সাথে আমার প্রেম। আমি সেটা ভেবে একধরনের রিল্যাক্স বোধ করতে থাকলাম, যাক তাহলে কনা আমার কথা এবার বিশ্বাস করে আর কষ্ট পাবেনা। আমাদের দেখে কনা দ্রুতই রাত হবার অজুহাতে বেরিয়ে গেল। সাব্বির কে দেখলাম কনাকে তুমি তুমি করে বলছে। আমার ভাল লাগলো। মনে হলো প্ল্যানের কাছাকাছি পৌছে গেছি। বাবার সাথে কঠিন লড়াইয়ের আগে কনা আর সাব্বিরকে নিয়ে করা প্ল্যান টা এক্সিকিউট করা দরকার। কনাকে স্যাটেল করা আমার দরকার। সাব্বিরকে কাল সকালেই রিলিজ করে দিবে শুনলাম।
ফারিয়াকে বাসায় ড্রপ করে বাসায় ফিরলাম আমি যখন, তখন প্রায় মাঝ রাত।
পরদিন সকালে বাবার কাছে গেলাম। বাবা তুমি সারাজীবন আমার ইচ্ছা গুলো প্রাধান্য দিয়েছ, আমার একটা ফেভার করবে প্লিজ!!
বাবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, আমি বললাম- আমি চাই বাবা তুমি সাব্বিরের সাথে কনার বিয়ের ব্যাবস্থা করবে।
বাবা বললেন উনারা তোমাকে জামাই হিসাবে পছন্দ করেছিলেন, এখন কি সাব্বিরকে মানবেন?
‘কেন মানবেন না, তুমি ঠিকই ব্যাবস্থা করবে যাতে তারা এবং কনা মানে, আমার মনে হয়না কনার সাব্বিরকে অপছন্দ’।
বাবা বললেন- দেখি।
‘দেখি না, আমি জানি তুমি পারবে’
পরবর্তী কয়েকদিন আমি আর ফারিয়া আরো কিছু তথ্য উদ্ধার করলাম, যেমন আমরা এখন যে বাড়িটা তে থাকি, তা আসলে আমার নানার প্রোপার্টি মানে জমিটা নানার ছিল, এখনকার পাচ তলা বিল্ডিংটার কাজ শেষ হয় আমার ৭ বছর বয়সে। সেটা বাবা ব্যাংক লোনের মাধ্যমে করেছেন। জমিটা নানা আমাকে দিয়েছেন, বাবা পাওয়ার অফ এটর্নি এখানেও।
আমার বাবা যে একজন পি এইচ ডি হোল্ডার আমি সেও নতুন করে জানলাম। অ্যার জানলাম আমার বাবা এবং মা ক্লাস মেট ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উনারা একই সাথে বিদেশ গিয়েছিল। এসব তথ্য পাওয়া গেলো বাবার উপর প্রকাশিত এক পুরানো পত্রিকার ফিচারের কাটা অংশ থেকে। দেখা যাচ্ছে ফারিয়া মেয়েটা বেশ কাজের আছে।
আমার আর ফারিয়ার অনুসন্ধান বেশ আগাচ্ছিল। বাবা ও কনার সাথে সাব্বিরের বিয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আভাস পেলাম হাসেম মামার কাছ থেকে। কনা নাকি সিদ্ধান্ত দিতে দেরি করছে। যাক, দেরি করছে মাত্র নেতিবাচক সিদ্ধান্ত তো আর দেন নি।
ব্যাংক থেকে নেয়া নানার ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, উনারা ঐ বাড়ীতে এখন আর থাকেন না। আমি কিছুটা হতাশ হলাম। ফারিয়া বলল , ভাইয়া আমার উপর ছেড়ে দেন আমি দেখছি। আমি জানি ফারিয়া নিশ্চয়ই কোন না কোন ব্যাবস্থা করবেই।
কিন্তু পরবর্তী কয়েকদিন ফারিয়ার কোন দেখা নাই, ফোন অফ। অফিসেও এলো না। আমি বাসায় খবর নেয়ার জন্য লোক পাঠিয়ে জানলাম ফারিয়া অসুস্থ। আমার জীবন সবসময়ই কেন যে এত বেশি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়।
এক রাতে আমার কাছে ফোন এলো আমাদের অফিসের এক এক্সিকিউটভের- স্যার, ফারিয়া ম্যাডাম সুইসাইড এটেম্প করেছে, হাসপাতালে ভর্তি। তখন রাত প্রায় একটা, আমি নিজে ড্রাইভ করে রুদ্ধশ্বাসে চললাম হাসপাতালের দিকে রাতের পোষাকেই। কী এমন হয়ে গেল ফারিয়ার যে সুইসাইড এটেম্প করতে হলো। এর আগে প্রিয় বন্ধু আসিফের সুইসাইডের দুঃসহ স্মৃতির ট্রমা আবার আমার মাঝে ফিরে আসছে। আমি প্রার্থনা করতে থাকলাম- হে স্রষ্ঠা, আমার এক প্রিয় বন্ধুকে তুমি আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছ, আমার আরেক প্রিয় বন্ধু ফারিয়া কে তুমি আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও না। না চাইতেও আমার চোখে জল আসলো। মনের পর্দায় ফারিয়ার মুখ টা বারেবার ভেসে উঠছিল।
……………………………………………………….
সে ছোটবেলা থেকে মা ছিল না আমার, বাবা ছাড়া সত্যিকার অর্থেই কারো ভালবাসা পেয়েছি মনে করতে পারিনা। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল খুব। বাবার অসহায় অতীত আর আমার মায়ের অন্তর্ধানের রহস্যের জট আরো পাকিয়ে যেতে না যেতেই, আমার খুব কাছের ফারিয়ার আত্মহননের চেষ্টা আমাকে বিহবল করে দিচ্ছিল।
হাসপাতালে পৌঁছে, অবাক হলাম আমাদের কয়জন অফিস কলিগ ছাড়া ফারিয়ার বাসা থেকে কেউ নেই, জানলাম ওর বাবা হাসপাতালে ভর্তি করেই চলে গেছে। বুঝলাম সম্ভবত বাসার সাথে ঝামেলা। এখন ফারিয়ার জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আমার উপায় নেই। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে এক ভয়াবহ তথ্য আবিষ্কার করলাম।
‘ফারিয়া প্রেগন্যান্ট’
আচমকা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো- কী!! সত্যি!
ডাক্তার বললেন হ্যাঁ- আর এই জন্যই উনার কেইস টা আমরা খুব সেন্সিটিভ ভাবে হ্যান্ডেল করছি। যদিও কমপ্লিকেশান খুব একটা নেই। কিন্তু উনার কোন গার্জিয়ান বা এটেন্ডেন্ট ছাড়া আমরা অনেক ডিসিশানই নিতে পারিনা। আমি কিচ্ছু চিন্তা না করেই বললাম, ‘আপনি আমার কাছ থেকে ডিসিশান নিতে পারেন, আমি ওর লোকাল গার্জিয়ান । বাট আপনি একটা জিনিস নিশ্চিত করেন যে, কোন রকম থানা পুলিশ বা মিডিয়ার জানাজানি যেন না হয়’।
উনি আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন, আমি তবুও আমাদের অফিসের দায়িত্বশীল একজন কে ডেকে ব্যাপার গুলো নিশ্চিত করার চেষ্টা করলাম।
এখন শুধু ফারিয়ার জ্ঞান ফেরার প্রতীক্ষা যদিও আমি ঘটনাটা মোটামুটি আন্দাজ করে ফেলেছি আর তাই ফারিয়ার বাবা মায়ের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত টাও আমি নিলাম তবে তার আগে আমার ফারিয়ার সাথে কথা বলতে হবে।
সকালে ফারিয়ার যখন জ্ঞান আসলো, নার্স এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। ফারিয়া কে দেখে আমার এত রাগ আর দুঃখ লাগলো আমি কিছু না ভেবে ওর কাছে গিয়ে ধমকে উঠলাম- ফারিয়া ছিঃ! তুমি এটা কী করতে গিয়েছিল!! তোমার নিজের জীবনের সাথে এখন অন্য একটা জীবন ও যে জড়িয়ে গেছে!!
‘অয়ন ভাইয়া, আমি এই গ্লানির জীবন রাখতে চাইনি, চন্দনের সাথে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারিনি, এর মাঝে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডাক্তার দেখাতে গিয়ে আম্মু জেনে যায় আমি প্রেগন্যান্ট। আব্বু খুব কষ্ট পেয়েছে, আমি সুইসাইড না করলে হয়তো আব্বুই সুইসাইড করতে চাইতো, আমি কী করতে পারতাম!!’ ডুকরে কেঁদে উঠলো ফারিয়া। ‘ অয়ন ভাইয়া, আব্বু বারেবার জানতে চাইছিল আমার প্রেমিকের ব্যাপারে, যেখানে আমি চন্দনের সাথে যোগাযোগ ই করতে পারছিনা, কিভাবে নাম বলি। তারপরো আমার এক ফ্রেন্ড কে দিয়ে চন্দনের বাসায় পাঠিয়ে জানলাম, ওরা স্বপরিবারে ইন্ডিয়া চলে গেছে, এই সন্তান তার পিতৃ পরিচয় ছাড়া কিভাবে বড় হবে?? আর সময় ও পার হয়ে গেছে যে টারমিনেট করার কোন উপায় নেই’ ‘ভাইয়া দুঃখে, রাগ, আব্বু-আম্মুর কথা ভেবে আমি সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম’
‘ফারিয়া, আমাকে একটাবার বলতে পারতে, আমি না হয় চন্দনকে খুঁজে বের করার ট্রাই করতাম’।
‘ ভাইয়া, যে লোক টা আমার সাথে যোগাযোগ করবেনা বলে পালালো, সে কী আমার সন্তানের দায়িত্ব নিবে’?
আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম- ‘তাহলে এখন তুমি কি করতে চাও’
দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল ফারিয়া- আমি জানিনা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারারাত ধরে করা আমার প্ল্যান টা ওকে বলব ভাবলাম, তাতে অবশ্য সব কূল ই খুব ভালভাবে রক্ষা পাবে। স্রষ্ঠা আসলে ফারিয়ার সমস্যাটার মাধ্যমে হয়তো আমার অনেক গুলো সমস্যা সমাধানে ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন, তবে তার আগে আমাকে আগে ফারিয়াকে কনভিন্স করতে হবে।
আমি ফারিয়ার কেবিনে দরজা লাগালাম, ফারিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো, আমি ওকে ইশারায় চুপ করতে বললাম। কাছে গেলাম আমি। গাড় গলায় বললাম- ফারিয়া আমাকে তোমার কেমন লাগে?
ফারিয়া বলল- ভাল, আপনি তো খুব চমৎকার একজন মানুষ।
‘আচ্ছা ফারিয়া, তুমি যদি জানো আমি খুব অন্যরকম একজন মানুষ, মানে যার অনেক বড় একটা স্পেশিয়েলিটি আছে, যেটাকে মানুষ আমার ক্ষুদ্রতা ভাবে’
ভ্রু কুচকে তাকালো ফারিয়া- আমি বুঝতে পারছিনা ভাইয়া
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম আমি- ফারিয়া আমি যদি তোমার সন্তানের দায়িত্ব নিতে চাই, মানে যদি ওকে আমার সন্তান রূপে আমি স্বীকৃত দেই, কিন্তু ধরো যদি জানো আমি কখনোই তোমার স্বামী হতে পারবো না, তবে কি আমাকে তুমি এই সুযোগটা দিবে’?
ফারিয়ার হত বিহবল দৃষ্টি- আমি আসলেই কিছু বুঝতে পারছিনা, আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন না, বেবিটা কে এডপ্ট করতে চাচ্ছেন, আমাকে করুনা করতে চাচ্ছেন"?
‘ না, না তুমি ভুল বুঝছ, আসলে মানে ফারিয়া একটা সিক্রেট তোমাকে আজ আমি বলছি, এই সিক্রেট টা আমি আর বাবা ছাড়া হয়ত আমার মা জানেন, তুমি সিদ্ধান্ত যা-ই নাও না কেন, আমার সিক্রেট টা সিক্রেট ই রাখবে প্লিজ’।
আমি থেমে বলতে লাগলাম- ফারিয়া, আমি আসলে একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।
ফারিয়ার চোখে তখন রাজ্যের বিস্ময়। আমি হেসে বললাম-'‘ফারিয়া, বাবা আমাকে জন্মের পর থেকে একজন পুরুষ হিসাবে বড় করার অনেক চেষ্টা করেছে, প্রথম প্রথম আমি বিদ্রোহী হবার চেষ্টা করেছি, পরে মেনে নিয়েছি। তুমি চাইলে আমি তোমার পাশে থাকতে পারি একজন বন্ধু হিসাবে, একজন সুহৃদ হিসাবে'’ 'তবে হ্যাঁ, আমি খুব ভালো বাবা হবো তুমি দেখো'- হেসে বললাম আমি। তুমি রাজি থাকলে তোমার বাবা মা কে বলে সব দায় স্বীকার করে নিব আমি'’। '‘ভেবে দেখো, সব কূল ই রক্ষা পাবে, ও আর আমার স্বার্থ হলো, বাবা খুব খুশি হবে, তার প্রতিষ্ঠিত মিথ্যা আমি বাস্তবায়ন করছি দেখে'’ তারপর ও তুমি মুক্ত, তুমি চাইলে তোমার সন্তান আমার কাছে রেখে যে কোন সময় চলে যেতেও পারো...'’
ফারিয়া বলল- আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন আপনি, আমার পরিবার কে লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে?
‘আমি তোমাকে আর কত ভাবে বোঝাবো, দেখ এটা হলে তোমার এবং আমার দুইজনের সমস্যার ই সমাধান হয়। তুমি ভাবতে সময় নিতে পারো” বলে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম আমি, পেছন থেকে ডাকলো ফারিয়া, অয়ন ভাইয়া শুনুন, আপনার ফোন টা একটু দিবেন প্লিজ’, আমি এগিয়ে দিলাম, ফারিয়া কোন একটা নাম্বারে ডায়াল করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল- ‘ নিন, বাবার সাথে কথা বলুন, বাবাকে নিশ্চিন্ত করুন, আমাকেও’ বলে হাসলো।
ফারিয়ার বাবাকে বোঝানো সহজ হলো না, উনি আমাকে কিছুটা চতুর স্বার্থানেষী অফিসের বস হিসাবে ধরে নিয়ে কথা বলছিলেন, পরবর্তীতে বিয়ের প্রস্তাবে খুশি হলেন। দুই একদিনের মধ্যেই বাবার সাথে কথা বলিয়ে দিব এই শর্তে উনি ফারিয়াকে নিতে হাসপাতালে আসতে রাজি হলেন। বাবাকে জানাতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হলো না, বেশ হাসিমুখে নিজের বিয়ের কথা বললাম আমি। ফারিয়াকে বাবার খুব পছন্দ, তাই বাবাও খুব খুশি হলেন। হাসেম মামা ও খুশি হলেন। আমি অবশ্য বাবাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্তে ফেলে দিলাম- বাবা, আমি তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করতে যাচ্ছি, বিয়ে করবো , সংসার ও করবো। কিন্তু আমি চাই না আমার আর আমার স্ত্রীর জীবনে কোন অন্ধকার ছায়া থাকুক। আমি চাই তুমি সাব্বির আর তার মা, প্রয়োজন হলে হাসেম মামা সহ এই বাসা থেকে চলে যেতে বলবে, আর তা অবশ্যই আমার বিয়ের অনুষ্ঠানের আগেই, অথবা আমি এই বাড়ী ছেড়ে চলে যাবো আমার স্ত্রীকে নিয়ে। অবশ্য এই বাড়ী টা তো আমার নামেই, তাই না? বলেই ক্রুড় হাসি ছুড়ে দিলাম বাবার দিকে। আর এক মিনিট ও আমি দাঁড়ালাম না বাবার সামনে। জানিনা কেন ইদানীং সাব্বিরকেও আমার অতিরিক্ত বিরক্ত লাগে, সে এখন অনেক সুস্থ। ওর সাথে দেখা হলেই কেন জানি আমার খুব ঘৃণা অনুভব হয়।
ফারিয়ার বাবার সাথে বাবা কথা বলে আমাদের বিয়ের ব্যাবস্থা করলো, এর মাঝে ফারিয়ার সাথে আমার ওভার ফোন কথা হতো, সে এখনো ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, আমাকে এখনো অয়ন ভাইয়া আর আপনি করে বলছে। ওর শরীর ও ভাল না, তাই পরের মাসের প্রথম শুক্রবার আমাদের বিয়ের রিসিপশানের আয়োজনের কথা ঠিক হলো। বিয়ের কথা পাকাপাকি হবার পরপরি আমি আমাদের ফ্ল্যাট টা রেনোভেশানের কাজ হাত দিলাম, ঠিক আমার মন মতো করে, রেনোভেশানে সুবিধা হবে বলে হাসেম মামাকে কয়েকদিন আমাদের ফ্ল্যাটে আসতে না করলাম, আর আমি ইদানিং বাবার রুমেই বেডিং পেতে ঘুমাচ্ছি, বাবাকে বলেছি- বউ আসলে তো আর বাবাকে বেশি সময় দিতে পারবো না। বাবা ও আমার বিয়ে নিয়ে চরম ব্যাস্ত, সারাদিন ই নানান পরিকল্পনা করেন ফারিয়ার বাবা- মায়ের সাথে, রাতে ক্লান্ত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার খুব মায়া হয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলি আমি।
এক সকালে আমি অফিসে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলাম, গেটের সামনে রেহানা আন্টি আমার সামনে এসে দাড়ালেন-‘তুমি কী ভেবেছ, আমাকে বাড়ী থেকে দূর করলেই, তোমার বাবা ভাল থাকবে? আমি ওর যে যত্ন করি সেটা কী আর কাজের লোক দিয়ে হবে? তাছাড়া আমি ওর বিবাহিতা স্ত্রী। ওর উপর আমার অসীম অধিকার, আমি ওকে সঙ্গে নিয়ে যাবো’ খুব কাটা কাটা ভাবে বললেন রেহানা আন্টি, আগে হলে আমি এই ধরনের কথায় ভড়কে যেতাম, কিন্তু এখন আমি অনেক পোড় খাওয়া এক শক্ত মানুষ। আমি হাসতে হাসতে বললাম ‘শোনেন আন্টি, বাবাকে যদি আপনি আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারতেন তাহলে অবশ্যই করতেন, আপনার সব চাল এখন আমার কাছে স্পষ্ট। আপনি এক হীন ষড়যন্ত্র করেছেন আমার বাবা আর আমার সাথে, সেটা আমার বাবা না বুঝুক, আমি ঠিকই বুঝেছি। আমি চাইনা বাবাকে সেটা বুঝিয়ে কষ্ট দিতে। শোনেন, আমার মা কে খুব নিষ্ঠুর একটা ষড়যন্ত্র করে আপনি এই বাসা থেকে বের করেছেন, সেটা আমি এখন জানি, আপনাকে এই বাসা থেকে সরতে বলেছি সেটা আপনার মঙ্গলের জন্যই, আপনাদের জন্য আমি কিছু টাকার ব্যাবস্থা রেখেছি, আপনার ছেলেকে আপনি চাইলে আমি দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যাবস্থা করতে পারি, কিংবা ব্যাবসার জন্য ও দিতে পারি, তবে সেটাই শেষ, এরপর আপনাদের কোন নোংরা ছায়া আমি এই বাড়ীতে তো দূরে থাক আমার বাবার জীবনেও দেখতে চাই না। ও আর হ্যাঁ, আমার বাবার খেয়াল আমি আর আমার স্ত্রী খুব ভাল রাখব”।
তুমি কী সাব্বির কে তার জন্মদাতার কাছ থেকে আলাদা করতে চাও? রেহানা আন্টি রাগ দেখিয়ে বললেন। আমি এবার অট্টহাসি দিয়ে বললাম- ‘আন্টি, আমার বাবা আপনার সন্তানের জন্মদাতা নন সে আপনি খুব ভাল করেই জানেন, এতদিনের সব ব্ল্যাকমেইলিং শেষ হবার সময় শেষ। আমার কাছে এটার প্রমাণ আছে আন্টি, আবারো বলছি আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাংবেন না, আজ সন্ধ্যায় ফিরে যেন আমি আপনাকে এই বাসায় আর না দেখি। ও হ্যাঁ সাব্বির আর কনার বিয়ে আমি ঘটা করে দেয়ার ব্যাবস্থা ও করেছি, আমি কিন্তু আমার বাবার সন্তান, ঠিক তার মত ই উদার। সাব্বিরের বিয়েতে অবশ্যই আমি আসবো’ বলে হাসতে হাসতে আমি বের হয়ে গেলাম।
রেহানা আন্টি এখন দৌড়ে আমাদের ফ্ল্যাটে যাবে কিন্তু গিয়েই একটা বড়সড় ধাক্কা খাবে, কারন আমাদের ফ্ল্যাটটা লক করা, বাবাকে উনি আর খুঁজে পাবেন না, আমি পেতে দিব না। আমি আর আমার বাবা এতদিন শুধু একটা খেলার পার্ট হয়েছিলাম, এখন এই খেলার মূল খেলোয়াড় ই হবো আমি। সেদিন সন্ধ্যায় আমার লোক হাসেম মামা, রেহানা আন্টিকে দিয়ে আসলো তাদের জন্য আমার ঠিক করা নতুন বাসায়। আর সাব্বিরকে আমি ডেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখালাম বউ সহ ইউরোপ চলে যাবার। আমার সব কথা ই সে মানবে, মায়ের প্রতি অসীম ঘৃণা টা আমার কাজে লেগেছে। কনা রাজি হয়ে যাওয়ায় আমি সাব্বিরের বিয়ের বিশাল আয়োজনের ব্যাবস্থা করে রাখলাম, আর বিয়ের আগ পর্যন্ত সাব্বিরকে রাখলাম আমাদের কোম্পানির এক অফিসের এক্সট্রা রুমে, বলে দিলাম বাবা- মায়ের সাথে খুব একটা যোগাযোগের প্রয়োজন নেই, বরং বিয়ের আগে ওকে আর কনাকে কনার কাজিন ইশিতা সহ শপিং এ পাঠিয়ে দিব ইন্ডিয়াতে শপিং এর জন্য। আর হানিমুনে যাবে মালদ্বীপ। স্বপ্ন রাজ্যে ভাসছে এখন সাব্বির। এখন সাব্বির আমার হাতের পুতুল মাত্র।
আমার বিয়ের দিন খুব দ্রুত ঘনিয়ে আসতে লাগলো। সবাই বেশ খুশি। আর আমি আমার মা কে খুঁজে চলেছি নিরবে, নিভৃতে। আমার মনের একটা গোপন বাসনা, আমার বিয়েতে যদি মা আসতেন!!
…………………..
ফারিয়াকে কথা দিয়েছি, আমি খুব খুব ভাল বাবা হবো। আমার কাছে ভাল বাবার ছবিটা ঘুরে ফিরে আমার বাবার মুখের সাথে মিশে যায়। ইদানীং খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, বাবার ঘামের গন্ধ, বাবার আফটার শেইভ লোশনের ঘ্রাণ, বাবার রুপালী ঘড়ি, বাবার ভ্রুর নিচের কাটা দাগ সব সব কিছু আমার ডিটেইলে মনে পড়ে আর আমি চোখ বুঁজলেই দেখতে পাই- ছোট্ট আমি পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়ে কাঁদছি, বাবা অফিসে যাচ্ছিলেন খুব ব্যস্ত হয়ে, অফিস বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ালেন। আমার তিনটা স্টিচ লেগেছিল সেবার- আমি আর কতটুকু কেঁদেছি, বাবার কান্না থামানোই দায়। আচ্ছা সেই সময় গুলোতে আবার যদি ফিরে যাওয়া যেত!! আচ্ছা আমি কী আমার বাবার মত এতো আবেগী বাবা হব! ফারিয়ার সন্তান কে কী আমার আমার মাঝে ধারন করতে পারব! জন্মদাতা না হয়েও কী আমি পিতা হতে পারব!
ফারিয়ার সাথে ইদানিং খুব কমই কথা হয়, যা কথা হয় সবই ওর স্বাস্থ্য বিষয়ে। ফারিয়ার চেয়ে ওর গর্ভে বড় হওয়া সন্তান আমার আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু। আমার রেনোভেট করা ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের নিচটা জুড়ে কেবল আমার সন্তানের জন্য। উপরের ফ্ল্যাটটাতে থাকবেন বাবা, আমি বাবার জন্য ফুল টাইম দুইজন নার্স নিয়োগ দিয়েছি, আমাদের ৫ তলা বাড়ির নিচ তলায় গ্যারেজের পাশের ফ্ল্যাটে এক সময় ঘাঁটি গেড়েছিলেন রেহানা আন্টিরা, ২ তলায় বাবার একটা অফিস আছে, আর ছবি আঁকার স্টুডিও আর আমার লাইব্রেরি। তিন তলায় আমরা, মানে আমি আর বাবা থাকতাম, চার তলায় একসময় ভাড়াটে ছিল, এখন আমি সেটা নিয়ে তিন আর চারতলাকে ডুপ্লেক্স করিয়ে রেনোভেট করিয়েছি। যে রাতে রেহানা আন্টিদের চলে যেতে বলেছিলাম, তার আগের রাতে বাবাকে সরিয়েছিলাম উপরের ফ্ল্যাটে, সেখানে বাবার জন্য স্পেশাল ইন্টেরিওর আর ছবি আঁকার ঘর। একটা রুম রেখেছি আমার জন্য। নিচ তলায় থাকবে ফারিয়া আর বেবি। বাবার নার্স দুইজন ও নিচেই থাকবে, ডাইনিং বাবার রুমের সাথে। ৫ তলায় আমি একটা কনফারেন্স কাম ড্রইং রুম সাজিয়েছি।
ফারিয়ার হেল্প নিব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, ফারিয়া যদিও ক্রিমিনাল ল'ইয়ার না তবুও আইনের মারপ্যাচ গুলো ভালভাবেই জানবে হয়ত। আমি ফারিয়াকে দিয়ে হাসেম মামার কেইস এর ডিটেইল বের করার ব্যাবস্থা করলাম। পাশাপাশি সেই সময়ের পত্রিকা গুলো নিয়ে বসলাম। অবাক করা ব্যাপার কেইস টা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সে সময়ে, রাতের আঁধারে নিজ বিছানায় খুন হয় সগীর সাহেব, মানে রেহানা আন্টির সেজ চাচা, উনার মৃত্যুর সময়ে পাশের রুমে ছিলেন হাসেম মামা। মামা সেদিনই ঢাকা থেকে পরিবারে গ্রামে গিয়েছিলেন। উনার বউ বাচ্চা নাকি সেদিন শ্বশুরবাড়িতেই ই ছিল। ঘটনার দিন বিপত্নীক সগীর সাহেবের ছেলেরা কেউ ই বাসায় ছিল না। পুরো বাড়িতে নাকি হাসেম মামাই ছিলেন। সেদিন সকালে নাকি হাসেম মামার সাথে জমি জমা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিল সগীর সাহেবের তার-ই জের ধরে এই খুন বলে সন্দেহ করে পুলিশ পরবর্তীতে চার্জ শিট থেকে হাসেম মামার নাম বাদ দেয়া হয়। আমার মন বলছে আমার বাবা তার অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি খাটিয়ে হাসেম মামাকে উদ্ধার করেছিলেন।
আমার মনে হয় রেহানা আন্টির মুখোমুখি হবার সময় এসেছে আমার আবারো। কিন্তু তার আগে আমাকে আরো কঠোর একটা কাজ করতে হবে। সময় আমাকে কি ক্রুর ই করে দিয়েছে!
আমার বিয়ের আর অল্প কয়দিন বাকি থাকতে হঠাৎ ই ফোন আসে রেহানা আন্টির। হাসেম মামাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল নাকি কিডন্যাপার রা ২০ লক্ষ টাকা চেয়ে ফোন করেছিল। এদিকে সাব্বিরকেও তিনি রিচ করতে পারছেন না, পারা কথাও না, বিয়ের শপিং এ সে এখন ইন্ডিয়াতে। বিহবল অবস্থায় তিনি আমাকে কল দিয়েছেন, আমি জানি বাবা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেন নি তিনি, সে উপায় আমি রাখিনি, তাই বাধ্য হয়েই আমাকে কল দিয়েছেন।
আমি খুব শান্ত নরম গলায় উনার সাথে দেখা করতে চাইলাম। উনাকে আসতে বললাম আমার এক গেস্ট হাউসে। আশ্বাস দিলাম ২০ লাখ টাকা আমি উনাকে দিব।
ঘন্টা দুয়েক পর উনার মুখোমুখি বসলাম আমি- "আন্টি আপনি আমার মায়ের মতন, আপনার পাশে আমি অবশ্যই থাকবো। কিন্তু তার আগে যে, কিছু কথা জানার আমার খুব প্রয়োজন। আশা করি আপনি বলবেন। বুঝতেই পারছেন আপনি এখন কতটা একা"
প্রথম কথা হলো- আপনি হাসেম মামা কে বিয়ে করার দেড় বছর পর সাব্বিরের জন্ম, আমি সেটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রেজিস্ট্রার থেকে জেনেছি এবং এই যে আমার কাছে তার কপি এবং আপনাদের বিয়ের কাবিন নামাও আমার কাছে আছে। বলে আমি তার সামনে দুটো কাগজ মেলে ধরলাম।
আপনি সাব্বিরকে আমার বাবার সন্তান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার একটা হীন ষড়যন্ত্র করেছেন, সেটা কেন? আপনি কী বুঝতে পারছেন - একে তো আপনি বাবার বিবাহিত স্ত্রী উনার কাছ থেকে তালাক না নিয়েই আপনি আরেকজন কে বিয়ে করেছেন অর্থাৎ বাংলাদেশ আইন এবং শরীয়াহ মোতাবেক আপনি হাসেম মামার অবৈধ স্ত্রী। সে হিসাবে সাব্বির একজন জারজ সন্তান" বলে অট্টহাসি দিলাম আমি। “চুপ করে থেকে আপনি সময় নষ্ট করছেন, এতক্ষনে হয়ত আপনার স্বামী আরো কঠিন বিপদে আছে"। আবারো মিষ্টি হেসে বললাম আমি।
আন্টি চুপ করে থেকে বলল- ‘আমি সাব্বিরের ভবিষ্যৎ সিকিওরড করতে চেয়েছিলাম। সাব্বির আমার পেটে আসা আমার জন্য ছিল বিরক্তের আর ঘৃণার। কারন আমি হাসেম কে কখনো ভালই বাসিনি। সে তার স্বামীত্ব ফলাতে গিয়ে সাব্বির আমার গর্ভে আসে, আমার মন প্রাণ জুড়ে তখনো তোমার বাবা- টগর। সাব্বির গর্ভে আসার কয়েকমাস পর হাসেম এসে জানায় সে টগরের খোঁজ পেয়েছে, টগর এখন নাকি তার এক ক্লাসমেটকে বিয়ে করে দেশের বাইরে চলে গেছে, এই খবর টা শুনে নিজেকে ভীষন প্রতারিত মনে হচ্ছিল। টগর অন্য কারো সাথে সুখে ঘর করছে আর আমি গ্রামে পচে মরছি!! কেন আজ আমার টগর আমাকে নয় অন্য কাউকে নিয়ে সংসার করছে!! আমার খোঁজ কী একবারো তার জানতে ইচ্ছা করলো না? এতসব দ্বন্দের মাঝে আমাদের দারিদ্র্য যখন চরমে উঠলো, আমার পরামর্শে হাসেম ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মাঝে আমি জানতে পারি, আমার সেজ চাচা নাকি আমাদের সব সম্পত্তি হাসেম কে পাইয়ে দিবে বলে লোভ দেখিয়ে আমার সাথে বিয়েতে তাকে প্ররোচিত করেছে, কিন্তু বিয়ের পর থেকে কেবল ধানাই পানাই করছে। সাব্বিরের জন্মের পর ওর মুখ দেখে আমি দুনিয়ার সব কষ্ট, আমার আমোঘ নিয়তি সব ভুলে গেলাম, সাব্বিরের মুখে যেন আমার মায়ের মুখ বসানো। তোমাকে বলা হয়নি তোমার বাবা দেখতে আমার মায়ের মতন, শুনেছি তোমার দাদা আর আমার মা জমজ ভাই বোন ছিলেন। সাব্বির কে যতবার দেখতাম আমার আরো বেশি টগরের কথা মনে পড়ত। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম, এই সন্তান তো টগরের ও হতে পারতো’।
সাব্বিরের ১ বছর বয়সে আমরা ঢাকায় চলে আসলাম। হাসেম ছোট খাটো ব্যবসা দেয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পুঁজির অভাবে পারছিল না, সে আমার চাচার উপর চাপ তৈরি করছিল। কিন্তু আমার অতি ধুরন্ধর চাচা কিছুতেই প্রপার্টি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন না।
হাসেম ব্যাবসার পাশাপাশি কাজ খুঁজতে শুরু করে। এক রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিকট জাজের বাসায় কাজ নেয় সে ম্যানেজার কাম কেয়ারটেকারের, ভদ্রলোক নিঃসংগ ছিলেন। নিসংগতা কাটাতে ভদ্রলোক ব্যবসা শুরু করেছেন। হাসেম আমাকে জানায় ভদ্রলোকের স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি তার মেয়েকে নিয়ে দেশে থাকতেন। তার মেয়েও পি এইচ ডি করতে স্বামী সহ দেশের বাইরে আছেন। চাকরিতে ঢোকার কয়েক দিনের মধ্যেই সে ভদ্রলোকের মেয়ের রুমে তোমার বাবা-মায়ের বিয়ের ছবি দেখতে পায়। একদিন লুকিয়ে সেই ছবি সে নিয়েও আসে, আমাকে ভীষন টিটকারি দিতে থাকে সে, বলতে থাকে এই টগরের জন্য তাকে আমি কতই না কষ্ট দিয়েছি, আর টগর ঠিকই সুখের সংসার করছে, শ্বশুরের পয়সায় ফূর্তি করে বেড়াচ্ছে। শুনে আমার ব্রক্ষ্মতালু জ্বলে উঠলো। হাসেম আস্তে আস্তে তোমার নানার অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠল, এর মাঝে পার হয়ে গেলো আরো দুই বছর, সাব্বিরের বয়স তখন চার। আমরা শুনলাম, জাজ সাহেবের প্রেগন্যান্ট মেয়ে আর তার স্বামী দেশে আসছেন। এই খবর শোনার পর থেকে তারা আসা পর্যন্ত আমি একটি রাত ও ঘুমাতে পারলাম না। ঈর্ষা, ঘৃণা আর রাগে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলাম আমি।
তোমার জন্মের তিনচার মাস আগে দেশে ফিরলেন তিনি একা, টগরের থিসিস পেপারে কিছু কাজ বাকি থাকার কারনে সে ফিরতে পারলো না। আমি এই সুযোগটা কাজে লাগালাম। হাসেম ছিল অত্যন্ত লোভী প্রকৃতির তাকে আমি টগরের শ্বশুরের সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে এক প্ল্যান করলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল তোমার বাবাকে ব্ল্যাকমেইলিং করে তার জীবনে নতুন করে এন্ট্রি নেয়া আর সাব্বিরের জন্য নিশ্চিত একটা ভবিষ্যত গড়ে তোলা। আর পাশাপাশি হাসেম কে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দেয়া। এসব করতে হলে তোমার মা কে তোমার বাবা কাছ থেকে আলাদা করা আমার জন্য খুব দরকার ছিল। তোমার নানার হাসেমের প্রতি অপত্য স্নেহ আর বিশ্বাসের সূত্র ধরে আমি পৌঁছে গেলাম ঐ বাড়িতে, তোমার মায়ের অল টাইম গভর্নেস হিসাবে। অল্প দিনেই আমি তোমার মায়ের হৃদয় জয় করতে পারলাম। উনি খুব জ্ঞানী কিন্তু উদাসীন প্রকৃতির সরল মনের মানুষ ছিলেন। আমি উনার যত্নের নাম করে উনার কানে একটু একটু করে বিষ ঢালছিলাম তোমার বাবার নামে, সবই মিথ্যে আর বানোয়াট। একদিন আমি উনাকে বললাম এমন এক ঘটনা আমাদের গ্রামে ও ঘটেছিল, সুন্দরি প্রেগন্যান্ট বউ রেখে পরকিয়া। তাছাড়া টগর যে তার মত পরিবারের উপযুক্ত না সেটাও বললাম। তোমার মা তখন আমার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল, তোমার জন্মের সময় ঘনিয়ে আসছে, আমি আমার শেষ চালটা চাললাম। আমি জানতাম সাব্বিরের সাথে তোমার বাবার চেহারার অনেক মিল, এই ফায়দা টা আমি নিয়ে সাব্বিরকে একদিন তোমার মায়ের কাছে এনে এক দুখের কাঁদুনি ফেদে বসলাম। বললাম এক যুবক কিভাবে আমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছিল। ইংগিত দিলাম এটা তোমার বাবা ও হতে পারেন। শুরু হল তোমার মায়ের মনের দুশ্চিন্তা আর সন্দেহ। ও তোমার নানা বা মা কেউ ই জানতো না তখনো এ হাসেম আমার স্বামী। জানতো দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এর মাঝে তোমার বাবা চলে আসলেন। উনি যখন ফিরলেন আমি হাসেম কে কিছুদিন ছুটি নিতে বললাম যাতে হাসেমের সাথে আমার ব্যাপারটা এন টগর এসেই প্রকাশ করে দিতে না পারে।
টগর ফিরল।।ইশ, কী সুন্দর ই না লাগছে তাকে।
সে এসে এই বাসায় আমাকে দেখে হতবাক হয়ে গেল, স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত আচরন আর করতে পারছিল না কারোর সাথেই, এই ব্যাপার টা তোমার মায়ের দৃষ্টি এড়ালো না।
একদিন আমি ইচ্ছে করেই তার সাথে কথা বলার প্ল্যান করলাম দুপুর বেলা, কিন্তু তার আগেই তোমার মায়ের লেবার পেইন উঠে গেল। সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত। জানিনা কী হলো, তোমার জন্মের আগের এই বাসার সব আনন্দ যেন উবে গেলো। আমি বুঝলাম কোন একটা সমস্যা আছে। তোমার নানা জানালেন তোমার কিছু অসুস্থতা আছে। উনি আমাকে ঐ বাসায় আসতে আর না করলেন। এমনকি হাসেম কেও ৩ মাসের বেতন দিয়ে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিলেন। একে তো আমার প্ল্যান ভন্ডুল হতে বসেছে অন্য দিকে কাজ হারিয়ে আমরা অর্থ কষ্টে পড়ে গেলাম।
আমার ঈর্ষা আরো বেড়ে গেলো। মানুষের ঈর্ষা আসলে ভাল কিছু বয়ে আনেনা আমি সেদিন বুঝলাম, আমি হাসেম কে জমি উদ্ধারের জন্য চাপ দিচ্ছিলাম। এদিকে টগরকে আমি চিঠি লিখলাম সাব্বিরের জন্ম পরিচয় জানিয়ে, সে আমার সাথে দেখা করতে চাইলো বাইরে কোথাও। দেখা করার স্থান আমি আগেই তোমার মাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। আমার প্ল্যান ছিল হাতেনাতে ধরা খাবে তোমার বাবা। এদিকে যেদিন দেখা করার কথা সেদিন হাসেমের একটা বোকামি আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল অনেক খানি"।
রেহানা আন্টির কথা শুনে মনে হচ্ছিল মুভি দেখছি, হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়তে দেখি আমার মুখ তখন রাগে রক্তবর্ণ। রাগে আমার ইচ্ছে করছিল, উনাকে আমি খুন করি। কিন্তু আমার মাকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে, আজন্ম লালিত মায়ের স্নেহের অভাব যে আমাকে পূর্ণ করতে হবেই।
………………………………………………………………..
আমি আর রেহানা আন্টি কথা বলার মাঝেই ফোন আসলো বাবার, "অয়ন, তুমি কোথায়, আমি তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে যাবো ভাবছি"
"বাবা, আমার ফিরতে দেরি হবে, কাল যাই"
"অয়ন, তোমার নানা তোমাকে দেখতে চাইছিলেন, উনি ডাইয়িং"
"কী, কোথায়! বাবা আমি আসছি, আমি এক্ষুনি আসছি"
আমার চরম উত্তেজনা চোখ এড়ালোনা রেহানা আন্টির। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। "কি হয়েছে অয়ন? তোমার বাবা কী অসুস্থ"?
" আরে না এমনি, আপনি আপনার কথা গুলো দ্রুত শেষ করে টাকা নিয়ে চলে যান প্লিজ"
"অয়ন, আমার মনে হয় আমরা অন্য কোনদিন কথা বলি"
এবার সত্যি আমার রাগ হচ্ছে-"আন্টি, তাহলে অন্য একদিন টাকাটা দিব"
চুপ করে থেকে রেহানা আন্টি বললেন- "তবে শোন, তোমার বাবার সাথে যেদিন আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম, সেদিন হাসেম গিয়েছিল গ্রামে আমার চাচার সাথে জমির ব্যাপারে ফাইনাল কথা বলতে।
আমি ইচ্ছে করেই ওকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতেই এই প্ল্যান করেছিলাম। তোমার বাবার সাথে দেখা করতে গেলাম ছোট্ট সাব্বিরকে নিয়ে, তোমার বাবাকে দায়ী করলাম সাব্বিরের জন্মদাতা হিসাবে, তোমার বাবা- টগরের মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পড়ল। সে তোমার মা কে খুব শ্রদ্ধা করত।
আমি একসাথে ক্ষোভ আর ঘৃণার সাথে আবিষ্কার করলাম শুধু শ্রদ্ধা না তোমার বাবা তোমার মা- কে ভাল ও বাসে খুব বেশি। ঈর্ষায় আমার দু'চোখ ভেসে যাচ্ছিল, কিন্তু বুঝলাম গত কয়েক বছরে তোমার বাবার মন প্রাণ জূড়ে গেছে তোমার মা- ঐ মহিলা ডঃ ফারহানা রোজি। অসহ্য। আমার ইচ্ছা করছিল সব তছনছ করে ফেলি"
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম আমার মায়ের নাম কী!
"কেন তুমি জানো না! ডঃ ফারহানা রোজি।"রেহানা আন্টি চোখ কুচঁকে বলল।
আমি ঢোক গিললাম, না আমি ভুল শুনেছিলাম আমি এই জন্য আবার জানতে চাইলাম, আমার মনে তখন হাজার ড্রামের ডামাডোল, ডঃ ফারহানা রোজি, মানে প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী আর নারী নেত্রী ডঃ ফারহানা রোজী আমার মা! আমার সব টুকু বিস্ময় চেপে আমি উনার কথা শুনতে লাগলাম।
" তোমার মা, আমার টগরকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। টগর আমাকে বলল সব কিছু ভুলে গিয়ে হাসেমের সাথে এডজাস্ট করে নিতে, সে এমনকি আমাকে টাকা অফার ও করলো হাসেম কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। রাগে আমার সারাটা শরীর তখন জ্বলছে। আমার প্রথম ও শেষ ভালবাসা টগর আমাকে ভুলে গেছে! আমি চোখের পানি তে বুক ভাসিয়ে বললাম- সাব্বির যে তোমার সন্তান, তার দায়িত্ব তোমাকে নিতেই হবে। টগর অনেকবার আমাকে বোঝানোর ট্রাই করলো যে সে এখন বিবাহিত, সন্তানের বাবা তার সাথে কিছু সমস্যা এম্নিতেই তার ওয়াইফের চলছে সেখানে আমি যেন নতুন কোন ঝামেলা তৈরি না করে, সেই অনুরোধ সে বারেবার করছিল।"
আমি আড়চোখে দেখলাম তোমার মা তখন দূর থেকে আমাদের দেখছেন, আর সেটা বুঝতে পেরে আমি তোমার বাবাকে বলি সাব্বিরকে একটু আদর করে দিতে। টগর সাব্বিরকে জড়িয়ে ধরে অনেক অনেক আদর করে। এই দৃশ্য দেখে তোমার মা নিজের মত করে সব ভেবে নেন।
ঐ দিনই হাসেম আমার সেজ চাচাকে খুন করে ফেলে" এটুকু বলার পর আমি নিজেই বললাম-"আর সে খুনের মামলা থেকে হাসেম মামা কে বাচাঁতে আপনি বাবা কে আরো বেশি ব্ল্যাকমেইলিং শুরু করলেন, তাই না! কারন ততদিনে আপনি বুঝে গেছেন, বাবাকে আপনি হারিয়ে ফেলেছেন। আর তাই হাসেম মামাকে উদ্ধার করিয়ে নিজের বিবাহিত জীবন আবার ঝালিয়ে নেয়ার একটা অপশান আপনি খোলা রাখলেন, তাই তো?"
"তুমি খুব বেশি বুদ্ধিমান অয়ন, ঠিক তোমার অতি অহংকারি মায়ের মত"
"অয়ন, হাসেমের কেইসটার জন্য আমি তোমার বাবা কে কিছুই জানাইনি, বরং আমি চেয়েছিলাম হাসেম জেলে পচেঁ মরুক। কিন্তু হাসেম তোমার নানার সাথে যোগাযোগ করে, তোমার নানা আর প্রভাব-প্রতিপত্তি আর অনেক টাকা খরচ করে সেজ চাচার কেইস টা থেকে হাসেমের নাম সরানোর ব্যাবস্থা করে, হাসেম বেরিয়ে এসে তোমার নানার কাছে যায়। তোমার মায়ের কানে আমি আরো কথা লাগাতে থাকি, তোমার বাবাকে একজন হীন চরিত্রের পুরুষ হিসাবে উপস্থাপনের সব চেষ্টাই আমি করি"
এর মাঝে কোন এক ইস্যু তে তোমার বাবা-মায়ের কিছু মনোমালিন্য চলছিল, এই ব্যাপারটা আমি শিওর না, সম্ভবত তোমার বাবার ক্যারিয়ার প্ল্যানিং বা অন্যকিছু। আমি সাব্বিরের পিতৃত্বের দাবী নিয়ে এক সন্ধ্যায় হাজির হলাম তোমাদের বাসায়, ও একটা কথা বলা হয় নি, আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন তোমার বাবা- মা তোমার নানার বাসা ছেড়ে নতুন বাড়িতে উঠেছিল আর তোমার নানার পরামর্শে ব্যাবসা শুরু করেছিলেন। আর নানার বাসার দায়িত্বে ছিল হাসেম। তখনো তোমার নানা বা মা জানতেন না হাসেম আমার স্বামী, আমি তাকে বলতে না করেছিলাম। তোমার বাবাকেও ভয় দেখিয়ে এই তথ্য বলতে বারণ করছিলাম। যে সন্ধ্যায় আমি তোমাদের বাসায় হাজির হলাম, সেদিন তোমার বাবা- মায়ের এম্নিতেই কোন ইস্যু নিয়ে ঝগড়া চলছিল, আমি গিয়ে সাব্বিরের পিতৃত্বের দাবী নিয়ে অনেক অনেক নাটক করি, এবং ঐ বাসায় উঠে আসার হুমকি দেই এবং মিডিয়া কে জানাব হুমকি দেই। তোমার বাবা খুব সোসাইটি কনশাস মানুষ ছিলেন, আর তাই লোকলজ্জার ভয়ে আমাদের ঐ বাসায় থাকার অনুমতি দেয়। এটা তোমার মা নিতে পারেন না। তোমাকে রেখেই সে ঐ বাসা থেকে চলে যায়। তোমার বয়স তখন ৯ মাস। তোমাকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়ে বাবা, অসম্ভব কষ্ট করেছেন তোমার জন্য। কিন্তু কোন এক অজানা কারনে তোমার কাছাকাছি কখনোই যেতে দেয় নি আমাকে। তোমার মাকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছেন তোমার বাবা, এমনকি তোমার নানা ও তোমার বাবার পক্ষে কথা বলেন, কিন্তু তোমার বাবাকে মিথ্যেবাদী বলে সে ডিভোর্স লেটার পাঠায়, তোমার বাবার অসহায় অবস্থায় আমি আবার তার কাছাকাছি যাবার সুযোগ পাই যখন তোমার বাবা জানতে পারেন তোমার মা আবার বিয়ে করেছেন তোমার বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড কে।" "শোন অয়ন তোমার বাবা তোমার চেয়ে ভাল আর কিছু বা কাউকেই বাসে নাই আর তাই আমি হাজার চেষ্টা করেও সাব্বিরকে তার সন্তান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি, এমনকি আমি হাসেম কে তালাক্ক দিয়ে তোমার বাবার সাথেও আবার সংসার করতে চেয়েছি, উনি আমাকে কখনোই আর গ্রহন করতে চান নি, হ্যা সে আমাকে ভালবেসেছে অবশ্যই তবে সেটা অনেকটা বাধ্য হয়ে, কিংবা ছোটবেলার এক তীব্র প্রেম থেকে হয়ত। কিন্তু তোমাদ মায়ের প্রতি তার ভালবাসা ছিল অনেক অনেক বেশি, তার কাছাকাছি ও আমি যেতে পারিনি"
আমার আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করছিল না, তাই আমি উনার সামনে ২০ লাখ টাকায় ভর্তি একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললাম-" আপনি খুব সুক্ষ্ম ভাবে আমাদের একটা হাসিখুশি পরিবার ধ্বংস করেছেন, আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারবো না। আপনি নিজের জীবনটা ও দুর্বিষহ করেছেন, তার চেয়ে কষ্টকর কী জানেন আপনার যে সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা করার জন্য আমার জীবন টাকে আপনি স্নেহহীন করেছেন কিংবা আমার বাবা কী একটা নরমাল লাইফ ডিসার্ভ করতো না! এ কেমন সর্বগ্রাসী ঈর্ষা আমার! কী ভালবাসলেন আপনি টগরকে! ভালবাসা মানে কী কেবলই নিজের আয়ত্বে রাখা নাকি ভালবাসার মানুষের ভাল থাকার নিশ্চয়তার মাঝেও অনেক ভালবাসা থাকে! যাই হোন আন্টি আপনি যান, হাসেম মামা কে উদ্ধারের ব্যাবস্থা করুন। আশা করি আপনি নিজের ভুল বুঝতে পারবেন"।
আমি উনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা খুলে দিলাম যাওয়ার জন্য।
উনিও ব্যাগটা হাতে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলেন। আমাকে এখন একটা পুরানো হিসাব মিলাতে হবে। বাবার কাছে যাবার আগে তাই আমি ডায়াল করলাম এক সাব্বিরের নাম্বারে, সাব্বিরকে আজ একটা জরুরি কাজের দায়িত্ব দিয়েছি আমি, কাজ টা করতে পারলে সে পাবে নগদ ২০ লাখ টাকা। জরুরি কাজের জন্য তাকে আমি ইন্ডিয়া যেতে দেই নি, খুব গোপনে শেষ মুহুর্রে তার যাওয়া ক্যান্সেল করিয়ে কনাদের পাঠিয়েছি, সাব্বিরকেও পাঠাবো তবে তা কালকের পরে। তার আগে বাবার সাথে নানা কে দেখতে যাওয়াটা আমার জন্য খুব জরুরী।
আমি রুদ্ধশ্বাসে পৌছঁলাম বাসায়, কিন্তু ততক্ষণে আমার জন্য আরো এক চমক অপেক্ষা করছিল। এই চমক আমাকে নাড়ীয়ে দিল অন্য এক অধ্যায়ে।
বাবাকে বাসা থেকে পিক করে হাসপাতালের দিকে, আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বাবা বললেন- অয়ন তোমার মা কে বিয়েতে দাওয়াত দিব!!
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম বাবার দিকে, এর মাঝে ফারিয়ার টেক্সট- "অয়ন, চন্দন ফিরে এসেছে" আমার পায়ের নিচের পৃথিবী তখন দুলছে।
……………………………………………………………………………………………………………………
নানাকে দেখতে হাসপাতালে যাবার উত্তেজনার মাঝে ফারিয়ার ম্যাসেজে আমি খুব ই বিহবল হয়ে উঠলাম। তবু ও মন শক্ত করে নানার কেবিনে ঢুকলাম। বাবা এখনো খুব একটা ভাল করে হাটতে পারেন না, আমি ধরে নিয়ে ঢুকলাম। সাদা সফেদ চাদরে ঢাকা এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন, হাতে ক্যানোলা করা, স্যালাইন যাচ্ছে বুঝতে পারলাম, পাশে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডার বলে দিচ্ছে, হরহামেশাই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। বাবা সালাম দিলেন, চোখ মেলে তাকালেন আমার নানা রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট জাজ রুহুল আমিন। আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন, বাবাকে বললেন কেমন আছো টগর? বাবা উত্তর না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলেন-‘ আপনি কেমন আছেন বাবা”? ‘মৃত্যুর দিন গুনছি আমি, এই হ্যান্ডসাম কী আমার অয়ন”? নানার গলায় অসম্ভব আদর মাখা ছিল, উনি হাত বাড়িয়ে দিতেই আমি হাত টা ধরলাম, উনি আমার হাত ধরে উঠার চেষ্টা করতে চাইলেন, আমি উনাকে ধরে বসালাম। উনি আমাকে কাছে ডেকে নিলেন তারপু শীর্নকায় হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরে, আমার কানে ফিসফিস করে বললেন- “ক্ষমা করো আমাকে নানা ভাই, আমার ভুলে মা ছাড়া কেটেছে তোমার জীবন”। অনেক অনেক আদরের সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন আমার, আমার চোখ দিয়ে তখন অঝোর রোদন। নানা ভাই ও কাঁদছেন। বাবার চোখেও জল। পরিস্থিতি সহজ করতে বাবা বললেন- ‘বাবা, আগামী শুক্রবার অয়নের বিয়ে, আমার খুব পছন্দের একটা মেয়ের সাথে।
নানাভাই আমাকে আলগা করে বললেন, কে ফারিয়া? বুঝলাম নানা সব ই খবর রাখেন। ‘ফারিয়ার বাবা এসেছিল দাওয়াত দিতে’ আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানলাম ফারিয়ার বাবা নানার পূর্ব পরিচিত, আমার নানা না জেনেই দাওয়াত দিয়ে গেছেন নানাকে। ‘টগর, ফারিয়া সব জেনে বিয়ে করছে?’ ‘দেখো কাউকে ঠকিও না, নিজের জীবনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছ আশা করি’
‘ বাবা, ফারিয়া সব জেনে শুনেই রাজি হয়েছে’
আমি দ্রুত বললাম- এসব কথা থাক।
বাবা একটু বিরক্ত হলেন, তারপর নিজেই বলে চললেন- ‘বাবা, আমি চাচ্ছিলাম অয়নের বিয়ে তে ওর মা আসুক, আমি না হয় তার সামনে আসবো না। জীবনের গুরুত্বপূর্ন একটা দিন আমার ছেলের। সে তো জীবনে মা কে পায় নি, এই দিন টা তে না হয় দোয়া করে দিয়ে যাক’
নানা ভাই- নিশ্বাস ফেলে বললেন ‘ টগর, তুমি তো সবই জানো, আমি জানিনা সে আসবে কিনা, তবে আমি চেষ্টা করবো’
নানা ভাই আরো অনেক্ষন আমার সাথে অন্যান্য অনেক বিষয় নিয়ে গল্প করলেন, আমার খুব পছন্দ হলো উনাকে। মনে হচ্ছিল এত আপন এত কাছের। এতদিন দেখা হয় নি কেন ভেবে খুব খারাপ লাগছে। উনি অসম্ভব বিচক্ষন বুঝতে পারলাম যখন বললেন, ‘অয়ন আমি খবর পেয়েছি তুমি বাসা থেকে রেহানাকে সরাতে পেরেছ, আর সাব্বিরকেও রেহানার কাছ থেকে দূরে রেখেছ। তোমার বাবা এই কাজ টা করতে পারলে আজ হয়ত তোমার কষ্ট কম হতো’
‘কিন্তু অয়ন, মনে রেখো রেহানা অত্যন্ত ধুরন্ধর প্রকৃতির। তুমি খুব সাবধানে পা ফেলো, আমার মনে হয় তুমি তোমার বাবার সাথেও পরামর্শ করতে পারো, এতদিনের পোড় খাওয়া তোমার বাবার, রেহানার সরূপ তো এতদিনে চিনে ফেলার কথা’
‘নানা, আপনার সাথে হাসপাতালে কে থাকছে? ‘প্রসংগ বদলাতে চাইলাম আমি
‘নানা হেসে বললেন, তোমার অনেক গুলো বোন আছে, জানো?
আমি খুব অবাক হলাম। ঠিক বুঝলাম না কী বলতে চাইছেন নানা। আমি বললাম- মা আবার বিয়ে করেছেন শুনেছিলাম, উনার সন্তানদের ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা আসলে’, কাচুমাচু গলায় বললাম আমি। হা হা হা করে হাসলেন নানা, তোমায় কে বলল যে তোমার মা আবার বিয়ে করেছিলেন!! নিশ্চয়ই রেহানা। শোন সে সবসময় তোমাকে তোমার মায়ের কাছ থেকে আলাদা রাখতে চেয়েছে। তোমার বাবার সাথে ডিভোর্সের পর সে অনেকদিন দেশের বাইরে ছিল পোস্ট ডক্টরেট করতে গিয়েছিল, এর মাঝে বহু আগেই তার বিয়ের ইচ্ছা আর বয়স পেরিয়ে গেছে। তোমার মায়ের একটা এন জি ও আছে, সেটা তো শুনেছ নিশ্চয়ই। সুবিধা বঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করেন তিনি, অসম্ভব ব্যাস্ত তোমার মা, ঐ এন জি ওর মেয়েরা তোমার মাকে খুব ভালবাসে, আমাকেও । নানা ডাকে আমাকে। ওরাই পালা করে যাচ্ছে, আসছে। রাতে অবশ্য তোমার মা ই থাকেন। আজ তোমার মা আসলে আমি অবশ্যই তোমার বিয়ের সুসংবাদ টা দিব।
বাবা উঠতে চাইলেন,আমি ও একবার ফারিয়ার সাথে কথা বলব ঠিক করলাম, তাই বেরিয়ে এলাম বিদায় নিয়ে হাসপাতাল থেকে। গাড়ীতে উঠে ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে আমি নিজেই ড্রাইভ করতে লাগলাম। বাবা, তুমি কেন এতদিন সব লুকিয়ে রেখেছিলে, একটু বলবে?’ ‘ আমি তোকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকতাম রে, রেহানা তো একদিকে আমাকে ভয় দেখিয়েই রাখতো, তার উপর তোকে সমাজে স্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করার জন্য আমাকে অনেক হিসাব নিকাশের মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে। আজ তোকে বিয়ে দিয়ে আমি তোর মাকে দেখিয়ে দিতে চাই, আমি কোন অন্যায় করিনি। তুই একটা স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মত জীবনে আছিস’
‘বাবা, কিন্তু সেটা তো মিথ্যা, ফারিয়া বিপদে পড়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, স্বাভাবিক সময়ে হয়ত রাজি হতো না’
‘অয়ন তুমি এত বুদ্ধিমান, আর এটা বুঝ নাই ফারিয়া তোমাকে অনেকদিন ধরেই পছন্দ করে। হয়তো তার জীবনে অন্য কেউ ছিল বলে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে নাই। আচ্ছা বলতো, সে খুব ভাল করেই জানে তোমাকে বিভিন্ন তথ্য দিতে গেলে সে ঝামেলায় জড়াতে পারে, তবুও কেন তোমাকে সাহায্য করেছে??”
‘বাবা, আমি ওকে বলেছিলাম সে আমাকে সাহায্য করলে আমি ওকে চন্দনের সাথে বিয়ে দিতে হেল্প করবো’
বাবা খুব অবাক হয়ে বলল- চন্দন কে??
আমি বললাম- কেন ফারিয়ার প্রেমিক ছিল যে হিন্দু ছেলেটা, তার নাম চন্দন, না??
বাবা হাসতে হাসতে বলল- অয়ন, সরি আমাকে কিছু নাটক করতে হয়েছে, আমি জানতাম স্বাভাবিক সময়ে তুমি কিছুতেই বিয়েতে রাজি হবে না। তুমি যখন এই অফিসে জয়েন করলে তখন তার তোমাকে অসম্ভব ভাল লেগে যায়, একে তুমি তার বস। তার উপর আমাকেও সে খুব ভয় পায়, ও তার আগে বলে রাখি অয়ন, তোমাকে জানানো হয় নি, অফিসে আমার নিজস্ব গুপ্তচর সব সময়েই ছিল, এখনো আছে, তোমার প্রতিটা কর্মকান্ডের ব্যাপারে আমি সুক্ষ্ম নজর রাখছিলাম, আমি কোন হস্তক্ষেপ করিনি, কারন তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ আমার কাছে ঠিক মনে হয়েছে। ফারিয়া যে তোমার প্রেমে বিহবল সে আমি বুঝে ওকে ডেকে এনেছিলাম বাসায়, তার আগে তার পরিবারের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। ফারিয়ার বাবা-মা অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ। তোমার সব সমস্যা জানলে তারা তোমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবে না। আর তাই আমি ফারিয়ার সাথে খোলামেলা ভাবে সব কথা বলেছি। ফারিয়া তোমার ব্যাপারে খুব ডেসপারেট। আমি যখন তোমার শারীরিক অক্ষমতা তাকে বলেছি, সে শুধু বলেছে সংসার তো আমি অয়নের সাথে করবো, আপনার চিন্তা করতে হবেনা। এরপর সে সারোগেশানের মাধ্যমে মা হবার ডিসিশান নেয়, প্ল্যানটায় অবশ্য আমার পূর্ন সমর্থন ছিল, পুরো নাটক টা আমাকে সাজাতে হয়েছে’ বলেই সে বাবা হাসলো।
‘শোনো আমি সবসময় ই চাইতাম তুমি সব জানো, কিন্তু আমি নিজে বলতে পারতাম না তুমি কিভাবে রিয়্যাক্ট করো সেটা ভেবে কখনো বলিনি। আর ফারিয়াকে লিগ্যাল সব ডকুমেন্ট আমি ই ওকে দিয়েছি যাতে তুমি সব বুঝতে পারো’
কিছু থেমে বাবা বলল- কিন্তু অয়ন, তোমার মায়ের তোমায় নিয়ে কিছু প্রেজুডিস আছে। তোমার জন্মের পর তোমার সেক্স ডিটার্মিনেশান নিয়ে আমরা যখন জটিলতায় পড়েছিলাম, তোমার বাবার মনে রেহানার সত্য-মিথ্যায় ভরার গালগল্পের প্ররোচনায় সে এটাকে আমার পাপের ফল বলে আমাকে দোষারোপ করতে থাকে’।‘জানো অয়ন, আমি কিন্তু তোমার মা কে বিয়ের আগে রেহানার ব্যাপার টা তোমার নানাকে বলেছিলাম, কিন্তু উনি পুরো ব্যাপারটা চেপে যান আমাকেও বলেন আরে এসব কোন ব্যাপার না। আসলে তোমার মা আমার ক্লাস মেট ছিলেন, আমরা দুইজনেই একসাথে স্কলারশীপে বাইরে পড়তে যাবার সুযোগ পাই, তোমার নানা কিছুতেই মেয়েকে এক পড়তে পাঠাবেন না, তখন যখন শুনলেন আমি যাচ্ছি, আমাকে ডেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তোমার ক্যাম্পাস সেরা সুন্দরী মাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখাও আমার জন্য অসম্ভব কল্পনা ছিল। কিন্তু তোমার নানার আগ্রহে আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়। ভিন্ন একটা দেশে, ভিন্ন একটা পরিবেশে তোমার মায়ের সাথে আমার খুব সুন্দর একটা সময় কাটে, তীব্র ভালবাসায় ভরা একটা সংসার আমাদের ছিল। আমি একদম রেহানার সাথে বিয়ে বা ঐ ব্যাপার গুলো মোটামুটি ভুলেই ছিলাম। দেশে এসে রীতিমতো ধাক্কা খাই আমি। সাব্বিরের পিতৃত্বের দাবী আমাকে বিহবল করে ফেলে। তোমার মা আমার কোন কথাই মানতে নারাজ, উনার ধারনা ছিল আমার পাপের শাস্তি হিসাবে তুমি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ’। ‘উনি আমাকে খুব ঘৃণা করে অয়ন, তোমার জেন্ডার আইডেন্টেটি ও তার জন্য ভীষন লজ্জার ছিল। কিন্তু বাবা বিশ্বাস কর, তোমার জন্মের পর তোমার মুখ যখন আমি দেখলাম, কী অপূর্ব দেব শিশুর মত তুমি ছিলে দেখতে, আমার মনে হলো আমার সারাজীবনের কষ্ট যেন নিমেষেই দূরীভূত হয়ে গেলো তোমাকে দেখে, তোমার মা হয় তো অনেক সময় আমার উপর রাগে, তোমাকে তৃতীয় লিঙ্গ কমিউনিটিতে দিয়ে দেয়ার জন্য বলেছেন, কিন্তু আমি কখনোই একটিবারের জন্য চিন্তা করিনি তোমাকে আমার কাছ ছাড়া করার জন্য’’ বাবা, অয়ন আমি তোমাকে ভালবাসি দুনিয়ার সব চেয়ে বেশি’। বাবার চোখে জল। আমি ও কাঁদছি। বাবা থেমে বললেন- ‘তবে অয়ন, হাসেম কে তোমার কিডন্যাপ করানো ঠিক হয় নি’।
‘কিন্তু বাবা আমি তো হাসেম মামা কে কিডন্যাপ করাইনি’
কী, তাহলে! হাসেম মামা কে কে কীডন্যাপ করালো।!!
আমার কন্ঠে রাজ্যের বিস্ময়!!। বাবার চোখ বিস্ফোরিত। এমন সময় আবার ও ফারিয়ার টেক্সট- ‘অয়ন, চন্দন ফিরে এসেছে’।
……………………………………………………………………………….
ফারিয়ার ম্যাসেজ টা বাবা কে দেখালাম। বাবা বললেন হয়তো তোমার সাথে মজা করছে। আমি কিছুই বুঝলাম না, কিন্তু সাব্বিরকে আমি একটা কাজে ঢাকায় রেখেছিলাম। কী কাজ!বাবা অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, বাবা তুমি তো এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝেছ যে, সাব্বিরের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই, আমি ডি এন এ রিপোর্ট আর ওর জন্ম সনদ বের করে জেনেছি। সুতরাং, মা কে ফেইস করতে এখন আর কোন বাঁধা নাই। বাবা হাসলেন, “তুমি যে কী গ্লানি থেকে আমাকে বাচিয়েছ, সে তুমি ভাবতেও পারবেনা।‘
আমি আসলে সাব্বিরকে দুইটা কাজে ঢাকায় রেখেছিলাম- প্রথমতঃ মায়ের কাছে ওকে দিয়েই ওর জন্মসনদ আর ডি এন এ রিপোর্ট টা পাঠাতে চেয়েছিলাম। আর দ্বিতীয়ত, রেহানা আন্টিদের গ্রামের সম্পত্তিগুলো আমি উদ্ধার করিয়েছি, তা ওকে বুঝিয়ে দিব। বাবা তোমার আঁকা কিছু ছবির রয়েলিটি বিক্রি হয়েছে জানো? আমি সেই টাকাটা কোন একটা চ্যারিটিতে দিতে চাই। বাবা আমি সাব্বিরকে কিছু টাকা দিব ঠিক করেছি। এই ধরো লাখ বিশেক। তারপর ওকে দেশের বাইরে স্যাটেল্ড করে দিব। বাবা আমাকে পিঠ চাপড়ে বলল- অয়ন তুমি যখন এভাবে কথা বল আমার বিশ্বাস হয়, আমি তোমাকে সঠিক ভাবে মানুষ করতে পেরেছি। এনিওয়ে তুমি আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ফারিয়ার সাথে না হয় দেখা করে আসো। আমি বললাম- বাবা আমার খুব টায়ার্ড লাগছে, আমি বরং ওর সাথে ফোনে কথা বলে নিচ্ছি। তুমি শুধু প্লিজ ফারিয়াকে বলো না যে তুমি আমাকে সব বলেছ”। বাবা হেসে বললেন- ওকে, মাই বয়।
বাসায় এসে ফোন করলাম ফারিয়াকে। ফারিয়া, কেমন আছো? কী হয়েছে বল তো!!
ফারিয়া বেশ আর্দ্র গলায় বলল-‘ কাল কী আমাদের দেখা হতে পারে?’ বিকালের দিকে। খুব জরুরি কথা বলার আছে।
আমি হেসে ফেললাম- কেন চন্দন কে নিয়ে মারবে নাকি আমাকে?
ফারিয়া-‘প্লিজ’
‘ঠিক আছে, কোথায় বলো’
‘আমি জায়গা আর টাইম টেক্সট করে দিব’
‘ঠিক আছে’
সারাদিনের ধকলে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। ঘুম ভাঙ্গলো মাঝ রাতে, বাবার গলার আওয়াজে। বাবা ভয় পাওয়া গলায় আমাকে ডাকছেন। আমি দৌড়ে গেলাম বাবার রুমে। এর মধ্যে শুনি, বাসার কলিং বেলের সাউন্ড। আমি বললাম- কে?
‘পুলিশ’
‘পুলিশ, এত রাতে’?
এদিকে বাবা ও ডাকছে- অয়ন, পুলিশ কেন আসলো!!
আমি বাবাকে বললাম- বাবা তুমি শান্ত হও, আমি দেখছি।
গেট খুলে দেখি পুলিশ দাঁড়িয়ে- আমি বললাম এত রাতে!! দেয়ালের ঘড়ি মনে করিয়ে দিল এখন রাত নয় বরং ভোর। ভোর চারটা। এত ভোরে আমাদের বাসায় পুলিশ আসা সহজ কথা নয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার? উনারা যা জানালো, তা ভয়াবহ। গতকাল রাতে নাকি হাসেম মামার লাশ পাওয়া গেছে, তাও আবার উনার বাড়ীর সামনেই। কিডন্যাপ হবার কোন ঘটনাই পুলিশ কে নাকি জানান নি রেহানা আন্টি শুধুমাত্র কিডন্যাপাররা হাসেম মামার কোন ক্ষতি করতে পারে এই ভেবে। বাবা আর আমি দুইজন ই যারপরনাই অবাক। বাবা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, তো আমাদের এখানে কী!
"স্যার উনার স্ত্রী আপনাকে দায়ী করে মামলা করেছে"।
কী! এত্ত বড় স্পর্ধা এই মহিলার! আমি একটু জোরেই বলে উঠলাম।
'আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে'
'কী, বলছেন আপনি! আমি যাবো থানায়'
এবার বাবার মুখে রক্ত জমছে, সে বেশ জোরের সাথেই বলছে আমার ল'ইয়ারের সাথে কথা বলতে দিন আগে।
কিন্তু পুলিশ নাছোড়বান্দা, বাবা নানাকে কল দিলেন, নানা আর কাকে কাকে যেন কল দিল। এরপর পুলিশ বলে গেলো সকালে আমি যেন উকিল সহ গিয়ে এডভান্স জামিনের ব্যাবস্থা করি। আমার এত রাগ লাগছিল!
আমি শুধু বাবা কে বললাম- বাবা আমার মনে হয় এবার তোমার রেহানা আন্টির সাথে কথা বলার সত্যি প্রয়োজন, বাবা মাথা নাড়লেন।
আমি সকালে ফারিয়া আর অন্য আরেকজন ক্রিমিনাল ল'ইয়ার নিয়ে এডভান্স জামিনের ব্যাবস্থা করলাম।
জামিনের পর, ফারিয়াকে বললাম-'চল কোথাও বসি'
ফারিয়ার চোখে মুখে তখন হাসি-' চলুন"
ওকে নিয়ে সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। হাল্কা গলায় বললাম-"খুনির সাথে বসতে ভয় লাগছে না!"
খুব মিষ্টি হেসে বলল- খুনিটা তো আমাকেই আগে খুন করে ফেলেছে।
আমি অবাক হলাম কথা শুনে। বললাম-বলো চন্দনের কী কাহিনী। ফেরত আসছে! তাহলে তো ভালই, চলে যাও। আমাকে আর দয়া করা লাগলো না তোমার।
ফারিয়া বলল- রাগবেন না একদম, আসলে আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল। আপনার ফোন বারেবার আন রিচেবল পাচ্ছিলাম, অফিসেও যাচ্ছেন না। তাই ঐ টেক্সট পাঠিয়েছিলাম"
"অবশ্য মনে মনে আশা করেছিলাম, আপনি হয়ত উদগ্রীব হবেন!! আমার ভাগ্যটাই খারাপ, আপনার মনে এখনো জায়গা পেলাম না”
‘ফারিয়া, আমাকে আর কত করুনা করবে বলতো!! বাবা আমাকে সব বলেছেন”
‘উপস! আংকেল সব বলে দিয়েছে!! তাহলে তো আসলে বলতেই হয়, অয়ন আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকে চাই” হঠাত ই নাটকীয় গইলায় বলে উঠলো ফারিয়া।
‘ফারিয়া তুমি আমাকে দেখে ভাবছো আমি পুরুষ, তুমি এখনো ক্ষনিকের মোহেই আছ। তুমি বুঝতে পারছো না, পরে তোমার মোহভংগ হবে। তুমি আমাকে হয় ত্যাগ করবে নয়ত ঘৃণা’
‘ আচ্ছা অয়ন, বলতো, তুমি পুরুষ হলে আমাদের বিয়ের পরে যদি কোন অসুখে যদি পুরুষত্ব হারাতে, আমি কী তোমাকে ছেড়ে যেতাম! শোন আমি তোমাকে ভালবেসেছি। ভেতরের তোমাকে, মানুষ তোমাকে। আমি একজন আজীবনের বন্ধু চাই, যে পাশে থাকলে আমি কখনো উদাস হবো না, যে পাশে থাকলে নিজেকে আমার খুব স্পেশাল মনে হবে।“
‘কিন্তু ফারিয়া…’
‘ চুপ, আমাকে বলতে দাও- আচ্ছা বলতো, একজন নারী একজন পুরুষ ভালবাসাহীন যদি একটা জীবন কাটিয়ে দেয়, সেই জীবন কী খুব অর্থবহ কিছু!! আমি তীব্র প্রেমে বাঁচতে চাই তোমার সাথে। তুমি শুধু আমাকে অনেক অনেক ভালবেসো। আমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বো, দুনিয়ার সাথে লড়ে যখন হাফিয়ে উঠবো, আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু বলো- ভালবাসি, খুব বেশি।
অয়ন ভালবাসায় শরীর উপস্থিতি আমার কাছে অনেক গৌন। আমি চোখ বুজলেই তোমার হাসি দেখতে পাই, আমি একা থাকলেও তোমাকে অনুভব করতে পারি, এটাকে তুমি কী বলবে ভালবাসা ছাড়া! আমি তোমার সাথেই বাকি জীবন কাটাবো ঠিক করেছি।
আংকেলের কাছ থেকে আমি কনার ব্যাপারেও জেনেছি, তুমি কনাকে গ্রহন করতে পারো নি তা- ও শুনেছি। কনা ও কিছু না জেনে সরে গেছে, আংকেল তাই- আমাকে আগেই সব জানিয়েছে। আমি সব জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার শুধু একটাই জিনিস জানার…”
চুপ করে থেকে আমার চোখে তাকিয়ে গাড় স্বরে বলল- ‘অয়ন, আমাকে ভালবাসবে অনেক অনেক”
আমার হৃদস্পন্দন তখন হাজারে পৌঁছেছে মনে হচ্ছে, আমি আস্তে আস্তে বললাম- ‘ফারিয়া, ছোটবেলা থেকেই আমি খুব ভয় আর সংকোচে বড় হয়েছি, বাবা আমাকে এতটা আগলে রাখতো! আমি একসময় ভাবতাম, বাবা ছাড়া হয়ত আমার বন্ধু নেই। বাবা ও হয়তো দ্বিধা থেকেই আমাকে খুব একটা কারো সাথে মিশতে দিত না। আমি ছিলাম নিঃসঙ্গ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার প্রিয়বন্ধুর অকাল আর অনভিপ্রেত মৃত্যু আমাকে বন্ধুত্ব কিংবা ভালবাসা থেকে আরো দূরে রেখেছিল। এর মাঝেই আমার জীবনের এত চড়াই উতরাই, আমি আসলে প্রেম ভালবাসা বুঝিনা খুব একটা, কিন্তু আমি আমার বাবার মত একজন বাবা হবার স্বপ্ন দেখি ফারিয়া ইদানিং’
চুপ করে থেকে থেকে বললাম- ‘ফারিয়া সেটা তোমার জন্য সম্ভব হয়েছে, আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, আমি ভাল থাকতে শুরু করেছি। ভালবাসা কিনা বুঝিনা, কিন্তু আমি তোমার পাশে থাকতে চাই ফারিয়া, আজীবন। আমি কথা দিচ্ছি থাকব ইনশাল্লাহ”
তাকিয়ে দেখি ফারিয়ার চোখে পানি, ‘জানো অয়ন, তোমার মায়ের ব্যাপার টা আমি জানার পর থেকে অনেকবার ভেবেছি উনার মুখোমুখি হই, তোমার মত এত চমৎকার একটা মানুষ কে জন্ম দিয়ে কোন মা লজ্জিত হয় বল!! তোমাকে নিয়ে তো গর্বিত হওয়ার কথা”
আমি শুকনো হেসে বললাম- আমি আজ যা, সব বাবার জন্য। আর তাই আমার বাবাকে কেউ যদি এতটুকু ঝামেলা বা কষ্টে রাখে আমি তাকে কখনো, কোনদিন ক্ষমা করবো না।“
ফারিয়াকে বাসায় ড্রপ করে বাসার দিকে এগুলাম।
বাসায় ফিরে দেখি, গেটের সামনে সাব্বির। সে আমাকে দেখে তেড়ে আসলো। " স্যার আপনি!''
আমি সাব্বিরকে নিয়ে বাসার ভেতর ঢুকলাম। ‘সাব্বির শোন, বসো। তোমার বাবাকে আমি খুন করিনি, কারো তাকে খুন করে আমার কোন লাভ নাই এটা তো বুঝতেই পারছ, বরং সে বেঁচে থাকলেই আমি আমার বাবাকে তোমার মায়ের কাছ থেকে হয়তো দূরে রাখতে পারতাম’
‘তোমার বাবাকে উদ্ধারের জন্য তোমার মাকে আমি গতকালই ২০ লাখ টাকা দিয়েছিলাম, তুমি চাইলে সিসি টিভি ফুটেজ দেখতে পারো’
বলে সাব্বির কে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। আমার মনে হয়, আমাদের পুলিশের হাতেই ব্যাপার টা ছেড়ে দেয়া উচিৎ। সাব্বির তুমি বরং ইন্ডিয়া চলে যাও, শপিং টা শেষ করে আসো, কনা তোমাকে মিস করছে। আমি এদিকটা দেখছি।
সাব্বির তাও গোঁজ হয়ে বসে থাকলো। আমি ওর দিকে ওর চাহিদা অনুযায়ী একটা চেক বাড়িয়ে দিয়ে বললাম। বিয়ের পর এটা ক্যাশ করাবে। আর আমি অন্য ব্যাপার গুলো ম্যানেজ করে রাখব,যাতে খুব দ্রুত অই তোমরা দেশের বাইরে চলে যেতে পারো।
এখন গিয়ে গুছিয়ে নাও সব। পোস্ট মর্টেমের পর দাফনের ব্যাবস্থা আমি ই করব, তোমার সেখানে না থাকাই ভাল, বলা যায় না হয়ত দেখা যাবে হাসেম মামা কে তুমি ই খুব করেছ। বলে আমি ক্রুর হাসি দিলাম। সাব্বির যথেষ্ট বুদ্ধিমান তাই আমাকে আর ঘাটালো না। আমি ওর টিকেটে র ব্যাবস্থা করে আমার খুব বিশ্বাসভাজন একজনকে ওর দিকে চোখ রাখতে বললাম।
এবার বাবাকে মুখোমুখি হতে হবে রেহানা আন্টির। আমার মনে হয় সেখানেই মিলবে হাসেম মামার মৃত্যু রহস্য। কিন্তু, ভাগ্য সবসময় ই আমার সাথে নিষ্ঠুর ভাবে খেলেছে এটা কেন জানি আমি ভুলে যাই।
বাবার রুমের দিকে এগুতেই দেখি বাবার কোন সাড়া নেই, ওয়াশরুমের কল ছাড়া। আমি দরজা ধাক্কালাম। বাবার সাড়া নাই। আমি অল্টারনেটিভ চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে দেখি বাবা নাই। আমার আত্মা উড়ে যাওয়ার অবস্থা। তাহলে কল ছাড়লো কে?
আমি অস্থির ভাবে পুরো বাসায় বাবাকে খুঁজছি, ছাদে গিয়ে দেখি এক অভুপূর্ব দৃশ্য, যা আমাকে এক মুহুর্তে আমাকে ভরিয়ে দিল অনেক অনেক ভাল লাগায়।
শেষ পর্বঃ
ছাদে বাবার সাথে দাড়িয়ে একজন নারী, কেউ না বলে দিলেও আমি বুঝতে পারছি। উনি আমার মা। এত সুন্দরী, এত ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন আমার মা ছাড়া কেউ হতেই পারেন না। আর আমার বাবাই বা অন্য কারো হাত দুটো জোর করে ধরে থাকবে!! অবশ্যই আমার মা। আমার চোখে এখন বর্ষার ধারা। হঠাৎ ই বাবার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম- দেখি বাবাও একই সাথে হাসছে আবার চোখ ও মুছছে। মা আমাকে কাছে ডাকলেন।
‘অয়ন, তোমার বাবা তোমাকে একজন মানুষ হিসাবে গড়তে পেরেছে। আমার সব লজ্জা, দ্বিধা সব দূর করে তোমাকে একজন সত্যিকারের মানুষ হিসাবে গড়তে পেরেছে সে। আমি আমার ভুল গুলোর জন্য আফসোস করছি। তোমার বাবার উপরে অসীম অভিমান, রাগ আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে রেখেছিল। তোমার জন্ম পরিচয়ে তোমার কোন হাত ছিল না বাবা’।
আমি সব দ্বিধা ভুলে মা- কে জড়িয়ে ধরলাম । মা ও আমাকে জড়িয়ে অনেক অনেক কাঁদলও। কেন যেন আমার এই মুহুর্তে ফারিয়ার কথা খুব মনে হচ্ছিল, ভাবছিলাম এই মুহুর্তে সে ও আমার পাশে থাকলে ভাল লাগত। আচ্ছা এটাই কী তবে ভালবাসা!!
বাবা বললেন রোজি এবার তাহলে তোমার সব ভুল গুলো আজ ই ভাঙ্গিয়ে দেই। অয়ন, তুমি কী রেহানা কে ডাকবে??
আমি বললাম ‘এখন ই’?
বাবা বলল ‘হ্যাঁ আজই সব চেয়ে ভাল সময়। তবে তুমি আর তোমার মা এই দৃশ্যপটের আড়ালে থাকলে সব চেয়ে ভাল হয়’।
আমি মাথা নেড়ে, বাবা কে বললাম- তবে তুমি ই কল করো
বাবার ফোন পেয়ে কিছুক্ষনের মাঝে এসে হাজির রেহানা আন্টি, সদ্য স্বামী হারানো এক বিধবা মহিলার কোন শোক তার মাঝে নেই, সে যেন এসেছে কোন গোপন অভিসারে, অন্ততঃ তার সাজশয্যায় তা- ই মনে হচ্ছে।
এসেই বাবার পাশে বসলো। বাবা বললেন-‘ রেহানা, আশা করবো সম্মানজনক দূরত্ব তুমি বজায় রাখবে’
‘আমি তোমার স্ত্রী টগর, তোমার প্রথম প্রেম’
‘ রেহানা, আমার মনে হয় আমরা বর্তমানের কথা বলি, দেখো আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগের বাস্তবতায় আমরা কেউ ই নেই। তোমার বা আমার জীবনের অনেক অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে, আমি কত অসংখ্যবার মুক্তি চেয়েছিলাম বলতো। তুমি সাব্বিরের মিথ্যা পিতৃত্বের ভয় দেখিয়ে আমাকে আমার স্ত্রী- সন্তানের সাথে আনন্দে থাকতে দাও নি, অয়নকেও বঞ্চিত রেখেছ মাতৃস্নেহ থেকে’
‘আমি তোমাকেই আজীবন ভালবেসেছি টগর, তোমাকে আমি যে কোন মূল্যেই চেয়েছি, এখনো চাই’
‘রেহানা, কাউকে জোর করে, ভয় দেখিয়ে কি আসলে কোন সম্পর্কে রাখা যায়! তোমার বিয়ের খবর পাবার পর, আমি খুব অস্থির আর অসহায় ছিলাম অনেকদিন, এরপর অয়নের মা আমার জীবনে আসে, ওকে পাবার পর আমি ভালবাসার অন্য একটা দিক দেখতে পাই, সেটা হলো উদারতা। দেশের বাইরে কাটানোর প্রতিটা দিন সে আমার মত সহায় সম্বলহীন এতিম একটা ছেলেকে গ্রহন করেছে আকাশের উদারতায়, আমার পড়াশোনা ঠিক মতো শেষ করার জন্য, নিজে একা দেশে ফিরে কষ্ট করেছে, যে সময় টাতে তুমি আমাদের জীবনে এসে অন্ধকার ছায়া ফেলেছিলে’
‘অয়নের মা তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল’
‘ভুল কথা রেহানা, সে আমাকে এতটাই ভালবেসেছিল যে আমি তার পরে আর কিছুই ভাবতে পারিনি, তুমি আমার জীবনে যখন ছিলে সে ছিল আমার সদ্য শৈশব কাটানোর দিন গুলো, আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম, কিংবা সেই সময় টাতে তুমি এতটাই আমার অভ্যেসে মিশে ছিলে যে আমার তোমাকে ভালবাসতেই হতো। আমি সেই সময়টাতে তোমাকে সর্বোচ্চ ভালবেসেছি এটাও সত্যি, কিন্তু রোজি আমার জীবনে আসার পর বিশ্বাস করো তুমি আমার মন থেকে অনেক টাই মুছে গিয়েছিলে, আচ্ছা বলতো অয়নের মা চলে যাবার এতগুলো বছর পরেও আমি কী কখনো তোমার প্রেম নিবেদনে কোনভাবে সাড়া দিয়েছি!!”
‘তুমি আমাকে ভালবাসো না’? চিৎকার করে উঠলেন রেহানা আন্টি
‘তোর জন্য টগর, আমি সব হারিয়েছি। তোকে পাবার নেশায় আমি কখনো আমার স্বামীর সাথে মন দিয়ে সংসার করিনি, তাকে কখনোই ভালবাসতে পারি নাই! আমার সন্তান সাব্বির ও আজ আমার কাছ থেকে দূরে, সব কিছুর জন্য তুই দায়ী’
সব ভদ্রতা ছেড়ে চিৎকার করে কাদছেন এখন, ‘আমি সুখি হতে পারিনাই তোর জন্য, তোকেও আমি ভাল থাকতে দিব না, তোর ছেলে কে আমি জেলে পচিয়ে মারব। এত এত সম্পদ তুই করেছিস তোর ছেলের জন্য, আমি দুনিয়ার সবাইকে জানাবো দরকার লাগলে সংবাদ সম্মেলন করে সাব্বির কে তোর ছেলে বলে পরিচয় করিয়ে দিব’।
বাবা এবার শান্ত আর রাগী গলায় বলতে লাগলেন-‘ আমার উপরের রাগ কেন অয়ন বয়ে বেড়াবে! ওকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছ। আর আমি তো তোমার স্বামীকে, তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে, সাপোর্ট করতেও চেয়েছি। তুমি কোন সুস্থ স্বাভাবিক রাস্তায় না গিয়ে বছরের পর বছর আমাকে ব্ল্যাক মেইল করে ভয় দেখিয়ে নিজের জীবন তো বটেই আমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়েছ তুমি! এ কেমন ভালবাসা তোমার!! এই বিধ্বংসী ভালবাসা আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিয়েছে রেহানা, প্লিজ এখন অন্ততঃ নিজেকে বদলাও! অয়ন কে মুক্তি দাও তোমার এই জঘণ্য খেলা থেকে, প্লিজ’
রেহানা আন্টির চোখ বেয়ে তখন অশ্রুর ফোয়ারা-‘ টগর, তুমি আমাকে আর ভালবাসো না!!’
‘রিনা, এই রেহানা কে আমি ভালবাসি না, আমি অবশ্যই রিনা কে ভালবাসি যাকে আমি ফেলে এসেছি সেই গ্রামে, আমার শৈশবে, আমার কৈশোরে। সে রিনা তুমি আর নেই। এই তোমাকে আমি ভয় পাই, তুমি কী বোঝ না’!!
রেহানা আন্টি মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলেন আমাদের বাসা থেকে। বাবা মাথা চেপে বসে রইলেন সোফার উপরে, আমি গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম বাবা কে। পেছনে মা।
হাসেম মামার পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট আসার আগেই রেহানা আন্টি আদালতের কাছে খুনের দায় স্বীকার করে স্টেইটমেন্ট দিয়েছে। সাব্বির ইন্ডিয়া থেকে ফিরে আসার সপ্তাহ খানেক পর ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। আমাদের মালয়শিয়া ব্রাঞ্চে ম্যানেজার করে ওকে পাঠানো হয়েছে গত সপ্তাহে।
পরিশেষে............
পানির ছিটায় ঘুম ভাঙ্গলো আমার। আমি তাকিয়ে দেখলাম, পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দরি মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে হাসছে, তার ভেজা চুল থেকে পানি এসে পড়ছে আমার মুখে। ওর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছা করছিল- ‘ভালবাসি, ভালবাসি” । আমি কিছু বলার আগেই- বাবা তাত্তাড়ি উঠো তো ডাকে মাথা ঘুরিয়ে দেখি আমাদের ছোট্ট টুসি আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে।
টুসিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে থেকে মনে হলো, আহা আমার শৈশব টাই যেন ফিরে এসেছে।
Comments
Post a Comment